লেখকঃ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
অনেকের কাছে আবার ভরসার জায়গা বিদেশ। আমার মতো মধ্যবিত্তের জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুর, কখনো বা ভুটান বা মালদ্বীপ। কিন্তু খুঁজে দেখলে দেশেই কিন্তু অসম্ভব সুন্দর কিছু স্থান রয়েছে। এই জায়গাগুলোর খোঁজ পেলে আপনি আর বিদেশে ঘুরতে যেতে চাইবেন না। আমার মতে তেমন একটি নাম অরুনিমা ইকো এবং গলফ রিসোর্ট।
নামটা আমি অনেক শুনছিলাম পর্যটন খাতের বন্ধুদের মুখে। সবাই বলছিল এটি এক নিভৃত নিসর্গ। নিজে যখন গেলাম, তখন মনে হয়েছে, না এরা কিছুটা কমই বলেছে! কোলাহল, ব্যস্ততায় বিরক্ত হয়ে কিছুটা সময় দূরে, নিভৃতে প্রকৃতির কাছাকাছি কাটাতে কার না ইচ্ছে হয়! আমি সবসময় খুঁজে ফিরি এমন কোন জায়গা, যেখানে যেতে পারলে শরীরের ক্লান্তি জুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু যেতে চাইলেই তো যাওয়া হয় না। খরচ, সময় আর বিদেশ হলে ভিসা জটিলতা, সবই মাথায় রাখতে হয়। যাদের আমার মতো পকেটের অবস্থা, আর নিরবে, নিভৃতে কিছু সময় কাটানোর ইচ্ছা তাদের জন্য পাখি আর সবুজ দেখার উপায় অরুনিমা। এখানে নাগালের মধ্যেই অপরুপ সৌন্দর্য দেখার অভিজ্ঞতা পাবেন। এখানে আপনি শান্ত প্রকৃতির মাঝে একাকিত্বের স্বাদ নিতে বা পরিবারের সাথে কিছুটা নতুন করে সময় কাটাতে চলে যেতে পারেন। জল, প্রকৃতি, পাখি, কৃষির সাথে মাঝে এক-দুই দিন কাটিয়ে নিতে গোপালগঞ্জ থেকে সামান্য দূরে এই রিসোর্টটির জুড়ি মেলা ভার।
প্রকৃতিকে যারা ভালবাসেন, তাদের প্রিয় স্থানের তালিকায় নড়াইলের এই অরুনিমার নাম কবে উঠবে কে জানে? তবে আমার উঠেছে। এখানে নগরের আওয়াজ নেই, কিন্তু পাখির কাকলি আছে। যারা পাখি দেখতে ভালবাসেন, তারা ডিসেম্বরে গেলে এক অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। ডিসেম্বরে এখানে পাখির কারণে গাছের কোন পাতা দৃশ্যমান থাকে না, অজস্র পাখি মুহূর্তে মুহূর্তে আকাশের চিত্র বদলে দেয়।
নড়াইলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরী হওয়া অরুনিমা ইকো এবং গলফ রিসোর্টে পৌঁছেই চমৎকৃত হলাম। রিসোর্টের কর্ণধার খবিরউদ্দিন অহমেদ জলাশয়ের ধারে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। তিনি ঘুরে ঘুরে দেখালেন রিসোর্টটি। অপার নৈঃশব্দ আর অগাধ সৌন্দর্যের পশরা সাজিয়ে যেন বসে আছে জায়গাটি। ঘন বৃক্ষরাজি ঘেরা জলাশয় আর রিসোর্টের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পরিযায়ী পাখির দল। হাওয়ার পরশে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে জলে। জলাশয়ের গভীরতায় মনের সুখে খেলা করে রুই, কাতলা, কালবোস, গ্র্যাসকার্প, বাঁশপাতি, মাগুর, শোল ইত্যাদি মাছ। এছাড়া ফলানো হয়েছে নানান সবজি ও ফল-ফুলের গাছ। আম, জাম, কুল, পেয়ারা, বেদানা, কমলালেবু, সবেদা, আঙুর, লিচু, নাশপাতি, বাতাবি লেবু ইত্যাদি ফলগাছের পাশাপাশি কুমড়ো, লাউ, বিন্স, করলা, টমেটো, মটরশুঁটি, পালংশাক, ধনেশাক, ঢ্যাঁড়স, মুলো, বেগুন প্রভৃতি শাকসব্জির চাষও হয়েছে পুরো এলাকা জুড়ে। দারুচিনি, তেজপাতার গাছও দেখতে পেলাম কিছু।
রিসোর্টটি মূলত কৃষিভিত্তিক। বাংলাদেশে প্রকৃতিভিত্তিক রিসোর্টের কথা বিবেচনা করলে এই রিসোর্টটিকে প্রথম স্থানে জায়গা করে দিতে হবে। এটি দেশের একমাত্র কৃষি, নদী, খেলাধুলা এবং পরিবেশভিত্তিক রিসোর্ট।
অরুনিমা রিসোর্টটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালের ১৪ মে। ৫০ একর জমি নিয়ে এর অবস্থান। ছোট-বড় মোট ১৯টি পুকুর আছে এখানে। একটি বড় লেক আছে। এর মাঝে একটি কৃত্রিম দ্বীপ আছে। দ্বীপের মধ্যে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, কটেজ ও কনফারেন্স রুম। খবিরউদ্দিন আহমেদ শুধুমাত্র পর্যটনের প্রতি ভালবাসা থেকে নিজের পৈত্রিক ভিটায় এই রিসোর্টটি গড়েছেন।
রাত্রিযাপনের জন্য এস এম সুলতান হল, রয়েল কজেটসহ বেশ কিছু ভাসমান কটেজ রয়েছে। আর সময় কাটানোর জন্য আছে গলফ, টেনিস, টেবিল টেনিস, দাবা, লুডু, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেট বল খেলার ব্যবস্থা। আছে কয়েক প্রকারের নৌকা, ঘোড়ার গাড়ীও। মাছ ধরা যাদের শখ, তারা রিসোর্টের ভেতরে পুকুর ও লেকের পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ পাবেন। বসে যেতে পারেন বড়শি দিয়ে।
প্রথম যখন অরুনিমাতে পানিতে ভাসমান কটেজগুলো দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল আমি যেন প্রাকৃতিক ভেনিস দেখছি। পুকুর, লেকের পাড়ে নানা গাছ। বাঁধা আছে ছোট্ট ডিঙি নৌকা। লেকে নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে দুপুরে ফিরে আসা অব্দি কত পাখি দেখা যায়, আর জলের বিশালতা কিভাবে উপভোগ করা, তা আসলে শুধু যে গিয়েছে সে-ই ভাবতে পারে। যারা যাননি, তাদের বলছি মুগ্ধতার চূড়ান্ত অধিকারটুকু সহজেই কেড়ে নেবে অরুনিমা। আমি বেশ টের পাই – ঋণী হয়ে পড়েছি আমার ছোট্ট ছুটি কাটানো অপরুপ এই স্থানটির কাছে।