পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
নস্টালজিক বা ইমোশনাল ট্যুরের অংশ হিসেবে এবারও পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২৮ জনের একটি দল বাংলাদেশ ঘুরে গেল। এদের মধ্যে অধিকাংশ নারী-পুরুষের বয়স ৫০ এর ওপরে। কারোর বয়স ৮০ পার হয়েছে। তবে দুজন ছিলেন তরুণ প্রজন্মের। রিভার অ্যান্ড গ্রিন ট্যুরসের আয়োজনে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি তারা বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন। টানা ১৪ দিন বাংলাদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি, ছেউরিয়ায় লালনের মাজার, বরিশালে চারণ কবি মুকুন্দ দাস ও কবি জীবনান্দ দাশের বসতভিটা, নারায়ণগঞ্জের পানাম সিটি, সোনারগাঁওয়ের ফোকলোর জাদুঘর, রুপগঞ্জের রূপসী জামদানি গ্রাম, মুরাপাড়া জমিদার বাড়ি, ক্রুজে শীতলক্ষ্যা ভ্রমণ, পুরান ঢাকায় ঢাকেশ^রী মন্দির, বাবা লোকনাথ আশ্রম, আহসান মঞ্জিল, শাখারী পট্টি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কার্জন হল, মধু দা’র ক্যান্টিন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজার, জাতীয় জাদুঘর, চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম আশ্রম, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বাড়ি, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক ও সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
বাংলাদেশের যোগসূত্রে ভারতে অনেক বরেণ্য বাঙালি রয়েছেন। তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। কবিগুরু দুই বাংলায় সমানভাবে জনপ্রিয়। কলকাতার এই পর্যটক দলটি প্রিয় কবির স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি ঘুরে দেখেন। কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র ও দুর্লভ কিছু ছবি দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন।
তারা মরমি কবি সাধক লালন ফকির লালন বা সাঁইঝির আখড়াতেও যান। সেখানে এই বাউল সাধকের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা ঘুরে দেখার পাশাপাশি ফকিরদের গান বাজনা শুনেন।
বরিশালে চারণ কবি মুকুন্দ দাস ও কবি জীবনান্দ দাশের বসতভিটা ঘুরে দেখেন। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখে ১৭ জানুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করেন। বাপ-দাদার নস্টালজিক বাংলাদেশে ঘুরতে এসে তাদের কেমন অনুভূতি হয়েছে সেসব অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন পর্যটন বিচিত্রার কাছে।
রূপদত্তা চৌধুরী। বয়স ২৫। লেখাপড়া শেষ করে ফ্রিল্যান্স ব্যবসা করছেন। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় তার বাড়ি। তরুণ প্রজন্মের এই নারী এর আগেও বাংলাদেশে এসেছিলেন। মায়ের সঙ্গে এবারও পূর্ব পুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছেন। বাংলাদেশ ঘুরে কেমন লেগেছে সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তিনি।
রূপদত্তা জানান, দি¦তীয় বারের মতো তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। এর আগে ২০০৮ সালে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। তিনি থিয়েটার করেন। ঢাকা নাট্যোৎসবে এসেছিলাম। ওই উৎসবে তাদেরকে পারফর্ম করার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। তবে সেবার ঘুরতে পারেননি বলে আফসোস করেন তিনি। এজন্য এবার শুধু ঘুরতে বাংলাদেশে এসেছেন। পুরো বাংলাদেশ ঘুরে দেখার ইচ্ছা তার।
বাংলাদেশে এসে কেমন লাগছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব জায়গায় ঘুরতে গেলে একটা স্বাভাবিক অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন। কারণ বাংলাদেশের সাথে একটা অন্যরকম সেন্টিমেন্ট জুড়ে থাকে। যেমন- আমরা গল্প শুনেছি, আমার দাদুর বাড়ি বরিশাল ছিল। দাদির বাড়ি ঢাকা ছিল। তারা স্কুল পাস করে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। এখন সেখানে (বরিশাল) যেতে পেরে, সেখানকার মানুষ দেখে, দাদা কোন স্কুল কলেজে লেখাপড়া করেছেন সেটা দেখে খুব ভালো লেগেছে।
শেকড়ের টানে দাদার স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় যাওয়ার অনুভূতি প্রসঙ্গে রূপদত্তা বলেন, দাদুর জন্মস্থানে গিয়ে দাদুর কথা মনে পড়েছে। দাদু সব সময় বরিশাল নিয়ে গল্প করতেন। বরিশাল নিয়ে তিনি খুব গর্ব করতেন। বরিশালের লোকজন অনেক সংস্কৃতিমনা ও শিক্ষিত- এসব বিষয় দাদুর অনেক গল্পে প্রকাশ পেত। এটা এসে স্বচক্ষে দেখলাম। এরপর মুকুন্দ দাসের কালীবাড়িতে গিয়েছি। তার এই জায়গা ইতিহাসে পরিপূর্ণ, সেটা দেখে অসাধারণ লেগেছে।
এছাড়া জীবনান্দ দাশের কবিতা আমাদের পাথেয়। যারা আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে লেখাপড়া করি, জীবনের প্রতিটি ঘাতপ্রতিঘাত বা যে কোনো সময় উনার লেখা বা কবিতায় বার বার উঠে আসে। আমরা তাকে সব সময় স্মরণ করি। উনার বসতভিটায় গিয়েছি। তবে লাইব্রেরিটা দেখতে পাইনি। তবে তার বসতভিটা যদি আরেকটু সংরক্ষণ করা যেত তাহলে ভালো হতো। তবে বাংলাদেশে এসে যে তার বসতবাড়ি দেখতে পেরেছি তাতেই অনেক ভালো লেগেছে। তবে এই দেশের মানুষের যে আন্তরিকতা, কখনো মনে হয়নি- অন্য কোনো দেশে এসেছি। মনে হয় নিজের মানুষের কাছেই এসেছি।
তিনি আরও বলেন, কলকাতায় আমাদের প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা, যাদের পূর্বপুরুষরা এক সময় বাংলাদেশে ছিলেন, তারা এই দেশে আসার ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী। সবাই সপরিবারে আসতে চায়। আমাদের প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়ে, যাদের শেকড় বাংলাদেশে, তারা তাদের পূর্বপুরুষর কোথা থেকে এসেছে, সে বিষয়ে তারা খুব সচেতন। আমাদের শেকড়ের টানটা বাংলাদেশে, সেখানে বার বার আসার চেষ্টা করি।
বিশ^কপি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এই তরুণী বলেন, কুষ্টিয়ার শিলাইদহের গল্প অনেক শুনেছি। উনার লেখা ও চিঠিপত্রে শিলাইদহ, পদ্মাবোটের নাম বার বার উঠে এসেছে। সেসব জায়গা চাক্ষুষ দেখার সময় গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে যে মিউজিয়ামটি হয়েছে, সেটা খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। খুব দুর্লভ কিছু ছবি আছে যা আমি আগে দেখিনি। সেই ছবিগুলো এখানে এসে দেখে ভীষণ ভালো লেগেছে।
লালনের আখড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা লালনগীতি গেয়ে থাকি। তার দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করে থাকি। তার যে জীবনকথা সেগুলো আমরা পড়াশোনা করেছি। তিনি যেখানে বেড়ে উঠেছেন, তার সেই জায়গা দেখে খুব ভালো লাগল। তার স্মৃতিবিজড়িত জায়গটা যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে তা দেখেও খুব ভালো লাগল। ওখানে ফকিরদের মুখে গান শুনে আরও ভালো লেগেছে।
রূপদত্তা বলেন, লালন ও রবীন্দ্রনাথের দর্শন কোথাও গিয়ে এক হয়ে গেছে। দুজনই মানবতাবাদের কথা বলেছেন। দুজনই এক জায়গার। একজন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে অন্যজন ছেউরিয়ায়। দুটি জায়গা এক সাথে দেখতে পেরে খুবই সেন্টিমেন্টাল লাগছে।
ঢাকা ডিনার ক্রুজে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কলকাতার এই তরুণী বলেন, আজকে আমার মনটা ভীষণ খুশি। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ- এটা আমরা পড়েছি। আর এখন স্বচক্ষে দেখছি এবং অনুভব করছি। আতিথেয়তা ও আন্তরিকতার কোনো তুলনা হয় না বাংলাদেশের মানুষের। কয়েক মিনিটের আলাপেই এখানকার মানুষ যেভাবে আমাদের আপন করে নিয়েছে, তা অকল্পনীয়।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রজন্মের যেসব তরুণ-তরুণীর পূর্বপুরুষদের শেকড় বাংলাদেশে ছিল তাদের বিষয়ে রূপদত্তা বলেন, আমাদের প্রজন্মের কারোর শেকড় হয় তো খুলনায়, কারো বরিশাল বা ফরিদপুর। সুতরাং আমাদের প্রজন্মের লোকজন তারা বার বার বাংলাদেশে আসতে চায়। তারা দেখতে চায় তাদের পূর্বপুরুষরা কোথায় ছিলেন।তার দাদু কোন স্কুলে পড়তেন, কোন গ্রামে থাকতেন। সমগ্র বাংলাদেশ তারা ঘুরতে চায়।
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ পর্যটন ব্যবস্থা যত উন্নত হবে, বাংলার বাইরেও দিল্লি, গুজরাট, চেন্নাই, বেঙ্গালুরেু যত শহর আছে সেসব জায়গা থেকে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে বাংলাদেশের প্রতি।
‘তারা আমার কাছে জানতে চেয়েছে- বাংলাদেশটা কেমন? বাংলাদেশটা তাদের স্বচক্ষে দেখার খুব ইচ্ছা। তারা কিন্তু বাংলাদেশে আসতে চাইছে। এজন্য পর্যটন ব্যবস্থা উন্নত হতে থাকবে সেখানকার লোকজনও আসতে থাকবে। সেই সাথে বাংলাদেশের খুব উন্নতি হবে’, বলেন রূপদত্তা।
পশ্চিমবঙ্গের তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশ ভ্রমণে আহŸান জানিয়ে এই পর্যটক বলেন, আসুন বাংলাদেশ ঘুরে যান। মানুষের আন্তরিকতা কেমন সেটা এদেশে একবার এলেই বুঝতে পারবেন।
পদ্মার ইলিশের স্বাদ কেমন লাগল- জানতে চাওয়া মাত্রই রূপদত্তার উত্তর, অসাধারণ! অসাধারণ!! অপূর্ব!!! পদ্মার ইলিশের এত এত গল্প শুনেছি। আজ খেলাম। অসাধারণ। এরপর ক্রুজের ডেকে দাঁড়িয়ে সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠেন- ‘তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে…’।
এই ক্রুজেই কথা হয় কলকাতার আরেক প্রবীণ পর্যটক ইতি ঘোষের সাথে। তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার নাকতলায়। বয়স ৮৫। এই বৃদ্ধ বয়সেও শুধুমাত্র মনের জোরে পূর্বপুরুষদের বাংলাদেশ দেখতে এসেছেন।
ইতি ঘোষ বলেন, আমি বাংলা ভাষা বলতে পারি। আমার বাপ-দাদারা সবাই বাংলা বলতেন। এখনো কাকারা বাংলা বলেন। বাংলাদেশে এসে আপনাদের সবচেয়ে যে জিনিসটা ভালো লেগেছে সেটা হলো আপনাদের আতিথেয়তা। মনে হচ্ছে আমার নিজের কোনো জায়গায় এসেছি। কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করতে সংকোচ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমি ১০ বছর আগে একবার এসেছিলাম। নাড়ির টানে আবার এসেছি। বাবা-দাদা থেকে শুরু করে আমার পূর্বপুরুষরা সব বাংলাদেশে ছিলেন। আমার বাবার জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশে আসার। তিনি বাংলাদেশে আসার জন্য কাঁদতেন। কিন্তু তখন পারিনি। যখন বাংলাদেশ হলো, তখন বাবার শক্তি ছিল না।
এই প্রবীণ পর্যটক বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি গিয়েছি, লালনের আখড়ায় গিয়েছি। ভীষণ ভালো লেগেছে। আমরা নেচেছি, গেয়েছি। নারায়ণগঞ্জের পানাম সিটি, পুরান ঢাকায় ঢাকেশরী মন্দির, আহসান মঞ্জিল, চটেশরী কালী মন্দির, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বাড়ি, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক ঘুরে দেখেছি।
এই বয়সে তো চলাফেরা করাই কষ্টকর। বাংলাদেশ ভ্রমণের সাহস করলেন কীভাবে- জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে ফেলেন ইতি ঘোষ। বলেন, সব সময় বাবার কথা মনে হয়। বাবার দেশ, বাবার দেশ। বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল এখানে আসার, আসতে পারে নাই।
তিনি আরও বলেন, বাবার কাছে বাংলাদেশে এত এত গল্প শুনেছি যে, সেগুলো এখনো চোখের সামনে ভাসে। কোন গাছটা কোথায়, পুকুর পাড়ে কোন গাছ বাবা মুখস্ত বলে দিতে পারতেন। বাবা ভীষণ করে চাইতেন এখানে আসার জন্য।
‘তবে আমরা যেমন টানে আসি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আসবে কিনা বলতে পারি না। তারা হয় তো বাংলাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসে। তবে টানে আসা আর ফাংশনে আসা এক নয়। আমি চাই- পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে পূর্বপুরুষদের বাংলাদেশ দেখার জন্য তাদের মধ্যে টান তৈরি হোক।
দুদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা আরও সহজ করার দাবি জানিয়ে ইতি ঘোষ বলেন, আমার ভীষণ ইচ্ছা- দুদেশের যাতায়াতটা আরও সহজ হয়ে যাক। সীমান্তে অনেক ঝামেলা, সেটা না করে সাধারণভাবে অনুমতি দিলেই হয়। যেমন কোনো অনুষ্ঠান হলে যেভাবে আমরা নেপাল বা ভুটানে চলে যাই।
শীতলক্ষ্যায় জাহাজে ভ্রমণ কেমন লেগেছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনাদের আতিথেয়তা অনেক ভালো লেগেছে। আপনাদের খাবারদাবার অনেক ভালো।
বাংলাদেশে আবার আসার ইচ্ছা আছে কিনা- জিজ্ঞাসা করতেই এক গাল হেসে ইতি ঘোষ বলেন, বয়স পারমিট করবে কিনা জানি না!
বিজয় চক্রবর্তী, তারও বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। সাবেক এই ব্যাংক কর্মকর্তা থাকেন কলকাতায়। তার পূর্বপুরুষরা তৎকালীন কিশোরগঞ্জ উপবিভাগের ময়মসিংহ জেলার বাসিন্দা ছিলেন। দেশভাগের আগে তার বাবা চাকরি পেয়ে কলকাতা চলে যান। প্রথম বারের মতো স্ত্রীসহ বাংলাদেশে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।
পড়ন্ত বিকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসী জামদানি গ্রামে আলাপ হয় বিজয় চক্রবর্তীর সাথে। তিনি বলেন, আমরা বাবার কাছ থেকেই বাংলাদেশের গল্প শুনেছি। দাদা বাংলাদেশেই ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাননি। তিনি এখানেই মারা গেছেন। আমার বাবা ১৯৫২ সালে (পাকিস্তান আমল) ভিসা করে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরপর আমি প্রায় ৭০ বছর পর বাংলাদেশে আসলাম। এটা আমার জন্য নস্টালজিক বা ইমোশনাল ট্যুর।
পূর্বপুরুষের দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এই পর্যটক বলেন, বাংলাদেশের অনেক জায়গায় গিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি ও জীবনান্দ দাশের জন্মস্থানে গিয়ে আমার সমস্ত শরীরে যেন কাঁটা দিয়েছে। ডিনার ক্রুজে নদীর বুকে চড়ে বাংলাদেশকে দেখছি- এটা অন্যরকম অনুভূতি। সারা জীবন মনে থাকবে। এছাড়া পানাম সিটি, ঢাকেশ^রী মন্দির, আহসান মঞ্জিল, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক ঘুরে অন্যরকম অনুভূতি হয়েছে।
বাংলাদেশের খাবারদাবার খুবই অসাধারণ লেগেছে। তবে পদ্মার ইলিশের স্বাদের কথা কী বলব! ফ্যান্টাসটিক অ্যান্ড ক্লাসিক!
সুযোগ পেলে আবার বাংলাদেশে আসবেন বলেও জানালেন বিজয় চক্রবর্তী। এমনকি তার ছেলেও সুযোগ পেলে আসবে।
শেকড়ের টানে বাংলাদেশে আসা আরেক নারী পর্যটক হলেন ইন্দ্রানী দাস। তার বাসাও কলকাতায়।
এই নারী বলেন, অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল, একবার বাংলাদেশে যাব। কারণ আমার বাবা ও দাদার জন্ম বাংলাদেশে। তাদের কাছে অনেক গল্প শুনেছি, কিন্তু বাংলাদেশ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এজন্য বাংলাদেশকে দেখার মনের ইচ্ছা অনেক ধরে ছিল। যখন বাংলাদেশে আসার সুযোগ তখন আর লোভ সামলাতে পারলাম না, চলে এলাম।
ইন্দ্রানী দাস বলেন, প্রথমে আমরা কুষ্টিয়াতে গিয়েছিলাম। লালনের মাজারটা খুব ভালো লেগেছে। ফরিকদের গান-বাজনা আমাকে অন্যরকম অনুভূতি দিয়েছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি বইয়ে পড়েছি, কখনো দেখার সুযোগ হয়নি। বাংলাদেশে এসে তার স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি দেখে এতটাই ভালো লেগেছে যে বলে বোঝাতে পারব না। বরিশালের জীবনান্দ দাশের বাড়ি দেখেও খুব ভালো লেগেছে। কবি মুকুন্দ দাশের বসতভিটাও খুব সুন্দর লেগেছে। তাদের বসতভিটা দেখে অভিভূত হয়েছি। এখনো তাদের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে!
এই নারী পর্যটক আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের সবই মিল রয়েছে। অমিল তো খুঁজে পাই না। কারণ আমি যখন বাংলাদেশে প্রথম পা রাখি তখন আমার কাছে মনে হয়নি, আমি আলাদা কোনো জায়গায় এসেছি। তবে বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে।
ঢাকা ডিনার ক্রুজের ভ্রমণটা অসাধারণ ও উপভোগ করার মতো ছিল বলে জানান তিনি। এখানে আয়োজকদের আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করেছে। কোনো কিছুর কমতি ছিল না। তাদের ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো। আসার পর থেকেই তাদের নানা ধরনের আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। আমরা খুবই আনন্দিত।
বাংলাদেশের ইলিশের প্রসঙ্গে ইন্দ্রানী দাস বলেন, সত্যি বলতে কি পদ্মার ইলিশের স্বাদ আলাদা। ডিনার ক্রুজে পদ্মার ইলিশ খাওয়ার স্মৃতি মনে থাকবে সারা জীবন। এজন্য খাওয়ার একদম শেষে ইলিশ খেয়েছি, যাতে স্বাদটা ধরে রাখতে পারি। মোট কথা বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের কোনো তুলনাই হয় না।
ভারতীয় এই নাগরিক বলেন, আমরা আমাদের বাবা-দাদার বাংলাদেশ দেখে গেলাম। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও একই বার্তা দেব- তারাও যেন তাদের পূর্বপুরুষদের বাংলাদেশ একবার ঘুরে দেখে। আমরা আশাবাদী, সুযোগ হলে তারাও বাংলাদেশ দেখতে আসবে।
আবার বাংলাদেশ ভ্রমণের আশা প্রকাশ করে ইন্দ্রানী বলেন, বাংলাদেশের মানুষের এত অ্যাপায়ন এত ভালোবাসা ভুলি কী করে! বাংলাদেশের মানুষজন খুব ভালো। তাই আবার আসতে ইচ্ছে করছে।
রিভার অ্যান্ড গ্রিন ট্যুরসের প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন হেলাল বলেন, ‘চলো বাংলাদেশ’ ভ্রমণ উদ্যোগটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির সাথে বাংলাদেশের যোগসূত্রের সেতুবন্ধনে একটি অনন্য মাধ্যম। যারই ধারাবাহিকতায় দলবেধে ভারতীয় পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণে আসছে। আশা করি, এই উদ্যোগটি যেমন পর্যটকদের কাছে গভীর আগ্রহের গন্তবে পরিণত হয়েছে, তেমনি সকল গন্তব্যর যথাযথ সেবার উন্নয়নের মাধমে ভবিষ্যতে এটি পর্যটকদের কাছে আরও নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা যাবে। সেক্ষেত্রে সরকার নানা উদ্যোগের মাধ্যমে এই নস্টালজিক, ইতিহাস ঐতিহ্যের সংরক্ষণ উদ্যোগের মনোনিবেশ করবে।
তিনি আরও বলেন, এটি শুধু একটি ভ্রমণ উদ্যোগ নয়। ‘চলো বাংলাদেশ’ উদ্যোগটি পর্যটকদের শেকড়ের টানে নস্টালজিক আবেগের আহ্বান।