পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
বাংলাদেশের একেক অঞ্চলে আছে বিশেষ বিশেষ খাবার, যে খাবারগুলোর সঙ্গে এক হয়ে গেছে সেই অঞ্চলের নাম। বৃহত্তর সিলেটেও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবার আছে। এসব খাবার ভীষণ জনপ্রিয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- সাতকরা দিয়ে তৈরি মাংস, চুঙ্গাপিঠা, হিদলের শিরা ও ভর্তা, আখনী, সাত রঙা চা ইত্যাদি।
সাতকরা
অঞ্চলভিত্তিক রান্নায় সিলেটের সাতকরা (হাতকরা) অন্যতম। মাছ-মাংসের তরকারিতেও এর ব্যবহার হয়। এ ছাড়া রয়েছে সাতকরার খাট্টা বা টক। সাতকরা দিয়ে তৈরি মাংসের বিভিন্ন আইটেমের জন্য সিলেট বেশ বিখ্যাত। তবে সিলেটের রসনাবিলাসের শীর্ষে আছে সাতকরা দিয়ে রান্না করা গরুর মাংস ভুনা। সাতকরা দিয়ে রান্না করা গরুর মাংস কেবল সিলেটে নয়, সিলেটের বাইরেও সমান জনপ্রিয়। সাতকরা দিয়ে গরুর মাংসের কথা শুনলে অনেকেরই জিভে জল চলে আসে।
সাতকরা একটি লেবু জাতীয় ফল। টক-মিষ্টি স্বাদের ফলটি ঘ্রাণেও অনন্য। সাতকরায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। শুধু গরুর মাংসই নয়, বড়মাছ দিয়েও সাতকরা রান্না করা হয়। সিলেটের বেশির ভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁয় সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস পাওয়া যায়। এছাড়া যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি ও ব্যবসার জন্য বসবাসরত সিলেটিরা কাঁচা অথবা রোদে শুকিয়ে সাতকরা নিয়ে যান প্রবাসে। বর্তমানে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সাতকরা চাষ হচ্ছে।
জনশ্রুতি আছে, সাতকরার জন্ম ভারতের আসামে। সেখান থেকে সিলেটে প্রবেশ এবং স্থানীয়দের খাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে বহু আগেই।
সাতকরায় গরুর মাংস ভুনা রেসিপি
সিলেটে প্রায় সব প্রকার মাংস রান্নাতেই সাতকরা ব্যবহার করা হয়। তবে সঠিকভাবে রান্না করতে না জানলে এর আসল স্বাদ পাওয়া যাবে না। আসুন জেনে নিই- সাতকরায় গরুর মাংস ভুনার রেসিপি।
উপকরণ: হাড়সহ ১ কেজি গরুর মাংসের সাথে মাঝারি আকারের একটি সাতকরার চার ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করা জুতসই হবে। সাতকরা কেটে ভেতরে বুকের অংশ বাদ দিয়ে মাংসের আকৃতির সঙ্গে মিল রেখে টুকরা টুকরা করতে হবে। পেঁয়াজ কুঁচি ১ কাপ, পেঁয়াজবাটা ১ কাপ, রসুনবাটা ১ টেবিল চামচ, আদা আধা টেবিল চামচ, পাঁচফোড়ন ও জিরা গুঁড়া ১ চা-চামচ করে, হলুদের গুঁড়া আধা চা-চামচ, মরিচ গুঁড়া দেড় চা-চামচ, গোলমরিচের গুঁড়া আধা চা-চামচ ও তেল-লবণ পরিমাণ মতো।
প্রণালি: মাংস পরিষ্কার করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার মাংসে মসলা মিশিয়ে সেদ্ধ করতে হবে। সেদ্ধ হলে নামিয়ে অন্য এক পাত্রে তেল গরম কওে পেঁয়াজ কুচি লাল করে ভাজতে হবে। সঙ্গে বাটা পেঁয়াজও কষাতে হবে। কষানো মসলায় সেদ্ধ করা মাংস ঢেলে প্রায় ১০ মিনিট অল্প আঁচে ভুনতে হবে। ভুনা হলে পরে টুকরা সাতকরা দিয়ে আরও কিছুক্ষণ কষিয়ে দেড় কাপ পরিমাণ পানি দিতে হবে। এতে সাতকরা সেদ্ধ হয়ে পানি শুকিয়ে গেলে রান্না শেষ।
মনে রাখবেন, রান্নার আগে সাতকরা সেদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। সেদ্ধ করলে এর স্বাদ আর ঘ্রাণ থাকে না। আকারে গোল আর হালকা ওজনের সাতকরা সবচেয়ে সুস্বাদু।
চুঙ্গাপিঠা
প্রাচীন ঐতিহ্য সিলেটের পিঠে-পুলির অন্যতম চুঙ্গাপিঠা বা চুঙ্গাপুড়া। খড়ের আগুনে বাঁশের ভেতর আতপ চালের গুঁড়ি সেদ্ধ হয়ে তৈরি হয় লম্বাটে সাদা পিঠা। চুঙ্গার ভেতরে তৈরি বলে এর নাম চুঙ্গাপিঠা। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে শীত মৌসুমে ভাপা, পুলি আর মালপোয়া পিঠার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিঠা উৎসব মাতালেও এর দেখা পাওয়া এখন দুষ্কর।
এক সময় বাড়িতে জামাই এলে এই চুঙ্গাপিঠার সঙ্গে হালকা মসলায় ভাজা মাছ, নারকেল, কুমড়ার মিঠা বা রিসা পরিবেশন করা ছিল রেওয়াজ। রাতভর চলত চুঙ্গাপুড়ার কাজ। গিট্টু (ভাঁজ) মেপে ছোট ছোট করে কাটা বাঁশের ওপর জ্বলত খড়ের আগুন। কালের পরিক্রমায় সেই পিঠা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। পৌষ ও মাঘের শীতের রাতে বৃহত্তর সিলেটের গ্রামে গ্রামে চুঙ্গাপিঠা তৈরির ধুম পড়ে। আগে চুঙ্গাপিঠা তৈরির সময় সঙ্গে থাকত গান, পুথিপাঠ, কবিতা আবৃত্তি, কৌতুকসহ বিভিন্ন পরিবেশনা। এখন এসব পরিবেশনা না থাকলেও রয়েছে শীতের রাতে খড়ের আগুনে চুঙ্গাপিঠা তৈরির প্রচলন।
ঐতিহ্যবাহী এই পিঠা বানাতে ঢলু নামে যে বিশেষ প্রজাতির বাঁশ দরকার হয়, তা বিলুপ্ত হতে বসেছে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন আর পাহাড় উজাড়ের কারণে ঢলু বাঁশ এখন সহজে পাওয়াই মুশকিল। শীতকালে কালেভদ্রে দেখা মেলে ঢলু বাঁশের। এ বাঁশে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে বলে সহজে আগুনে পোড়ে না। ক্রমাগত তৈলাক্ত তরল নিঃসরণ করে টিকে থাকে সরু বাঁশের সবুজ শরীর। এমনকি কয়েক ঘণ্টা আগুনে পোড়ার পরও সবুজই থাকে ঢলু বাঁশ। কিন্তু আগুনের ভাপে চোঙ্গার ভেতরে ঠিকই তৈরি হয়ে যায় চুঙ্গাপিঠা।
আখনি
বাংলাদেশের চাটগাঁও ও সিলেট অঞ্চলসমূহের একটি জনপ্রিয় প্রচলিত খাবার আখনি। চাল, ঘি, গরম মশলা, সবজি এবং মাংস মিশিয়ে রান্না করা এই খাবারটি একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে সুপরিচিত। চাল দিয়ে তৈরি এই খাবারটির উৎপত্তি
হয় পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মাধ্যমে। এটি প্রায়ই বিরিয়ানি বা পোলাওয়ের একটি বিশেষ প্রকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে এটিকে আখনি বিরিয়ানি এবং আখনি পোলাও নামে ডাকা হয়। এই খাদ্যের পদটি সারা বাংলাদেশজুড়ে, একই সাথে বিদেশি বাংলাদেশিদের মধ্যেও জনপ্রিয়।
এছাড়া হিদলের শিরা ও ভর্তা খুব জনপ্রিয় সিলেট। হিদল বা সিদল এক জাতের মাছের শুটকি। এই শুটকি সিলেটিরা বিভিন্নভাবে রান্না করে থাকে। এর মধ্যে শিরা ও ভর্তা অন্যতম।
সাত রঙের চা
এটি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত চা। দেশজুড়ে রয়েছে সাত রঙা চায়ের খ্যাতি। বিখ্যাত চায়ের দোকান ‘নীলকণ্ঠ টি কেবিনে’ এই চা পাওয়া যায়। সিলেটে এই চা-কে ‘রেইনবো টি’ বলা হয়। এই চায়ের উদ্ভাবক রমেশ রাম গৌড়।
এই চায়ের রয়েছে অন্য রকম স্বাদ, যা সাধারণ চায়ের মতো না। এক কাপে সাত রঙের চা; এ যেন আকাশের রংধনুর মতোই বর্ণিল, এক এক স্তরে থাকে আলাদা আলাদা স্বাদ। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, একটি স্তর অপরটির সাথে মেশে না। চা-প্রেমীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন সাত রঙা চায়ের স্বাদ নিতে।
শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে এই চা পান করেননি, এমন মানুষ খুব কম রয়েছে। মানুষ শখের বসে এই চা পান করে থাকেন। অনেকে শুধুমাত্র এখানে আসেন সাত রঙের চায়ের স্বাদ নিতে।
এই চায়ের কিছু বিশেষ উপকরণ রয়েছে। সেগুলো হলো তিন ধরনের চা পাতা, দারুচিনি, ঘনীভূত দুধ, লেবু এবং লবঙ্গ। মিষ্টি স্বাদ থেকে শুরু করে ঝাঁঝালো লবঙ্গসহ সাতটি স্তরে থাকে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। ওপরের স্তরটি দারুচিনি এবং নিচের স্তরটি লেবুর স্বাদ। এর পরের স্তরগুলোতে ঘনীভূত দুধের সাথে কালো চা থাকে এবং নিচের স্তরগুলোতে মিষ্টি, লবঙ্গসহ শরবত সবুজ চা এবং বিভিন্ন ধরনের মসলা থাকে।