পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
নাটোরের আছে অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানি ভবানীর রাজবাড়ি, উত্তরা গণভবনখ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি, চৌগ্রাম জমিদারবাড়িসহ অনেক প্রাচীন স্থাপনা। এ ছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি চলনবিল ও মিনি কক্সবাজারখ্যাত হালতি বিল তো আছেই। আধুনিক স্থাপত্যে সাজানো হয়েছে এই জেলার লালপুরের গ্রিন ভ্যালি পার্ক। চলুন জেনে নেই নাটোরের ৯টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।
নাটোর রাজবাড়ি
শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নাটোর রাজবাড়ি রাণী ভবানীর স্মৃতি বিজড়িত। ঐতিহাসিকদের মতে, অষ্টাদশ শতকের শুরুতে নাটোর রাজবংশের সূচনা হয়। উত্তরবঙ্গের জমিদারদের মধ্যে নাটোর রাজবংশ মান-মর্যাদা, ঐতিহ্য, জনহিতকর কাজ ও বিষয়সম্পত্তিতে অগ্রগণ্য ছিল। রাজা রামজীবন নাটোর রাজবাড়ির প্রথম রাজা হিসেবে ১৭০৬ মতান্তরে ১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। রাজা রামজীবনের মৃত্যুর পর তার দত্তকপুত্র রামকান্ত নাটোরের রাজা হন। ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাণী ভবানীর সাথে রামকান্তের বিয়ে হয়।
রাণী ভবানী বগুড়া জেলার আদমদিঘির ছাতিনা গ্রামে ১৭১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল আত্মরাম চৌধুরী এবং মাতার নাম জয়দুর্গা। ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর নবাব আলীবর্দী খাঁ রাণী ভবানীর ওপর এই জমিদারি পরিচালনার ভার অর্পণ করেন। রাণী ভবাণীর রাজত্বকালে নাটোরের জমিদারি বর্তমান রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও মালদহ জেলাব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করে।
নাটোর রাজবাড়িটি আনুমানিক ১৭০৬-১৭১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। এলাকাটির মোট আয়তন ১২০ একর। এখানে ছোট-বড় ৮টি ভবন, ২টি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর আছে। ৩৭ একর জমির ওপর নির্মিত রাজবাড়িটি দুই স্তরের পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। পুরো রাজবাড়ি এলাকা ২টি অংশে বিভক্ত- ছোট তরফ ও বড় তরফ। রাজবাড়ির অভ্যন্তরে তিনটি মন্দির রয়েছে। এগুলো হলো- শ্যামসুন্দর মন্দির, কালী মন্দির ও শিব মন্দির। পানিবেষ্টিত পরিখা, পুকুর, বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, নিরিবিলি পরিবেশ এবং এর ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ রাজবাড়িটির প্রধান আকর্ষণ। রাজবাড়ির পুরো এলাকাটি ‘রাণী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান’ হিসেবে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে।
দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবন
নাটোর শহর থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তরে নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নে ইতিহাসখ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি অবস্থিত। এটি ‘উত্তরা গণভবন’ নামেও পরিচিত। চতুর্দিকে ৩ মিটার (১০ ফুট) উঁচু সুদৃঢ় সীমানা প্রাচীরবেষ্টিত প্রায় ৪৩ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত প্রাসাদটি প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন।
রাজবাড়ির প্রবেশপথে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বিশাল এক সিংহদুয়ার, যার উপর রয়েছে ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে আনা এক বিশাল ঘড়ি। নিরাপত্তা, সৌন্দর্য বর্ধন, মৎস্য শিকার ও বিনোদনের জন্য প্রাসাদের চতুর্দিকে রয়েছে প্রায় ১৪ একরের দৃষ্টিনন্দন সুগভীর পরিখা বা হ্রদ। এই পরিখার দুধারে ২২টি ঘাট রয়েছে। রাজা রামজীবন তার অনুগত নায়েব দয়ারামের উপরে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। এরপর দয়ারাম রায় ১৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে দিঘাপতিয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার পর এই রাজবাড়ি নির্মাণ করেন।
১৮৯৭ সালে এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে প্রাসাদটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে রাজা প্রমদানাথ রায় ১৮৯৭-১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছরব্যাপী এই রাজবাড়িটি পুনর্নির্মাণ করেন। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৯৬২ সালে দিঘাপতিয়ার অষ্টম ও শেষ রাজা প্রভাতনাথ রায় সপরিবার কলকাতায় চলে যান। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজপ্রাসাদটি থাকে। ১৯৬৬ সালে এটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সরকারি ভবন হিসেবে রাজবাড়িটি সংস্কার করা হয়। ১৯৭২ সালে এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে নামকরণ করা হয়।
এই রাজবাড়িতে মোট ১২টি ভবন রয়েছে। যেমন- প্রধান প্রাসাদ, কুমার প্যালেস, প্রধান কাচারি ভবন, ৩টি কর্তারানির বাড়ি, রান্নাঘর, মোটর গ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, স্টাফ কোয়ার্টার, ট্রেজারি ভবন ও সেন্ট্রি বক্স। প্রাচীরের বাইরে প্রধান ফটকের সামনে রয়েছে প্রায় ৩ একর জমি। রাজবাড়ির মূল ভবনসহ অন্যান্য ভবনের দরজা ও জানালা মূল্যবান কাঠের তৈরি এবং মূল ভবনের দক্ষিণ পাশের বাগানে ইতালি থেকে আনা শ্বেতপাথরের ৪টি নারী ভাস্কর্য রয়েছে। এছাড়া এখানে কয়েকশ প্রজাতির ফল, ফুল ও ঔষধি গাছের বাগান রয়েছে। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক ইতিহাসখ্যাত এই রাজবাড়িটি দেখতে আসেন।
চলনবিল জাদুঘর
দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল এলাকার মধ্যস্থলে অবস্থিত নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলা সদর থেকে ৫-৬ কিমি. দূরে খুবজীপুর গ্রামে এই জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়েছে। অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ ১৯৮৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন। চলনবিল অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, শিলালিপি, টেরাকোটা, বিভিন্ন দর্শনীয় বস্তু, মাছ, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদির নমুনা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮১ সালে সরকারিভাবে জাদুঘরের জন্য ৫ কাঠা জমি বরাদ্দ করা হয়।
১৯৮৪-৮৬ সালের মধ্যে নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরাড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থ সাহায্যে জাদুঘর ভবন গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৯৯০ সালে এটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরের অধীনে রেজিস্ট্রি হয়। এই জাদুঘরে দিল্লির সম্রাট আলমগীর ও বাদশা নাসিরউদ্দিনের স্বহস্তে লিখিত কোরান শরিফ, গাছের বাকলে লিখা ২টি সংস্কৃত পুথি, তিন শতাধিক বছরের পুরনো মনসামঙ্গল ও সত্যপীরের পাঁচালিসহ অনেক দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান দলিল ও জিনিস রয়েছে।
শহীদ সাগর
১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ লালপুর উপজেলার গোপালপুরের ৪ কিমি. উত্তরে ময়না গ্রামে পাকসেনাদের সাথে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরদিন পাকসেনাদের মেজর রাজা খান চুপিসারে পালানোর সময় স্থানীয় জনগণ তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে যেন পাকসেনা অবতরণ করতে না পারে সেজন্য বুলডোজারসহ অন্যান্য যানবাহনের সহায়তায় বিমানবন্দরের রানওয়ে অকেজো করে দেয়। এ ঘটনায় গোপালপুরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করা সত্ত্বেও এলাকার আখ চাষিদের স্বার্থে গোপালপুর সুগার মিলটি চালু রাখা হয়।
১৯৭১ সালের ৫ মে সকাল ১০টার দিকে লালসালু কাপড়ের ব্যান্ড পরা কিছু রাজাকারের সহায়তায় পাক হানাদারবাহিনীর একটি দল অতর্কিতে মিল ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করে এবং ময়না গ্রামের যুদ্ধে পাকসেনা কর্মকর্তা হত্যার অভিযোগে তৎকালীন মিলের প্রশাসক লে. আনোয়ারুল আজিম এবং অন্যান্য কর্মকর্তা, শ্রমিক ও কর্মচারীদের ডেকে বর্তমান অতিথি ভবনের সামনের গোপাল সাগর নামক পুকুরের পাশে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ পুকুরটির নামই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘শহীদ সাগর’ হয়। ১৯৭৩ সালে গোপালপুর রেল স্টেশনটির নাম শহিদ লে. আনোয়ারুল আজিমের স্মরণে ‘আজিমনগর’ করা হয়।
বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন
বনপাড়া বাজার থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে মারিয়াবাদ ধর্মপল্লী বা বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী জনসাধারণকে সেবা দানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সাংগঠনিক কর্ম-এলাকাকে ধর্মপল্লী বলা হয়। ‘মারিয়া ধর্মপল্লী’ যীশু খ্রিষ্টের মাতা মারিয়া বা মরিয়ম-এর পুণ্য নামের স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হয়েছে। বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পৌরসভার পাঁচটি এবং অন্য দুটি ইউনিয়নের ২টি গ্রাম নিয়ে এই ধর্মপল্লী প্রতিষ্ঠিত।
১৯৪০ সালে ইতালীয় খ্রিষ্টান মিশনারি সংগঠন ‘পিমে’ থেকে ধর্মযাজক ফাদার টমাস এখানে আসেন এবং ১৯৫৮ সালে এ স্থানে একটি গির্জা স্থাপিত হয়। ধর্মপল্লীর অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলোতে প্রায় ৭ হাজার খ্রিষ্টান ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী বসবাস করেন। গির্জা প্রশাসনের অধীনে এখানে একটি হাই স্কুল এবং দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হয়।
ফকির চাঁদ বৈষ্ণব গোঁসাইজির আশ্রম
লালপুর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে দুড়দুড়িয়া নওপাড়ায় (পানসীপাড়া) গহীন অরণ্যে ১১০৪ বঙ্গাব্দে বটগাছের নীচে আস্তানা স্থাপন করেন ফকির চাঁদ বৈষ্ণব। এখানেই সাধু ধ্যান, তপস্যা ও বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার আরম্ভ করেন। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, সান বাঁধানো বিশাল পুকুর, নয়নাভিরাম প্রাধান ফটক, অতিথিশালা, ভক্তশালা ও অনুপম শৈলীতে গড়া বিশাল আশ্রম।
প্রতি বছর দোল পূর্ণিমা, গঙ্গা-সড়বান ও নবানড়ব উৎসব উপলক্ষে দেশ-বিদেশের সহস্রাধিক ভক্ত-সাধক সমবেত হতেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এখনো অনুষ্ঠানের সময় অসংখ্য মানুষ এখানে সমবেত হন। সাধু ফকির চাঁদ বৈষ্ণবের মৃত্যুর পর নওয়াপাড়ার জমিদার তারকেশ্বর বাবু তার স্মরণে সমাধিটি পাকা করে দেন। ভক্তদের সুবিধার্থে জমিদার ৬৮ বিঘা জমি এবং সান বাঁধানো বিশাল দু’টি পুকুর আশ্রমের নামে দান করেন। আশ্রম চত্ত্বরে দালান-কোঠা নির্মাণেও তিনি সহযোগিতা করেন।
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড নাটোর জেলার লালপুর উপজেলা সদর গোপালপুরে অবস্থিত। এটি ১৯৩৩ সালে স্থাপিত বাংলাদেশের চিনি শিল্পের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প প্রতিষ্ঠান। তৎকালে এ মিলের মালিকানা ছিল সুরুজমাল ও নাগরমাল নামে দুই ব্যক্তির। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে মিলটি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আসে। ১৯৮৪-১৯৯০ সালের মধ্যে মিলের দৈনিক আখ মাড়াইক্ষমতা ১,২২০ মেট্রিক টন থেকে বাড়িয়ে ১,৫০০ মেট্রিক টন করা হয়।
বর্তমানে মিলের বার্ষিক চিনি উৎপাদনক্ষমতা ১৫ হাজার মেট্রিক টন। এ মিল এলাকায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার একর এবং চাষির সংখ্যা প্রায় ৩৫-৪০ হাজার। এ এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ আখ চাষ হওয়ায় এখানকার চাষিদের আখ একমাত্র অর্থকরী ফসল। কারখানা ও আবাসিক এলাকা, ১৮টি আখ ক্রয় কেন্দ্র এবং বাণিজ্যিক খামার মিলিয়ে মিলের নিজস্ব জমির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার একর। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে বর্তমানে সব মিলিয়ে প্রায় এক হাজার কর্মকর্তা/কর্মচারী ও শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। মিল এলাকায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ১টি ট্রেনিং কমপ্লেক্স, ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৫টি ক্লাব, ১টি চিকিৎসা কেন্দ্র এবং ৬০১টি আবাসন রয়েছে।
হালতির বিল
হালতির বিল বা হালতি বিল নাটোর সদর থেকে ১০ কিমি. উত্তরে নলডাঙ্গা উপজেলার অন্তর্গত একটি বিল। এটি এ অঞ্চলের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবেও পরিগণিত। বিশেষ করে ২০০৪ সালে নির্মিত এই বিলের মাঝ বরাবর পাটুল থেকে খাজুরা পর্যন্ত ৭ কিমি. দীর্ঘ সড়কটি বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে বর্ষায়, যখন বিলটি পানিতে পরিপূর্ণ হয়। বিলের ভেতরে দ্বীপের মতো ছোট ছোট গ্রামগুলো আরো মনোমুগ্ধকর।
হালতি বিলের জলরাশি আর উত্তাল ঢেউ যে কারো মন নিমিষেই ভালো করে দিতে পারে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে এখানে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে অনেক দোকানপাট ও হোটেল। সাগর না হলেও এই বিলে প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসে সাগরের মতো দিগন্ত ছোঁয়া জলরাশির পরশ পেতে। তাই পাটুল-খাজুরা রাস্তায় যেতে সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘পাটুল মিনি কক্সবাজার’।
গ্রিন ভ্যালি পার্ক
নাটোর জেলার লালপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রিন ভ্যালি পার্ক একটি চমৎকার বিনোদন কেন্দ্র। প্রায় ১২৩ বিঘা জায়গার উপর নির্মিত গ্রিন ভ্যালি পার্কটিতে সকল বয়সী দর্শনার্থীদের চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় রাইডের মধ্যে আছে মিনি ট্রেন, বুলেট ট্রেন, ওয়েবপুল, নাগরদোলা, ম্যারিগো রাউন্ড, পাইরেট শিপ, হানি সুইং, স্পিডবোট, প্যাডেল বোটসহ ১৬টির বেশি রাইড।
এছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত মনোরম পরিবেশের এই পার্কের প্রায় ৩০ একর জায়গাজুড়ে একটি নয়নাভিরাম লেক রয়েছে। রয়েছে নানান জাতের ফুল গাছ দিয়ে সাজানো প্রাকৃতিক পরিবেশ। গ্রিন ভ্যালি পার্কের অন্যান্য সুযোগ সুবিধার মধ্যে আছে শ্যুটিং স্পট, পিকনিক স্পট, অ্যাডভেঞ্চার রাইডস, কনসার্ট অ্যান্ড প্লে গ্রাউন্ড। আছে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, নামাজের স্থান, ডেকোরেটর, কার পার্কিং, ক্যাফেটেরিয়া, শপ, সভা-সেমিনারের স্থান এবং থাকার জন্য আবাসিক ব্যবস্থা। গ্রিন ভ্যালি পার্কের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৬০ টাকা। পার্কটি প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে। সাপ্তাহিক কোনো বন্ধের দিন নেই।
ভ্রমণের প্রস্তুতি:
পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও ছোট কিছু ভুল আপনার আনন্দময় ভ্রমণকে বিব্রতকর করে তুলতে পারে। তাই ভ্রমণকে আরো উপভোগ্য এবং স্মরণীয় করে তুলতে কিছু প্রস্তুতি অবশ্যই প্রয়োজন। ভ্রমণের প্রস্তুতির জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মাথায় রাখতে পারেন।
লিস্ট তৈরি করা
ভ্রমণের সময় আপনি কী কী করবেন এই পরিকল্পনাগুলো লিখে ফেলুন। এতে করে আপনার ভ্রমণের সময় যথাযথ ব্যবহার করা যাবে। লিস্ট অনুযায়ী ঠিক করুন কোথায় কোথায় যাবেন এবং সেখানে কত সময় অতিবাহিত করবেন।
হালকা লাগেজ
লাগেজ যতটা সম্ভব হালকা রাখার চেষ্টা করুন। অপ্রয়োজনীয় জিনিস এড়িয়ে চলুন। তাহলে আপনি খুব সহজেই ব্যাগ বহন করতে পারবেন। অন্যথায় ভারী ব্যাগ আপনার ভ্রমণকে তিক্ত করে তুলতে পারে।
সঠিকভাবে প্যাকিং
স্যান্ডেল বা জুতা পলিথিন বা কাগজে মুড়িয়ে ব্যাগে নিন এতে কাপড় ও অন্যান্য জিনিস পত্র নোংরা হবে না। এ জাতীয় ছোট ছোট বিষয়ে খেয়াল রাখুন।
স্থানীয় খাবার
ভ্রমণে যতটুকু সম্ভব স্থানীয় খাবার খাবেন এবং সেই খাবারের স্বাদ বুঝতে চেষ্টা করবেন। আপনি যদি ঘুরতে গিয়ে নিয়মিত রেস্টুরেন্টে খাবার খান তাহলে আপনার ঘুরতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। তাই ট্যুরিস্ট রেস্টুরেন্ট এড়িয়ে স্থানীয় লোকজন যেখানে খায় সেখানে খাবার চেষ্টা করুন।
অফ-সিজন ভ্রমণ
ভ্রমণ মৌসুমের বাইরে ভ্রমণ করলে খরচ কমে আসবে। অফ সিজনে সাধারণত পর্যটক কম থাকে। তাই হোটেল থেকে শুরু করে পরিবহন ও খাবার প্রায় সব জায়গাতেই আপনি কম খরচে চলতে পারবেন। তাই অফ সিজনে ভ্রমণ পরিকল্পনা করুন।
যাতায়াতের ব্যবস্থা
ভ্রমণের স্থানের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পর্কে আগে থেকেই জেনে নিন। কারণ এসব ভ্রমণে আমাদের সবচেয়ে বেশি ঠকতে হয় স্থানীয় যানবাহন ভাড়া নিয়ে। ভাড়া সম্পর্কে ধারণা না থাকলে গাড়িচালকরা আপনার থেকে অতিরিক্ত ভাড়া চাইবেন।
অতিরিক্ত টাকা
ভ্রমণে সবসময় আপনার বাজেটের বাইরে কিছু টাকা সাথে রাখুন। যেকোনো সময় যেকোনো বিপদে এই অতিরিক্ত টাকা আপনাকে হেল্প করবে। আপনি চাইলে মোবাইল ব্যাংকিং বা ডেবিট ক্রেডিট কারডের মাধ্যমে কিছু অতিরিক্ত টাকা সাথে রাখতে পারেন।
ছোট ব্যাগ
ভ্রমণে মোবাইল, মানিব্যাগ ও ছোট ছোট দরকারি জিনিসপত্র রাখার জন্য ছোট একটি ব্যাগ সঙ্গে রাখুন। কিছু ব্যাগ পাওয়া যায় যেটি কোমরে রাখা যায়।
চার্জার
মোবাইল ও ল্যাপটপের চার্জার নিতে ভুলবেন না। পাওয়ার ব্যাংক হলে সবচেয়ে ভালো হয়। রুমের বাইরে যাবার সময় পাওয়ার ব্যাংকটি সঙ্গে নিতে পারেন। ছবি তোলার ক্ষেত্রে মোবাইলের চার্জ অনেক বেশি খরচ হয়। তাই পাওয়ার ব্যাংক সঙ্গে রাখা নিরাপদ।
ইয়ারফোন
ভ্রমণের সময় কাটানোর জন্য ইয়ারফোন বা এমপিথ্রি প্লেয়ার সঙ্গে নিতে পারেন। ছোট মাপের কোনো স্পিকার সঙ্গে নিতে পারেন। এতে করে গ্রুপের সবাই একসঙ্গে গান শুনতে পারবেন এবং একটি ভালো আড্ডা জমে উঠবে।
ঢাকা থেকে নাটোর যাবেন যেভাবে:
ঢাকা থেকে পাবনা যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি উপায় রয়েছে। আপনার পছন্দ, সুবিধা এবং বাজেট অনুযায়ী যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন।
বাস
ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর বাস টার্মিনাল থেকে নাটোরের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন অনেকগুলেঅ বাস ছেড়ে যায়। হানিফ, শ্যামলী, একতা ট্রান্সপোর্ট, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, দেশ ট্রাভেলসসহ বিভিন্ন পরিবহনের নন-এসি, এসি বাস সার্ভিস পাবেন। সহজ ডট কমের মাধ্যমে অনলাইনে পেয়ে যাবেন বিভিন্ন বাসের টিকিট। টিকিট কাটতে এখানে ক্লিক করুন। এছাড়া বাসের নিজস্ব ওয়েবসাইটে গিয়েও টিকিট কাটতে পারেন।
ট্রেন
ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে উত্তরবঙ্গের উদ্দেশে প্রতিদিন অনেকগুলো আন্তঃনগর ট্রেন ছেড়ে যায়। ঢাকা থেকে নাটোর যেতে আব্দুলপুর/ আজিমনগর (গোপালপুর) / ঈশ্বরদী যে কোনো সুবিধামতো নামতে পারেন। ট্রেনের টিকিট কাটতে এখানে ক্লিক করুন।
ব্যক্তিগত গাড়ি
ব্যক্তিগত গাড়িতে ঢাকা থেকে নাটোর যেতে পারেন। এই রুটে আপনার নিজের গাড়িতে যাতায়াত অনেক স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে।
যে পদ্ধতিতেই যান না কেন, পাবনা পৌঁছানোর পর স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেই আপনি আপনার পছন্দের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন।
যেখানে থাকবেন:
নাটোরে রাত্রিযাপনের জন্য বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে—
হোটেল ভিআইপি
ঠিকানা: বড় হরিষপুর, নাটোর
মোবাইল: ০১৭১৮৬৭৩৭৩৫
নাটোর বোর্ডিং
ঠিকানা: নিচাবাজার, হাসপাতাল সড়ক, নাটোর
ফোন: ০৭৭১-৬২০০১
হোটেল রাজ
ঠিকানা: মাদ্রাসা মোড়, নাটোর সদর, নাটোর
মোবাইল: ০১৭২৭৩৭১৫০০
হোটেল প্রিন্স
ঠিকানা: রেলওয়ে স্টেশন বাজার, নাটোর
মোবাইল: ০১৭৪৬০২৯৪২৯
হোটেল রুখসানা
ঠিকানা: কানাইখালী, পুরান বাসস্ট্যান্ড,
মোবাইল: ০১৭৩৯৯৮৭০১৭
নিউ নয়ন হোটেল
ঠিকানা: স্টেশন বাজার, রেলগেট, নাটোর
মোবাইল: ০১৭১৩-৮৬০৭২২
হোটেল মিল্লাত
ঠিকানা: মাদ্রাসা মোড়, নাটোর সদর, নাটোর
মোবাইল: ০১৭২২-৭২৫৫৩০
নাটোর জেলার বিখ্যাত খাবার
নাটোরের বিভিন্ন মানের খাবার হোটেল/রেস্টুরেন্টে প্রয়োজনীয় খাবার খেতে পারবেন। কম খরচে খাওয়ার জন্য ইসলামিয়া পঁচুর হোটেল ও রেলস্টেশনের কাছে নয়ন হোটেলের খাবারের বেশ সুনাম রয়েছে। এছাড়া নাটোর ভ্রমনকালে চলনবিল এবং রানী ভবানী সুস্বাদু মাছ খাওয়ার সুযোগ মিস করা মোটেও ঠিক হবে না। সেই সাথে নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা খেয়ে নিয়েও আসতে পারেন।
সতর্কতা:
ইট-পাথরের শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে ভ্রমণের জন্য আকুল থাকে মন। তবে একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে ভ্রমণ হয়ে উঠবে আরো আনন্দময়। ভ্রমণে যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে—
পরিকল্পিত ভ্রমণ
পরিকল্পিতভাবে ভ্রমণ করলে যাত্রা আরামদায়ক ও নিরাপদ হয়। যদি বাস বা ট্রেনের টিকিট বুকিং করার সুযোগ থাকে, তাহলে মাঝামাঝি আসন নিন। রাতের বেলায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে জানালার পাশে বা বাসের খুব পেছনের আসন এড়িয়ে চলাই ভালো
নির্ভরযোগ্য যানবাহন ব্যবহার
নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার জন্য নির্ভরযোগ্য বাস বা যানবাহন বেছে নিন। সরকারি বা স্বীকৃত পরিবহন সংস্থার যানবাহন ব্যবহার করুন। বাস বা গাড়ির রুট ও সময়সূচি সম্পর্কে আগেই জেনে নিন। অ্যাপ-ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং পরিষেবা (যেমন উবার, পাঠাও) ব্যবহার করলে গাড়ির তথ্য যাচাই করুন।
নিজের অবস্থান গোপন রাখুন
বর্তমান যুগে অনেকেই নিজের দৈনন্দিন কার্যকলাপ এবং ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেন। যারা সন্ধ্যার পর বা রাতে ভ্রমণ করেন তাদের জন্য এটি ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। অপরিচিতদের সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করবেন না। যদি সম্ভব হয়, যাত্রাপথের লাইভ লোকেশন পরিবার বা বন্ধুকে শেয়ার করুন।
চারপাশ পর্যবেক্ষণ করুন
অপরিচিত বা সন্দেহজনক ব্যক্তির সঙ্গে অতিরিক্ত কথা বলা বা ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা এড়িয়ে চলুন। ব্যস্ত থাকলেও মোবাইলে পুরোপুরি মনোযোগ দেবেন না, চারপাশের পরিস্থিতি লক্ষ্য রাখুন। সন্দেহজনক কিছু দেখলে বা অনুভব করলে বাসচালক বা সহযাত্রীদের জানান।
ভিড় এড়িয়ে চলুন
খুব বেশি ভিড় থাকলে বা সন্দেহজনক পরিস্থিতি দেখলে সেই যানবাহনে না ওঠাই ভালো। গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র যেমন মানিব্যাগ, ফোন বা ব্যাগ নিজের কাছেই রাখুন।
আত্মরক্ষায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে রাখুন
প্রয়োজনে আত্মরক্ষার জন্য ছোটখাটো সরঞ্জাম (যেমন: পেপার স্প্রে, হুইসল, ফোল্ডিং মেটাল সেফটি রড, ইত্যাদি ) সঙ্গে রাখতে পারেন। ফোনের ব্যাটারি ও মোবাইল ডাটা চালু রাখুন, যাতে প্রয়োজনে সাহায্য চাইতে পারেন।
জরুরি নম্বর সংরক্ষণ করুন
স্থানীয় পুলিশ, বাস সার্ভিস হেল্পলাইন ও পরিচিতজনের নম্বর সহজেই পাওয়া যায় এমন জায়গায় রাখুন। বিপদের সময় ৯৯৯ (বাংলাদেশের জরুরি সেবা) তে কল করুন।
যাত্রাপথে অপরিচিত ব্যক্তির দেওয়া কিছু খাবেন না
যাত্রাকালে অনেক যাত্রী পার্শ্ববর্তী যাত্রীকে ভদ্রতার খাতিরে বা বন্ধুসুলভভাবে খাদ্য-পানীয় গ্রহণে অনুরোধ করেন। যাত্রীর ছদ্মবেশে অনেক সময় মলম পার্টির লোকেরা খাবারে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে দেয়। এই খাবার গ্রহণের পর যাত্রীরা অচেতন হয়ে পড়লে তারা সর্বস্ব লুটে নেয়। এধরণের পরিস্থিতিতে ঝুঁকি এড়াতে অপরিচিত ব্যক্তির দেয়া কিছু না খাওয়া নিরাপদ।
মোবাইল ফোন নিরাপদে রাখুন
অনেকেই বাসে বা গণপরিবহনে যাত্রাকালে মোবাইল ফোন বের করে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রলিং করেন। এ ধরনের অভ্যাস ছিনতাইয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে জানালার পাশে বসলে খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল ফোন বের না করে নিরাপদ। সম্ভব হলে, যাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফোন বের না করে, নিরাপদে পকেটে বা ব্যাগে রাখুন।