লেখক: জাকারিয়া মন্ডল – (বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন ও প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা)
গতকাল প্যারাডেনিয়া বোটানিক্যাল গার্ডেনের বিশাল বৃক্ষ সারির ছায়াতেও হুল ফুটিয়েছে গরম। যদিও আজ সকালে ক্যান্ডির আকাশে ঝিরঝির বৃষ্টি একটা সহনীয় দিনের আভাস দিয়েছিল। কিন্তু দিনের দ্বিতীয় প্রহরেই সেই স্বস্তি উধাও। শ্রীলংকার আকাশে ফের সূর্যতেজের বেয়াড়া দাপট। তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। এমন উচ্চমাত্রার তাপমাত্রা কমতে কমতে শিগগিরই যে ১০ ডিগ্রির কাঁপুনি ধরাবে তা বুঝতে কয়েক ঘণ্টার বেশি লাগেনি।
এখন মার্চ মাস। এ সময়টায় ২৫ থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে ওঠানামা করে শ্রীলংকার তাপমাত্রা। যদিও এইটকেন স্পেন্সের ট্যুরিস্ট বাসটার ভেতরে আরামদায়ক শীতলতা। হাতের বাঁয়ে মহাবেলি। শ্রীলংকা দীর্ঘতম নদী। ক্যান্ডি ছাড়ার পর থেকেই সমান্তরালে রাস্তার সঙ্গী। তবে ট্যুরিস্ট বাসটা ছুটছে দক্ষিণে। আর মহাবেলি বইছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে।
গামপেলা শহরে সেতু পার হয়ে মহাবেলির সঙ্গ ছাড়লো ট্যুরিস্ট বাস। ক্রমশ আরও উঁচু হতে থাকলো রাস্তা। দুপাশের পাহাড়গুলো সবুজে ছাওয়া। গাছপালার ফাঁকে কোথাওবা অনেক নিচে শুয়ে থাকা উপত্যকা। প্রতিটি উপত্যকায় ধানের চাষ। কোথাও সবুজ। কোথাওবা হলুদ বর্ণ নিয়ে পেকে যাওয়ার আভাস ছড়াচ্ছে।
গাড়িটা হঠাৎ বাঁক নিয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে অনেকটা খাড়া উঠতে থাকে। পাহাড়ি রাস্তার ওপর আরেকটা পাহাড়। তার ওপর এক চিলতে সমতল চত্বর। একপাশে তিনতলা সমান উঁচু লম্বাটে এক টিনের কাঠামো। চা কোম্পানির কারখানা।
খাড়া মই বেয়ে উঠে ওপর থেকেই শুরু হয় পরিদর্শন। কাঁচাপাতার আদ্রতা কমানো, কাঁচা পাতা থেকে শুকনো গুঁড়োয় পরিণতি, আরও মিহি করে প্রক্রিয়াজাতকরণের উপযোগী করে মোড়কজাত- সব মিলিয়ে অনেকগুলো ধাপ। দেখতে দেখতে ওপর থেকে নিচে নামা। বের হওয়ার মুখে ছোট্ট একটা জাদুঘরের মতো। সেখানে গেøনলচের অর্গানিক বাগানগুলোর ম্যাপের পাশাপাশি চা বাগান ও ফ্যাক্টরির যন্ত্রপাতি, শ্রীলংকান চায়ের ইতিহাস, এমনকি চায়ের গুণাগুণের সচিত্র প্রতিবেদন।
কারখানার অদূরে সেলস সেন্টার। কতো যে মোড়ক। কতো যে ফ্লেভার। দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায়। পাশের বারান্দায় নমুনা চা পানের আয়োজন। ঠিক নিচেই মূল রাস্তাটাকে এখান থেকে একটু সরুই লাগে। রাস্তার ওপাশে খাড়া নেমে গেছে পাহাড়টা। ওখানে গাছপালা আচ্ছাদিত উপত্যকা। তার ওপাশের খাড়া পর্বতটা যেনো আকাশ ছুঁতে চাইছে।
পৃথিবীখ্যাত সিলন চায়ের ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে আরও দর্শনার্থী এসেছে। অনেকেই উপভোগ করছেন তাজা চা। সেরা চা যারা খোঁজেন তাদের জন্য এই ফ্যাক্টরি নিঃসন্দেহে অতি উত্তম ঠিকানা। এখানকার গোল্ডেন টি পৃথিবীর অন্যতম সেরা চা হিসেবে স্বীকৃত। অতি স্বচ্ছ, সুস্বাদু, সুবাসিত। মৌসুমি এই চায়ের চাষ হয় অল্প সময়ে। উৎপাদনও সীমিত। তাই দামও বেজায় চড়া। এর প্রক্রিয়াজাতকরণ ফর্মুলা খুবই গোপন। নিজেদের কারখানারও সবাইকে জানতে দেয় না গেøনলচ। একবার চুমুক দিলে এই চায়ের স্বাদ ভুলে যাওয়া মুশকিলই বটে।
এই দেশের চা উৎপাদক হিসেবে পরিচিত সাতটি প্রদেশের প্রতিটিতেই রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, স্বাদ, সুগন্ধের চা। মোটামুটি এক ঋতুর দেশ হলেও এই দ্বীপে বছরের অন্তত অর্ধেক সময় মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় উত্তর থেকে। বছরের বাকি অর্ধেক দক্ষিণ থেকে। পরস্পর বিপরীত গন্তব্যের দুই মৌসুমি বায়ু শ্রীলংকার চায়ের বৈচিত্র্যে অন্যতম অবদান রাখে। এমনকি এ দেশের একটি প্রদেশের ভেতরেই অঞ্চলভেদে চায়ের স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন হয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার ফুট উচ্চতায় যেমন চা হয়, তেমনি শীতল শহর নুয়ারা এলিয়ার পাহাড়ের ঢালে চা জন্মে ৬ হাজার ফুটেরও অধিক ওপরে।
গেøনলচ চা ফ্যাক্টরির পর রাস্তার একদিকে খাড়া পাহাড়, অন্যদিকে গভীর গিরিখাদ, উপত্যকার খাড়া ঢাল। ওই খাড়া ঢালেই ঝুলে আছে ওক রে টি বুশ নামের রেস্তোরাঁ। কাঁচঘেরা রেস্তোরাঁয় বসে মধ্যাহ্নভোজের সময়টাতেও সঙ্গী হয়ে রইলো অপরূপ পাহাড়ি সৌন্দর্য। মাথার ওপর তখনও সমানে তেজ ছড়িয়ে যাচ্ছে সূর্য।
উপত্যকার অপর পাশের খাড়া পাহাড়ের ঢালে ফসল ক্ষেত। বাংলাদেশের মতো জুম চাষ এদিকটায় চোখে পড়লো না। এসব পাহাড়ে চাষ হচ্ছে হিমালয়ের মতো ধাপ পদ্ধতিতে।
পর্বতশ্রেণি বেষ্টিত সবুজ উপত্যকায় গাছপালার ফাঁকে কোটমালে রিজার্ভার। রামবোদা প্রপাতের পানি লম্বা খাল হয়ে এসে জমা হচ্ছে ওখানটায়।
মধ্যপ্রদেশের পুসেলাবার এই অঞ্চলটার নাম রামবোদা। এটি মূলত একটি গ্রাম। এখানকার সবকিছুর নামে এই রামবোদা জুড়ে দেওয়ার চল। রামবোদা প্রপাত, রামবোদা হোটেল, রামবোদা টানেল।
২২৫ মিটার দীর্ঘ রামবোদা রোড টানেল শ্রীলংকার রাস্তায় নির্মিত দীর্ঘতম সুড়ঙ্গ। পাহাড়ের পেট কেটে হাইওয়েটাকে এগিয়ে নেওয়া হয়েছে ওপাশে। তারপর বাঁক ঘুরতেই বাঁয়ে রামবোদা প্রপাত এলাকা। এদিকটায় বিস্ময়কর উচ্চভূমি, সমতল, শৈলশিরা, পর্বত শ্রেণির অভূতপূর্ব সম্মিলন। ১০৯ মিটার উঁচু থেকে আছড়ে পড়া রামবোদা প্রপাতের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য মনের ভেতর ঘোর ধরিয়ে দেয়। লাগোয়া বনে দুর্লভ পাখির কুজন প্রকৃতির সুরে বেধে নেয় পর্যটককে।
রামবোদা এলাকাটাই সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় এক কিলোমিটারের কাছাকাছি উঁচু। সামনের পথ ক্রমে আরও উঁচু হচ্ছে। পাহাড়ের শরীর জড়িয়ে রাস্তা। আঁকাবাঁকা। একটু পরপর ট্যুরিস্ট লজ। ছিমছাম শহর। ইন্টারনেটে শ্রীলংকা সার্চ দিলে সবুজ পাহাড় পেঁচিয়ে ওটা অপরূপ যে রাস্তাটা দেখা যায়, এটা সেই রাস্তা। একটা পিচঢালা ফিতা যেনো পাহাড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠেছে।
রাস্তার পাশে খাড়া নেমে গেছে পাহাড়ের ঢাল। সবুজ উপত্যকার ওপাশের পাহাড়গুলো চা গাছে ছাওয়া। পাহাড়ি চা বাগানে রোদ-ছায়ার অপরূপ খেলা।
পড়ন্ত বিকালে ট্যুরিস্ট বাস প্রবেশ করে নুয়ারা এলিয়ায়। মধ্যপ্রদেশের এই জেলা শ্রীলংকার অন্যতম ট্যুরিস্ট জোন। এর সদর দপ্তর দেশের শীতলতম পার্বত্য শহর হিসেবে পরিচিত। শ্রীলংকার সবচেয়ে বড় পর্বতশ্রেণি পিদুরুতালাগালার কোলে গড়ে ওঠা নুয়ারা এলিয়া ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উঁচুতে। জেলার প্রশাসনিক রাজধানীর নামও নুয়ারা এলিয়া।
পাহাড়ের উপরে এক চিলতে সমতলে গড়ে উঠেছে বলে এই শহরটাকে বলা হয় টেবিল ল্যান্ড। এ জনপদের আর এক নাম আলোর শহর। যদিও এখানকার প্রস্তরলিপি হাজার বছর আগের সভ্যতার পরিচয়বাহী। কিন্তু, উনিশ শতকে নুয়ারা এলিয়ার নতুন যাত্রা শুরু হয় ইংরেজদের হাত ধরে। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নীল নদের অনুসন্ধানকারী স্যামুয়েল বেকার এ শহর প্রতিষ্ঠা করেন। শীতল জলবায়ুর কারণে এই শহর শ্রীলংকায় ব্রিটিশ বেসামরিক কর্মচারীদের পছন্দের স্থানে পরিণত হয়। এ স্থানের নাম হয়ে যায় লিটল ইংল্যান্ড। হয়ে ওঠে ইংরেজদের হাতি, হরিণ, শেয়াল শিকারের গ্রাউন্ড। গড়ে ওঠে গলফ, পোলো, রেসকোর্স, ক্রিকেট মাঠ।
যদিও শহর হিসেবে নুয়ারা এলিয়ার নবযাত্রা শুরু হয় আরও আগে। ড. জন ডেভি নামে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা হাতি শিকার করতেন এখানে। অনেকটা শখের বশেই হাতি শিকার প্রতিযোগিতা আয়োজন শুরু করেন তিনি। ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীলংকার পঞ্চম গভর্নর হয়ে আসেন এডওয়ার্ড বার্ন। জন ডেভির হাতি শিকার প্রতিযোগিতার কথা শোনেন তিনি। চমৎকার আবহাওয়ার কথা শোনেন। নুয়ারা এলিয়ায় আসেন। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে এখানে নির্মাণ করেন অবকাশ কেন্দ্র। নাম রাখেন বার্নস হল।
১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার সময় অবকাশ কেন্দ্রটির দায়িত্ব পান ডেভিড ইউলমট হর্টন। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রেজিনাল্ড বুচাম্প ডাউনাল নামে এক পরিকল্পনাবিদ বার্নস হল কিনে নিয়ে পরিণত করেন গেস্ট হাউসে। আরও ৫০ বছর পর ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে সেটি কিনে নেয় নুয়ারা এলিয়া হোটেল কোম্পানি। বার্নস হল পরিচিত হয়ে ওঠে গ্র্যান্ড হোটেল নামে।
শেষ বিকালের নরম আলোয় ট্যুরিস্ট বাস থামে গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে। গাড়ি থেকে নামতেই শুরু হলো শিরশিরে বাতাসের শীতল কামড়। সামনে বড় বড় গাছপালায় ছাওয়া অভিজাত ব্রিটিশ কাঠামো। পুরো আয়োজনে বাসাবাড়ির ছাপ। দোতলায় ওঠার জন্য পালিশ করা কাঠের সিঁড়ি। পাশের একটা কক্ষে এই হোটেলে অতিথি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের ছবি টানানো। তাদের ভেতরে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন, মার্শাল টিটো, থমাস লিপটন, রানি প্রথম এলিজাবেথ।
ভেতরের বার হলটাকে এখনো আগের মতোই রাখা হয়েছে। প্রধান রেস্তোরাঁর নাম এখনও বার্নস হলই আছে। পুরো হলের সাজসজ্জাতে ঐতিহ্য ও বনেদিয়ানার ছাপ। আধা শেড আধা উন্মুক্ত হোটেল লবিতে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ। পাহাড়ি শহরে ইতিহাস ও সংস্কৃতির মোড়কে বসবাসের নেশায় শৌখিন পর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে।
গোটা শহর গ্র্যান্ড হোটেলের মতো ব্রিটিশ স্থাপত্যের ছড়াছড়ি। হিল ক্লাব, টাউন হল, সেন্ট অ্যান্ড্রুজ হোটেল।
১৩ বর্গকিলোমিটারের এই পৌরশহরে জনসংখ্যা হাজার তিরিশেক। তার মানে জনবহুল শহর। কোনো নির্দিষ্ট ঋতু নেই। একটি বর্ষার মতো মেঘলা ঋতু আছে কেবল। রাতে তাপমাত্রা নেমে যায়। বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে রাতে প্রায়শই দশের নিচে নেমে যায় তাপমাত্রা। এখানে সিংহদিলেরই আধিক্য। তবে শ্রীলংকান তামিল, ভারতীয় তামিল, শ্রীলংকান মুর ও মালয়সহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। শ্রীলংকার আর সব শহরের মতো এখানেও সিংহলি ও তামিল ভাষা প্রচলিত। তবে দীর্ঘ সময় ব্রিটিশদের বসবাস বলে ইংরেজিটা খুব চলে।
সিংহলি ও তামিল নববর্ষের কারণে এপ্রিল এখানকার উৎসবের মাস। এ মাসজুড়ে হয় ব্যান্ড শো প্রতিযোগিতা, মোটর রেসিং, ঘোড়দৌড়, গলফ টুর্নামেন্ট। গ্রেগরি লেকে বোটিং ও মাছধরা এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। ভিক্টোরিয়া পার্কে ভিড় করে পাখিপ্রেমীরা। গ্যালওয়ের ল্যান্ড বার্ড স্যাংচুয়ারি বন্য শুকর ও বার্কিং ডিয়ারসহ শ্রীলংকার অনেক পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণির আবাসস্থল। হর্টন প্লেইন জাতীয় উদ্যানে আছে চিতাবাঘ, সাম্বার। সেখানে শ্রীলংকার দীর্ঘতম নদী মহাবেলির জন্ম। প্রকৃতি ও প্রাণিবৈচিত্র্য উপভোগ করার জন্য সেখানে আরও আছে বেকার জলপ্রপাত। আছে ওয়ার্ল্ডস অ্যান্ড। চূড়া থেকে যেখানে ঝপ করে চার হাজার ফুট নেমে গেছে খাড়া পাহাড়। তার একটু নিচেই আছে এক হাজার ফুট খাড়া মিনি ওয়ার্ল্ডস অ্যান্ড। আকাশ পরিষ্কার থাকলে ৮১ কিলোমিটার দূরের ভারত মহাসাগর ওখান থেকে দিব্যি নজরে আসে।
চা বাগানের ভেতরে লাভার্স লিপ ঝরনাও পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। কোনো এক প্রেমিক যুগল ওখানে আত্মহুতি দিয়েছিল বলেই ঝরনার এমন নাম বলে জনশ্রæতি প্রচলিত। ওই ঝরনাটা তাই যুগলদেরই বেশি টানে।
এমন একটা সুন্দর শহরের সন্ধ্যাটাও সুন্দর। বিকালের চেয়ে শীতটা যদিও বেড়েছে। গতকালও যে দেশে কিছু সময় হাঁটলে জামাকাপড় খুলে ফেলতে মন চাইছিল, সেই একই দেশে এখন সোয়েটার পরেও শীত লাগছে। প্রকৃতির কি অদ্ভুত বদলে যাওয়া!
দিনভর প্রকৃতির সঙ্গ মেখে আসা পর্যটকরা সন্ধ্যার আলোয় শহর দেখতে বেরিয়েছেন। ছোট্ট, ছিমছাম শহরে জটলা কম। হই হট্টগোলও কম। গাড়িগুলো হর্ন ছাড়াই ছুটছে। একটা ক্রিক বয়ে গেছে শহরের মাঝখান চিরে।
কারগিলস গ্রাউন্ডের বিপরীতে স্থানীয় সবজি, ফলের মেলা। বই, খবরের কাগজের স্টল। সন্ধ্যার বাতাসে শীতের কামড় বাড়ছে। স্থানীয় কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসছে এশার আজান। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দোকানপাট। শীত তাড়াতেই বুঝি ওয়াইন শপে শেষ মুহূর্তের ভিড় জমেছে। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নুয়ারা এলিয়া। এই শহর খুব একটা রাত জাগে না।
চার্চ রোডের প্রান্তে একটু উঁচু জায়গায় জেটলিং সেন্ট এন্ড্রুস হোটেল। গ্র্যান্ড হোটেলের মতো অতো পুরোনো না হলেও এই হোটেলটাও প্রায় দেড়শ বছরের স্মৃতি বইছে। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোতে ব্রিটিশ স্থাপত্যের সুনিপুণ শৈলী। ফুলবাগান ও গাছপালা আচ্ছাদিত লনের ঘেরে অপরূপ স্থাপত্য। ছোট্ট লবিতে কাঠের ফায়ারপ্লেসে আগুন জ¦লছে। সেই আগুনের ওম নিয়ে একটু সময় বসে থাকতে খারাপ লাগলো না।
কার্পেট মোড়ানো করিডোরের পাশে সারিবদ্ধ কক্ষ। পেছনের দরজা খুললেই সবুজ লন। এ হোটেলটার পরিবেশ আর ব্যবস্থাপনাতেও বাড়ি বাড়ি ভাব। শ্রীলংকার সবচেয়ে পুরোনো টেবিলটা আছে এই হোটেলে। মোটা কাঁচের বোতলে পানি সাজিয়ে রাখা। নিজস্ব প্ল্যান্টের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করে এরা।
রাতের খাবারের পর আড্ডা হলো অনেকক্ষণ। এরই মধ্যে সোয়েটারের ওপরে চাদর জড়াতে হয়েছে। দরোজার ওপাশে ফুলের বাগান। কাঁচের জানালা গলে হিম ঢুকতে থাকলো এবার। মাঝরাত নাগাদ ১০ ডিগ্রিতে নেমে গেল তামপাত্রা। তারপর দুটো কম্বলেও কাজ হলো না। মনে হলো, কম্বল চুইয়ে হিম ঢুকছে। কম্বলের বাইরে বিছানা-বালিশে আসন পেতেছে শুকনো হিম। গরমের দেশে এসে এ কেমন শীতের কামড়! কলম্বোতে এখন তামপাত্রা এখানকার চেয়ে অন্তত ১৫ ডিগ্রি বেশি। মধ্য প্রদেশেরই ক্যান্ডিতেও এখানকার অন্তত দ্বিগুণ। কিন্তু একই প্রদেশের এই পাহাড়ি শহরে হিম ছড়িয়ে কাবু করে ফেলছে শীত বুড়ি।
শেষতক হিটারটা চালাতেই হলো। এমন শীতের কারণেই এখানকার হোটেল-রিসোর্টগুলো রুম হিটার রাখে। এই বৈদ্যুতিক হিটারের ওমটাই একসময় ঘুমের ঘোর এনে দিলো।
শ্রীলংকার শীতলতম শহরের সকালটাও শীতল। তবে হিম ছড়ানো আলোয় সেন্ট এন্ড্রুস হোটেল। পাশেই চার্চ স্কুল। রেস্তোরাঁর পাশে সবুজ ঘাসে ছাওয়া বাগান। ঘাসের ডগায় এখনো কিছু ঘোলাটে শিশির। রোদের তাড়া খাওয়ার আগে আরও কিছুক্ষণ ঘাসের ডগাতেই বুঝি আসন পেতে থাকবে। বাগানে বসে নাস্তা সারতে সারতে ঘণ্টা বাজে চার্চ স্কুলে। শিক্ষার্থীদের দিন শুরুর কোরাস ভেসে আসে।
ফের পথে গড়ায় ট্যুরিস্ট বাস। এই শহরে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙে সূর্যের। দিনে গড়ে সাড়ে ছ’ঘণ্টা করে কিরণ ছড়ায়। সকাল আটটা নাগাদ পূর্বদিকের পাহাড়সারির মাথায় সূর্যটা জেঁকে বসতে শুরু করলো। শিশির ধোয়া পরিচ্ছন্ন রাজপথে যান চলাচল বাড়ছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটছে গাড়ি। হাতের ডানে পড়ে রইলো গলফ ক্লাব। ওই গলফ মাঠের কোণায় উইলিয়াম রজার্সের সমাধি। পাশের বাদুল্লা জেলার সরকারি এজেন্ট ছিলেন এক সময়। গুলি করার জন্য কুখ্যাতি কুড়িয়েছিলেন তিনি। রজার্স সাহেব অন্তত ১৪শ বন্যহাতির হন্তারক বলে কিংবদন্তি প্রচলিত নুয়ারা এলিয়ায়। স্থানীয়দের মহাপাপের জন্য প্রতিবছর তার সমাধিতে বজ্রপাত হয়। তার সমাধি তাই দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে না। তার সমাধিটা এখনো রাতের শিশিরে ভেজা।
হাতি হন্তারকের অভিশপ্ত সমাধি পড়ে থাকে পেছনে। বাঁয়ে পড়ে থাকে রেসকোর্স ময়দান। তারপর গ্রেগরি পার্ক, গ্রেগরি লেক। পর্যটকদের বিশেষ বিনোদন স্পট।
গরমের দেশের শীতল শহর ছাড়ানোর পর একটু একটু করে বাড়তে থাকে সূর্যের তাপ। নুয়ারা এলিয়াও অবশ্য উঞ্চ হয়ে ওঠে দিনে। তবে যে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়স, সেই দেশেরই এই শীতল শহরের তাপমাত্রা কখনো ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ায় না।