লেখক: এলিজা বিনতে এলাহী (ঐতিহ্য পর্যটক)
মিশরের কায়রো শহরের সাথে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী সেই কিশোর বয়সেই। কায়রো সম্পর্কে লেখা উনার দুটো লাইন খুব দারুণ লেগেছিল ‘যে শহরে মেঘমুক্ত নীল আকাশ দেখা যায় বছরব্যাপী। এ শহর রাতে ঘুমায় না। এখানে বছরে সিকি ভাগও বৃষ্টিপাত হয় না’। ১৯৩৪ সালে কায়রো শহরকে সৈয়দ মুজতবা আলী এভাবেই বর্ণনা করেছেন। আমার ভ্রমণে আমি এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সবগুলোই খুঁজে পেয়েছি। তবে খুঁজে পাইনি ‘দ্য ক্যাফে নীল’ ও ‘কায়রো ক্যাফে’। যে দুটো কফি শপে বসে মুজতবা আলী কায়রো সম্পর্কে লিখেছিলেন।
দুসপ্তাহের পরিভ্রমণ মিশরকে জানবার জন্য, এর রহস্য অনুধাবন করবার জন্য একদমই যথেষ্ট নয়। পুরো গল্প অন্য কোনো দিন হবে। এখন বলছি তিন দিনের নীল নদে ভ্ৰমণ গল্প।
মিশর ভ্রমণে জাহাজে চেপে নীলনদ দেখেনি এমন কাউকেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমিও গেছি। মিশর ভ্রমণে সেটি ছিল সবথেকে চমকপ্রদ বিষয়। জাহাজ যাচ্ছে এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে । বন্দরে নামছি, বিভিন্ন শহর ঘুরছি, স্থাপনা দেখছি, ইতিহাসের সাথে পরিচিত হচ্ছি, নানা ভাবনা প্রশ্ন ভিড় করছে মনে, নীল নদকে দুচোখ ভরে দেখছি। আহা! ভাবতে এখনও শিহরিত হচ্ছি।
কোমল বয়সে, যখন কেবল সাধারণ জ্ঞান চর্চা শুরু হয়, তখন বহুল প্রচলিত একটি লাইনের সাথে আমাদের পরিচয় হয় ‘মিশর নীল নদের দান’। কিছু বুঝে উঠবার আগেই মিশর দেশটির ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে খুলে যায়। জানা-শোনার পরিধি যখন বাড়তে থাকে, তখন ধীরে ধীরে পিরামিড, মমি, প্যাপিরাস, হায়রোগ্লিফিক্স, ওবেলিস্ক, ফারাও রাজাদের নানা কথা-উপকথা, মিশরীয় দেবতারদের কাহিনি মনের কোণে সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন কিংবা পৃথিবীর টাইম লাইনের অতীত-বর্তমান নিয়ে দোলাচল চলতেই থাকে।
তবে আমার ক্ষেত্রে সেই দোলাচল বহুগুন বেড়েছে যখন মিশর ভ্রমণ করেছি। পথ ভুলো পথিকের মতো মিশরীয় সভ্যতার নানা নিদর্শন আজও আমাকে আচ্ছন্ন করে। চিন্তার জগতে দারুণ রেখাপাত করে, ফারাও রাজাদের কাজ-কর্ম, রাজ্য চালাবার ধরণ, তাদের অনবদ্য সৃষ্টি। মিশরীয় সভ্যতার রহস্য পৃথিবীর বড় বড় প্রত্নতত্ত্ব বিশারদ, ইতহাসবিদ ও গবেষকরা আজও ভেদ করতে পারেননি। আমি কোন ছাড়! একবার মিশর ভ্রমণ করে এই মন তৃপ্ত হবার নয়! আমারও হয়নি! নীল নদে আমার জাহাজের নাম ছিল সেমিরামিস সেমিরামিসে চেপে আমি তিন দিনের জন্য নাইল ক্রুজে গিয়েছিলাম আসওয়ান শহর থেকে লুক্সর পর্যন্ত। সেমিরামিস খুব বড় জাহাজ নয়। তিনতলা একটি জাহাজের নীচে রয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষ ও ডাইনিং।
দোতলা তিনতলায় পর্যটকদের থাকার জায়গা, রুফটপে আছে সুইমিং পুল ও কফির পানের স্থান, যেখানে বসে আপনি উপভোগ করতে পারবেন নাইল’র মনোমুগ্ধকর নীল জলরাশি। বিভিন্ন বন্দরে নেমে যা কিছু দেখেছি সব পুঙ্খানুপুঙ্খ আলাপ এই ভ্রমণ রচনায় নেই । কেবল মাত্র আমার দৃষ্টিতে বিশেষ বিশেষ কিছু পর্যটন কেন্দ্র ও জাহাজে যা কিছু চমকিত করেছে সেসব সম্পর্কে লিখছি।
ট্যানোরা ডান্স
আমি প্রথম পরিচিত হই ট্যানোরা নাচের সাথে। জাহাজে একটি কালচারাল ইভিনিংয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে জড়ো হয়েছিল জাহাজের সব অতিথি। একটি রুমে সবাই মিলে অপেক্ষা করছি সন্ধ্যেটা উপভোগ করবার জন্য। আচমকা ২০/২২ বছরের একটি ছেলে এলো দারুণ রঙচঙ্গা একটি পোশাক পরে। পোশাকটি দেখে ট্রাডিশনালই মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার নাচ শুরু হবার আগ পর্যন্ত আমার ধারণাই ছিল না সে কী করতে যাচ্ছে। ইজিপ্সিয়ান নাচের মাঝে সব সময় শুনে এসেছি ব্যালে ডান্সের কথা। ট্যানোরা নাচ দেখবার আগ পর্যন্ত এই ডান্স সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। পার্সিয়ান সুফি কবি জালাল উদ্দিন রুমির নির্দেশে এই আর্ট ফর্ম চালু হয় ১৩০০ শতকে। রুমি ট্যানোরা ডান্স সম্পর্কে বলেছেন ‘Any love is a bridge to divine love and tanora dance is a true bridge to God’.
ট্যানোরা ডান্স সম্পর্কে জেনেছি আমার গাইডের কাছ থেকে আর জাহাজে রাখা টুরিস্ট বুকলেট গুলো থেকে। ট্যানোরা একটি আরবি শব্দ । এর অর্থ কালারফুল স্কার্ট। মজার বিষয় হলো ট্যানোরা ডান্স শুধুমাত্র ছেলেরাই করে। এই নাচের প্রধান উপকরণ এর পোশাক। মানে পোশাকের একটি বিশেষ অংশ। নৃত্যশিল্পীরা ১৫ মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত ক্লক ওয়াইজ ঘুরতে পারে। সাধারণত স্কার্টটিতে তিনটি লেয়ার থাকে। সব লেয়ার মিলে এর ওজন হয় ১৮ থেকে ২০ কেজি। ট্যানোরা ডান্স অনেকটা টার্কিস ন্যাশনাল ডান্স ডার্ভিসের মতো। তবে অনেক পার্থক্য আছে দুটি ডান্সের মাঝে। মূল পার্থক্য হলো ট্যানোরা ডান্স একক পরিবেশনা, ডার্ভিস ডান্স দলগত পরিবেশনা। এই নৃত্যকলাকে রূপক হিসেবে ধরা হয়, পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে ঘুরছে তেমনি এর প্রতিটি ঘূর্ণি সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একজন মানুষের সাথে সৃষ্টিকর্তার যোগাযোগ স্থাপনের অভিপ্রায় থেকেই এই ডান্স ফর্মের সৃষ্টি । It is a prayer and appeal to God. মিশরের নুবিয়ান আদিবাসি যেমনটি বলছিলাম নাইল ক্রুজের কথা, সেমিরামিসের রুফটপ থেকে আমি দেখেছি আসওয়ান শহরের আদিবাসি নুবিয়ানদের ছোট ছোট নৌকায় করে জাহাজের টুরিস্টদের সাথে কেনাবেচা করতে। যে উপায়ে তারা কেনাবেচা করে সেই পদ্ধতিটি অত্যন্ত চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর জাহাজে আমার রুমের জানালা দিয়ে নাইলের জলরাশি দেখছি। সে সময় একটি রঙিন ডিঙি নৌকা একজন বলে বেশ চিৎকার করে বলে উঠলো ‘Hello how are you? Where are you from? ‘আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার জিজ্ঞেস করলো ‘Are you from India’ । ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হকচকিয়ে আমি উত্তর দিলাম ‘I am from Bangladesh’। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হলো না যে, সে বুঝেছে আমি যা বলেছি । সেই দিন বিকেলে যখন জাহাজের ছাদে গেলাম। তখন দেখতে পেলাম জাহাজের চারদিক ঘিরে টুরিস্টরা নীচু হয়ে কি জানি দেখছে। আমি দেখবার জন্য জাহজের কোণায় গিয়ে যেই দাঁড়ালাম, আমার সামনে এসে পড়লো পলথিনে মোড়ানো একটি কাপড়ের টুকরো।
নুবিয়ানদের কেনা বেচার পদ্ধতিটি দারুন। প্ৰথমে তারা নৌকা থেকে দেখাচ্ছে জিনিসটি তারপর কোন টুরিস্টের পছন্দ হলে সেটি পলিথিনে ভরে ছুঁড়ে মারছে জাহাজের ছাদে। কোন টুরিস্ট যদি সেই জিনিসটি পছন্দ করে, তবে টাকা নেবার জন্য আরেকটি পলিথিনে মোড়া প্যাকেট ছুঁড়ে মারে জাহাজে । তারপর টুরিস্টরা টাকাটা সেই পলিথিনে ভরে ছুঁড়ে মারে নৌকায় । নুবিয়ান প্যাকেটটি ধরে ফেলে খুব দক্ষতার সাথে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি চলেছে ২/৩ ঘন্টা কিন্তু একটিই অঘটন ঘটেনি অর্থাৎ কোন প্যাকেটই পানিতে পরে যায়নি । নুবিয়ানদের মনে করা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতি গোষ্ঠীদের অন্যতম একটি গোষ্ঠী। ঈজিপ্সিয়ান কালচারে রয়েছে তাদের বিশেষ অবদান। নুবিয়ানদের বসবাস মূলত আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল, সুদান ও মিশরে। মিশরের ইতিহাসে নুবিয়ানদের উল্লেখ আছে খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ শতক থেকে। আসওয়ান শহরের ফিলাই টেম্পল, আবু সিম্বল টেম্পলসহ আরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টেম্পলগুলো নুবিয়ানদের নিদর্শন বহন করছে মিশরে। আবু সিম্বল আবু সিম্বল আসওয়ান শহরের একটি গ্রাম! এই গ্রাম থেকে সুদানের বর্ডার মাত্র ২০ কিলোমিটার। এই গ্রামের নাম অনুসারে এই টেম্পলের নাম হয় আবু সিম্বল। মিশরের সবথেকে শক্তিশালী রাজা ও ক্ষমতাধর ফারাও রাজা রামেসিসের স্মৃতির উদ্দেশে এটি নির্মিত।
এই মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে ফারাও রাজা রামেসিসের চারটি মূর্তি রয়েছে ২০ মিটার লম্বা, রাজার বিভিন্ন বয়সের। পায়ের নীচের পাটাতনে নুবিয়ান দেব- দেবীর ছবি আঁকা আছে। আবু সিম্বল ছাড়াও লুক্সর মন্দিরে দ্বিতীয় রামেসিসের বেশ কয়েকটি বিশাল মূর্তি আছে। তার শিশু বয়স থেকে রাজত্ব চলাকালীন পর্যন্ত অনেক মূর্তি এবং দেয়ালে দ্বিতীয় রামেসিসের সমস্ত কার্যকলাপের চিত্র অংকিত আছে। অংকিত চিত্রের পাশে হায়ারোগ্লিফিক্সের মাধ্যমে সেগুলো বর্ণনা করা আছে। রামেসিস ছিলেন ১৯তম রাজবংশের তৃতীয় ফারাও। তিনি আনুমানিক ৬৭ বছর মিশর শাসন করেন। রামেসিসের প্রজারা মনে করতো রামেসিসের মৃত্যুর সাথে সাথে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
ফিলাই দ্বীপ, ফিলাই মন্দির আর দেবী আইসিস
আবু সিম্বল ছাড়াও ফিলাই টেম্পল নুবিয়ানদের আর একটি নিদর্শন। আসওয়ান শহরের ফিলাই দ্বীপে এই টেম্পলের অবস্থান। ফিলাই টেম্পলটি দেবী আইসিসের উদ্দেশে নির্মিত। প্রাচীন মিশরের আরোগ্য প্রদানকারী আর জীবন দানকারী দেবী মনে করা হয় আইসিসকে। নীল নদের মাঝখানে এই ফিলাই টেম্পল। আসওয়ান শহর থেকে বোটে করে সেই আইল্যান্ডে যেতে হয়।
ফিলাই দ্বীপে এই টেম্পলটি ছিল না। ১৯৬০ সালে নাসির লেকের পানির নীচে থেকে আবু সিম্বলের মতই বেদী আইসিসের এই টেম্পল ফিলাই দ্বীপে স্থানান্তর করে পুরোপুরি নতুন করে বানানো হয়। ৩০০০ বছরের পুরোনো এই স্থাপনাগুলোকে স্থানান্তর করতে মিশর সরকারকে সহায়তা করে ইউনেস্কো। মিশরে ফিলাই টেম্পলই শেষ টেম্পল যা পেগান বিশ্বাসের নিদর্শন। যেখানে নুবিয়ান ও মিশরীয়রা একসাথে উপাসনা করতো। নীল নদের মাঝ দিয়ে যাওয়া, সেখানে পৌঁছার পর পুরো টেম্পলের গায়ে দেবী আইসিসের বন্দনা আর হায়ারোগ্লিফিক্স দেখে আমি মুক ও বধির। একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি ছবি ও ভিডিও নেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কী দেখবো, কী ক্যামেরায় তুলে আনবো, ভেতরে কতটুকু ধারণ করবো!
হাতশেপসুত মন্দির
মিশরীয় রাজাদের ফারাও বলা হয়। ফারাও রাজাদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় রাজা ছিলেন দ্বিতীয় রামেসিস। দ্বিতীয় রামেসিসের মমি এখনও কায়রো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। প্রতিবছর কোটি কোটি পর্যটক সেই মমি দর্শনে যায়। মিশরীয় সভ্যতার ৩০০০ বছরের ইতিহাসে ১৭০ জন ফারাও রাজার কথা জানা যায়। এর মাঝে নারী শাসক ছিলেন ৭ জন। যদিও সংখ্যাটি গিয়ে গবেষকরা নিশ্চিত নন। ইতিহাসে এই নামগুলো পাওয়া যায়- সোবেকনেফেরু, হাতশেপসুত, নেফারতিতি আখামেননের, আনাক-সু-নামুন, নিতক্রিস, খেনকস প্রথম ও ক্লিওপেট্রা। সময়ের পরিক্রমায় অন্য সবার কথা মুছে গেলেও একজন নারী ফারাওয়ের স্মৃতি আজও মিশরের ভূপৃষ্ঠে বিদ্যমান। তিনি হলেন ফারাও রানী হাতশেপসুত। বিখ্যাত ‘ভ্যালি অব দ্য কিংস’র পাশেই হাতশেপতসুতের মন্দির। ভ্যালি অব দ্য কিংসে- ৬৪ জন ফারাও রাজার সমাধি রয়েছে। সুউচ্চ পর্বত ‘দেইর এল বাহারীর’ নীচেই এই মন্দিরের অবস্থান । ফারাও নারী হাতশেপসুতেরও সমাধি আছে এখানে। সম্ভবত এই মন্দির আরও উল্লেখযোগ্য কারণ এটি একটি নারী শাসকের রাজ্য।
হাতশেপসুত রাজ্য শাসন করতেন পুরুষের বেশে। পুরুষালী বেশভুষা বা নকল দাড়ির জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত হননি, হয়েছেন তার কর্মগুণে। তিনি ছিলেন মিশরের সবচেয়ে সফল শাসকদের একজন, আর অন্যান্য নারী শাসকদের চেয়ে তার রাজত্বকাল ছিল দীর্ঘতর। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে, হাতশেপসুত প্রায় ২২ বছর রাজত্ব করেছেন। সে সময় নতুন নতুন রাজ্যজয়ের পরিবর্তে নিজ রাজ্যকে সমৃদ্ধ করাই ছিল তার লক্ষ্য। অবশ্য সেক্ষেত্রেও তার উল্লেখযোগ্য সফলতা ছিল। রাজকীয় স্থাপত্য, সমাধি, মন্দির তৈরিতেই তার মনোযোগ ছিল বেশি। তিনি অসংখ্য নতুন মন্দির, ভাস্কর্য, ওবেলিস্ক নির্মাণ করেছিলেন।
মিশরজুড়ে ওবেলিস্ক
কেউ যদি আমায় জিজ্ঞেস করে, মিশর ভ্রমণে কোন বিষয়গুলো আমাকে চমকিত করেছে বেশি। না ভেবেই গড় গড় করে ২০টি বিষয়ের কথা বলা যাবে। পিরামিড, মমি, ফারাও রাজাদের সমাধিভূমি, কায়রো মিউজিয়াম, স্ক্যারাব, মিশরীয় অগণিত দেব-দেবী ও তাদের মন্দির, নীল নদ, মিশরীয় রুটি আইস বালাদি, নুবিয়ান জাতি, আফিকার মহাদেশের প্রথম মসজিদ, একমাত্র ফারাও রানী হাতশেপসুত; যিনি পুরুষের বেশে রাজ্য চালাতেন, হায়রোগ্লিফিক্স, প্যাপিরাস, ভূমধ্যসাগর, আলেকজান্দ্রিয়া শহর- সব কিছুই রহস্যময় । মিশর ভ্রমণ করেছি, একথাও আমি সংশয় নিয়ে বলি। আসলে কি মিশর ভ্রমণ সম্ভব ১০/১২ দিনে! আসলে কি মিশরের রহস্য ভেদ করা সম্ভব!
উত্তর না-বোধক হওয়াই উচিত! যাক সে কথা! অনেক প্রাগৈতিহাসিক স্থাপনার মাঝে আমার মন কেড়েছে মিশরের বিভিন্ন শহরের ওবেলিক্সগুলো। ওবেলিস্ক চোখে পড়ে প্রথম মিশরের আসওয়ান শহরে। নীল নদে জাহাজে করে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম জাহজ বিভিন্ন ঘাটে নোঙর করছিল। মন্দিরগুলো দেখতে দেখতে আচমকা চোখে পড়লো লম্বা সরু একটা জিনিস । দেখলে মনে হবে, এখনই আকাশ ফুঁড়ে অসীমে যাবে । তারপর আমার গাইড পরিচয় করিয়ে দিল ওবেলিক্সের সাথে। লুক্সর শহরে অবেলিক্সের সংখ্যা বেশি।
ইতিহাস যতটুকু জেনেছি ওবেলিক্স সম্পর্কে
বেনু নামের এক বিশাল পাখির ডাকে শুরু হয় পৃথিবীর গল্প। মিশরীয়রা যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস করে আসছে এই উপকথা। তাই পৃথিবী শুরুর গল্প যাতে শেষ হয়ে না যায়, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও মন্দিরের ফটকে এক খণ্ড পাথরের গায়ে বিধাতার বন্দনা লিখে রাখতো প্রাচীন মিশরীয় রাজারা। এই স্তম্ভগুলোকে ইতিহাসবিদরা ওবেলিস্ক বলছেন। সহজ করে বলতে গেলে- ওবেলিস্ক হলো উৎসব উদযাপনের স্মৃতিস্তম্ভ যা প্রাচীন মিশর থেকে উদ্ভুত । এটি পিরামিড আকৃতির শীর্ষসহ একটি লম্বা, চার পার্শ্বযুক্ত কাঠামো। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় যাকে বলা হয় তেখেনু । ওবেলিস্ক নামটি এসেছে গ্রিক লেখক হেরোডোটাসের কাছ থেকে, যিনি বর্ণনা করার জন্য প্রাচীন গ্রিক শব্দ ওবেলিস্কোস ব্যবহার করেন; যার অর্থ দাড়ায় ‘পয়েন্টেড পিলার’।
প্রাচীন ওবেলিস্কগুলি ছিল মনোলিথিক কাঠামোর। ওবেলিস্কের আকৃতি প্রাচীন মিশরীয় সূর্যের দেবতা আমুন রা’র সাথে যুক্ত। প্রাচীন ওবেলিক্সগুলো তৈরি হয়েছিল মন্দিরগুলোর প্রবেশ দ্বারের জন্য, যা জোড়ায় স্থাপন করা হতো। চারদিকে হায়রোগ্লিফিক্স অংকিত থাকতো যা আমুন রা এবং সৌধটি নির্মাণকারী শাসকের জন্য উৎসর্গকৃত। খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দে ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর, রোম মিশরের ওপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, মিশরীয় ওবেলিস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে তাদের মূল অবস্থান থেকে সরিয়ে রোমান সাম্রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল । এই কারণেই রোমে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ওবেলিস্কের আবাসস্থল।
গ্রিক ভাষায় অবেলিস্ক অর্থ ‘স্পিট’, যা রান্না করার চামচ। মিশরীয়দের জন্য ‘তেখে’, আকাশ ভেদ করে উঠা এক স্তম্ভ যার শীর্ষ বেশ সরু। ওবেলিস্ক ২০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। মিশরীয়দের অন্যান্য বিশ্বাসের সাথে সাথে তারা বিশ্বাস করে ওবেলিস্ক তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। আগেই বলেছি, তাদের প্রধান দেবতা সূর্য। দেবতা আমুন রা’র বন্দনা লিপিবদ্ধ থাকে ওবেলিস্কগুলোতে। পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতর ওবেলিস্ক নির্মাণ করেন ফারাও রানী হাতশেপসুত, যার উচ্চতা ১৩৭ ফুট, কিন্ত সেটি মাঝখান দিয়ে ভেঙে যাওয়ায় কোথায় স্থাপন করা হয়নি। তবে সেই অসমাপ্ত ওবেলিস্ক আসওয়ান শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান । আসওয়ান শহরের অসমাপ্ত ওবেলিস্কসহ বেশ কিছু ওবেলিস্ক দেখলাম লুক্সর শহরের কার্নাক এবং লুক্সর মন্দিরে।
হেলিওপোলিস ওবেলিস্ক হলো এক জোড়া লাল গ্রানাইট ওবেলিস্ক থেকে অবশিষ্ট একটি স্মৃতিস্তম্ভ যা ফারাও প্রথম সেনুসেট নির্মাণ করেছিলেন, যিনি প্রাচীন মিশরের মধ্যযুগে রাজত্ব করতেন। এটি ৬৭ ফুট লম্বা এবং মিশরে অবস্থিত প্রাচীনতম ওবেলিস্ক । এর অবস্থান কায়রো শহরে । লুক্সও শহরের ওবেলিক্স হলো ৭৫ ফুট উচ্চ গ্রানাইট স্মৃতিস্তম্ভগুলির একটি জোড়া; যা মূলত মিশরের লুক্সর মন্দিরের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এগুলি আনুমানিক ৩০০০ বছর আগে ফারাও রাজা দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্বকালে তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশে একমাত্র ওবেলিস্ক রয়েছে ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে। মূলত এটি স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্মৃতিস্তম্ভটি নবাব আব্দুল গনির নাতি খাজা হাফিজুল্লাহর মৃত্যুর পর ইংরেজ বন্ধুরা চাঁদা তুলে স্মৃতি রক্ষার্থে ১৮৮৪ সালে এই স্মৃতি ফলকটি স্থাপন করে। পৃথিবীর আরও দেশে, যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ফ্রান্স, ইতালি ও ভ্যাটিকান সিটিতে মিশরীয়দের তৈরি ওবেলিস্ক আছে।
ভ্যালি অব দ্য কিংস
মৃত্যুরও পুর্ব ঘোষিত আয়োজন থাকে, সেটি মিশরীয় সভ্যতার ফারাওদের সমাধিগুলো না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সে পদ্ধতি ফারাওরা ভেবেছে খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দে। এই সভ্যতা দেখলে মনে হয় তারা আধুনিক মানুষদের জন্য নতুন কোন ভাবনার খোরাক রেখে যাননি। কারণ, এখনো পুরো বিশ্ব তাদের কাজ নিয়ে গবেষণা করছে। প্রতি বছরই নতুন নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন গবেষকরা। ভ্যালি অব দ্য কিংস আসলে ফারাওদের সমাধি স্থল। রাস্তার দুপাশে পাথরের পর্বত পার হবার সময় পর্বতের মাঝে ছোট ছোট মুখগুলো দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই, সেই গহবরের ভিতর রয়েছে রাজাদের সমাধি। ফারাওদের কোথায় এবং কীভাবে সমাধিস্থ করা হবে তা নিজেরাই ঠিক করতেন।
প্রায় ৬৪টি বিশাল আকৃতির ফারাওদের সমাধি রয়েছে ভ্যালি অব দ্য কিংসে । আমি দেখেছি মাত্র ৪টি। একেকটি সমাধিতে প্রায় ৩৫০টি সিঁড়ি, দেয়ালে আঁকানো রাজা আর দেব-দেবীর ছবি এবং হায়ারোগ্লিফিক্স পার হয়ে তবেই দেখা মিলবে সমাধির । নীল নদের পাড়ের কত শত গল্প তো বলাই হলো না । তিন দিন কি করে ফুরিয়ে গেছে একদমই টের পাইনি!