ভ্রমণপ্রেমীদের মধ্যে একটি প্রশ্ন প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে—‘উড়োজাহাজে বসার সবচেয়ে নিরাপদ আসন কোনটি?’ যদিও আধুনিক বাণিজ্যিক বিমান চলাচল অত্যন্ত নিরাপদ এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা খুবই কম, তবুও অনেকে নিরাপত্তার দিকটি মাথায় রেখে আসন বেছে নিতে চান। বিশেষ করে যাত্রীরা যারা বারবার বিমানে ওঠেন না বা উড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলনামূলক কম, তাদের মধ্যে এই প্রশ্নের আগ্রহ বেশি দেখা যায়।
এই প্রতিবেদনে আমরা তথ্য-উপাত্ত, গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করব কোন আসনগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ বলে বিবেচিত হয় এবং কেন। আমরা বোঝার চেষ্টা করব কোন পরিস্থিতিতে কোন আসনের ঝুঁকি বেশি এবং যাত্রীর জন্য কী কী নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
বর্তমান সময়ে বাণিজ্যিক বিমান চলাচল হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ভ্রমণ মাধ্যমগুলোর একটি। আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা (আইএটিএ) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) এর তথ্যমতে, বাণিজ্যিক বিমানে ভ্রমণের সময় মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারেই নগণ্য—প্রায় ১ কোটির মধ্যে ১টি মাত্র দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিমানগুলোর প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, কঠোর নিয়ম-কানুন, পাইলট ও কেবিন ক্রুদের প্রশিক্ষণ, এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বিমানে ভ্রমণ এখন অত্যন্ত নিরাপদ। তবে যেহেতু দুর্ঘটনা কখনো একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তাই অনেক যাত্রী মনোযোগ দেন—কোন আসনে বসলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে?
বিমানের আসন বিভাজন
একটি সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানে আসনগুলো তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত থাকে—
সামনের অংশ: পাইলট ককপিটের কাছাকাছি থাকা আসনসমূহ, সাধারণত বিজনেস ক্লাসে পড়ে।
মাঝের অংশ: উইং বা পাখার কাছে থাকা আসনগুলো।
পেছনের অংশ: বিমানের শেষ দিকে থাকা আসনগুলো, যেটা সাধারণত ইকোনমি ক্লাসের শেষাংশ।
কোন অংশ সবচেয়ে নিরাপদ?
২০০৭ সালে পপুলার মেকানিকস একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছিল, গত ৩০ বছরের মধ্যে ঘটে যাওয়া ২০টি বিমান দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে: বিমানের পেছনের আসনে থাকা যাত্রীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল ৬৯%; যেখানে মাঝখানে থাকা যাত্রীদের সম্ভাবনা ছিল ৫৬%; আর সামনের অংশে থাকা যাত্রীদের ছিল মাত্র ৪৯%।
এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো—বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় বিমান সামনের দিকে ধাক্কা খায় বা আগুন ধরে যায়, ফলে পেছনের যাত্রীদের বেঁচে থাকার সময় বেশি থাকে।
২০১৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পেছনের মাঝখানে থাকা আসনগুলো (যেমন ৩-৩ আসনের মধ্যে বি বা ই আসন) সবচেয়ে নিরাপদ। এদের বেঁচে থাকার হার ছিল প্রায় ৭২%। এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে— উইংয়ের পেছনে অবস্থিত হওয়ায় বেশি স্থিতিশীলতা পাওয়া যায়; জানালার পাশে না বসলে ধাক্কার সময় উড়োজাহাজের গঠন যাত্রীর শরীরকে কিছুটা রক্ষা করতে পারে। তবে, গবেষকরা স্বীকার করেছেন যে প্রত্যেক দুর্ঘটনার ধরন আলাদা, তাই একেক পরিস্থিতিতে একেক ধরনের আসন নিরাপদ হতে পারে।
কোন আসনগুলো তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ?
সামনের আসন: দুর্ঘটনায় সামনের দিকেই ধাক্কা লাগে বেশি; ফায়ার ইমপ্যাক্ট বা ব্রেকিং ইমপ্যাক্ট বেশি হয়।
জানালার পাশের আসন: সঙ্কীর্ণতা ও বহির্ভাগে থাকার কারণে পাথরের ধাক্কা বা ফাটলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বেশি দূরে থাকা এক্সিটের আসন: বিমানে দুর্ঘটনার পরপরই দ্রুত বেরিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যারা এক্সিটের কাছাকাছি থাকেন না, তাদের সময় বেশি লাগে বাইরে বের হতে।
নিরাপদ আসন বাছাইয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টিপস
এক্সিট ডোরের কাছাকাছি বসা: বিমান দুর্ঘটনার পর ধোঁয়া বা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। জরুরি নির্গমন দরজার পাশে থাকলে বের হয়ে যাওয়া সহজ হয়।
উইংয়ের পেছনের মধ্যের আসন: এই অংশ গঠনগতভাবে বেশি মজবুত ও নিরাপদ, এবং তুলনামূলক কম ঝাঁকুনি অনুভব হয়।
পেছনের অংশের মাঝামাঝি সীট: আগে বলা গবেষণাগুলোতে বারবার এই অংশকেই সবচেয়ে নিরাপদ বলা হয়েছে।
আসনের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়
লাগেজের অবস্থান: বেশি ভারী লাগেজ মাথার ওপর রাখলে দুর্ঘটনার সময় তা পড়ে আহত করতে পারে। হালকা ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কাছে রাখুন।
জুতোর ধরন: বিমানে চলাচলের সময় সহজে হাঁটা যায় এমন জুতো ব্যবহার করুন যাতে জরুরী অবস্থায় দ্রুত চলাফেরা করা যায়।
কেবিন ক্রুর কথা মানা: যে কোনো আসনেই বসুন না কেন, কেবিন ক্রুদের নির্দেশনা মেনে চলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বিমানের আসনের বাইরেও কিছু নিরাপত্তা পরামর্শ
- সিট বেল্ট সবসময় বাঁধা রাখুন।
- উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় সতর্ক থাকুন।
- কান, চোখ ও নাকের চাপ স্বাভাবিক রাখতে ক্যান্ডি বা গাম ব্যবহার করুন।
- সাধারণ ঝাঁকুনিতে আতঙ্কিত না হয়ে স্থির থাকুন।
উড়োজাহাজে যাত্রা মোটের উপর নিরাপদ হলেও দুর্ঘটনার সম্ভাবনা পুরোপুরি বাদ দেওয়া যায় না। তবে গবেষণা ও অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, বিমানের পেছনের দিকের মধ্যবর্তী আসনগুলোই তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ। তবে নিরাপত্তার দিকটি শুধু আসনের উপর নির্ভর করে না। যাত্রীর সচেতনতা, প্রস্তুতি ও বিমানের নিরাপত্তানীতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অতএব, আপনি যখনই বিমানে উঠবেন, চেষ্টা করুন নিজের অবস্থান, বের হবার পথ, এবং জরুরী ব্যবস্থাসমূহ সম্পর্কে জানার।