- নাবিলা বুশরা #
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ হচ্ছে শহীর মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে নিহত হয়েছিল রফিক, শফিক বরকতসহ অনেকে। এসব শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে দেশের প্রায় প্রতিটি স্থানে একটা শহীর মিনার রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে এই স্তম্ভ নির্মিত হয়, যা বর্তমানে ‘শহীদ মিনার’ নামে পরিচিত।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, মানুষ নিজেকে প্রাণী জগৎ থেকে আলাদা করেছে ভাষা দিয়ে। কোনো সুগঠিত ভাষা না থাকলে বন্য প্রাণী থেকে মানুষকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়তো। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার দাবিতে গুটিকতক জাতিগোষ্ঠীর ছোটখাটো আন্দোলনের কথা শোনা গেলেই বাঙালির মতো সুগঠিত আন্দোলন এবং ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার মহাকাব্যের ইতিহাস কোনো জাতির নেই।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুটা ভাষা আন্দোলন থেকেই। ১৯৫২ সালের তীব্র আন্দোলন হতে বাঙালি নিজেকে পাকিস্তান থেকে পৃথক ভাবতে শুরু করে। ১৯১৮ সালে ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারত উপমহাদেশে দেশের ভাষা কি হবে তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে আলোচনা সভা হয়। রবীন্দ্রনাথ হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। সভার মাঝেই মহাকবির প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করেন ভাষা গবেষক ডঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ।
ডঃ শহিদুল্লাহ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন হিন্দি-উর্দু থেকে বাঙলা ভাষার স্থান অনেক উঁচুতে। বাঙলা ভাষায় অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা থেকে সুগঠিত। হিন্দু-উর্দু থেকে বাঙলায় শব্দ সংখ্যা বেশি, তাই মনের ভাব সুন্দরভাবে প্রকাশ করা যায়। সভায় ডঃ শহিদুল্লাহ’র বক্তব্যে হইচই পড়ে যায়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে পাকিস্তানিরা প্রথম দিন থেকেই বাঙালিদের নানা কিছুতে বঞ্চিত করে আসছিল। মনের ক্ষোভ প্রকাশের প্রধান হাতিয়ার ভাষা, পাকিস্তানিরা প্রথম দিন থেকে সেই ভাষা ছিনিয়ে নিতে চাইলো। তাই বাঙালি সুসংবদ্ধ হতে থাকে এবং তারই প্রেক্ষাপটে এক সময় জন্ম হয় ভাষা আন্দোলনের।
১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষার দাবী আদায়ের লক্ষে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাঙলা না উর্দু’ শিরোনামে প্রথম পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। বাঙলার কিছু মানুষ চাইতো এদেশের রাষ্ট্রভাষা হোক উর্দু। এতে উর্দু যারা ভালো জানে তারা লাভবান হবে, চাকরিতে সুবিধা পাবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাষার দাবী পক্ষে আদায়ের কথা বলার দুটি কারন ছিল। প্রথমটি ভাষা প্রেম।
দ্বিতীয়টি উর্দু না জানলে তাদের উচ্চ পড়াশুনা সব বিফলে। তাই ভাষার জন্য আন্দোলন করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ ছিল না। দুটানা অবস্থার মাঝে ১৯৪৭ সালের ১২ ডিসেম্বর এই বাঙলার বুকে বাঙলা এবং উর্দু সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষ হয়, আহত হয় বিশ জন।
১৯৪৮ সালে ১৪ নভেম্বর প্রকাশ করা হয় ভাষা আন্দোলনের প্রথম মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক। আন্দোলনের মাঝে দিন-রাত চলতে থাকে। এমন সময় ১৯৪৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রস্তাব করা হয় আরবি হরফে বাঙলা লেখার জন্য। যা ছিল বাঙলা ভাষার জন্য চূড়ান্ত অপমান এবং একটি ভাষা ধ্বংসের বিচক্ষণ পক্রিয়া। দিন চলতে থাকে জুলুমের মধ্য দিয়ে।
১৯৪৮ সালের পর থেকে, প্রতিটি ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসাবে পালন করা হয়। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ ভাষা দিবস পালনের সময় প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই শ্লোগানে প্ল্যাকার্ড এবং পতাকা তৈরি করা হয়। ভাষার দাবী আদায়ের জন্য ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ হরতাল, ধর্মঘট, মিছিল, সমাবেশ, ১৪৪ ধারা সব লেগেই ছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতেও ১৪৪ ধারা ছিল। তাই আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়।
কারফিউ বা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি আসতে থাকে। আলোচনার শেষ রাতে ভোটে সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না। আন্দোলনে প্রথম সাড়ি নেতাদের পনের ভোটের মাঝে এগারো ভোট ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি কোন মিছিল-সমাবেশ করার বিপক্ষে। তবুও ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, ৮ ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্যাম্পাসে একত্র হতে থাকে। বেলা এগারোটায় সভা হয়।
সভার মাঝেই বক্তাদের বক্তব্যে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি চলতে থাকে। সব শেষে ভাষা মতিনের জোরালো বক্তব্যে আগুণ ছড়িয়ে পড়ে। স্লোগান উঠতে থাকতে ১৪৪ ধারা ভাঙার। তীব্র শ্লোগানে নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙার। চারপাশে পুলিশ, তাই ছোট দল করে ক্যম্পাস থেকে বের হবার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এর মাঝেই পুলিশ কাঁদানো গ্যাস ছুড়তে থাকে।
বিকাল তিনটায় আইন পরিষদের সভা ছিল। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আইন পরিষদের দিকে যেতে থাকে। পুলিশ ছাত্রদের উপর লাঠি চার্জ চালায়। ছাত্ররা ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। একসময় পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মাঝে পুলিশ গুলি চালায়। শহীদ হয় কয়েকজন, আহত হয় ১৭জন।
শহীদ মিনারে ইতিহাস
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ২১ ও ২২ তারিখের ভাষার দাবীতে শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার নির্মানের কাজ শুরু করে। কাজ শেষে হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে। মিনারটি তৈরি হয় মেডিকেল ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারক) বার নম্বার শেডের পূর্ব প্রান্তে। কোণাকুনিভাবে হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তার গা-ঘোঁষে। উদ্দেশ্য বাইরে রাস্তা থেকে যেন সহজেই চোখে পড়ে এবং যে কোনো শেড থেকে বেরিয়ে এসে ভেতরের লম্বা ডানা রাস্তাতে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে।
শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচ্চ ও ৬ ফুট চওড়া। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত), ডিজাইন করেছিলেন বদরুল আলম। সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। তাদের সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রি।
ঐ দিনই অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে, ২২ ফেব্রুয়ারির শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারটি ইদ্বোধন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। উদ্বোধনের দিন অর্থৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিকেলের ছাত্র হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে।
প্রথম নির্মিত শহীদ মিনারটি এভাবে ভেঙ্গে ফেললেও পাকিস্তানি শাসকরা শহীদের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে নি বাংলার মানুষের মন থেকে। সারা দেশে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুরূপ ছোট ছোট অসংখ্য শহীদ মিনার গড়ে ওঠে এবং ১৯৫৩ সাল থেকে দেশের ছাত্র-যুবসমাজ একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে।
মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদ মিনারের শূন্য স্থানটিতে লাল কাগজে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের অবিকল প্রতিকৃতি স্থাপন করে এবং তা কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সেই প্রতীকী শহীদ মিনার থেকেই সে বছর ছাত্রদের প্রথম প্রভাতফেরি পালন করেন।
পূর্ববঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম ১৯৫৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেসময়ই একুশে ফেব্রুয়ারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এরপর ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আমলে শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী মেডিকেল হোস্টল প্রাঙ্গণের একাংশে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। শিল্পীর পরিকল্পনায় ছিল অনেকখানি জায়গা নিয়ে বেশ বড় আয়তনের শহীদ মিনার কমল্পেক্স নির্মাণ করার।
কিন্তু ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর শহীদ মিনার তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তা সত্তেও ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত চার বছর একুশে ফেব্রয়ারিতে মানুষ এই অসম্পূর্ণ শহীদ মিনারেই ফুল দিয়েছে, সভা করেছে ও শপথ নিয়েছে।
১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আজম খানের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী মূল নকশা বহুলাংশে পরিবর্তন করে এবং পরিকল্পিত স্থাপত্যের বিস্তর অঙ্গহানি ঘটিয়ে একটি নকশা দাঁড় করানো হয়। এই নকশা অনুযায়ী দ্রুত শহীদ মিনারের কাজ শেষ করা হয় এবং ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রয়ারি এ মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকবাহিনী মিনারটি আবার ভেঙ্গে দেয় এবং সেখানে ‘মসজিদ’ কথাটি লিখে রাখে। কিন্তু এদেশের মানুষ তা গ্রহণ করে নি। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদ মিনার নতুন করে তৈরির উদ্দোগ নেওয়া হয়। এবারও মূল নকশা পরিহার করে ১৯৬৩ সালের নকশার ভিত্তিতেই দ্রুত কাজ শেষ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নতুন নকশা অনুমোদিত হলেও তা আর বাস্তবায়িত হয় নি।
এরপর ১৯৮৩ সালে মিনারচত্বরের কিছুটা বিস্তার ঘটিয়ে শহীদ মিনারটিকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। বর্তমানের শহীদ মিনার তার স্থাপত্য-ভাস্কর্যগত অসম্পূর্ণতা নিয়েই সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অনেক গৌরব আর ঐতিহ্যের বর্তমান এই শহীদ মিনার।