দিন যত যাচ্ছিল শীত তত বাড়ছিল। বাইরে যেতে পুরু জ্যাকেটের পাশাপাশি হাতমোজা, গলাবন্ধনী, শীতটুপি, শীতকালীন বুট ইত্যাদিও অপরিহার্য হয়ে উঠলো। অক্টোবরের শেষের দিকে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নামল। তখন অপেক্ষা করছিলাম কবে দেখব প্রথম তুষারপাত। নভেম্বরের এক সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি বাতাসে ছাইয়ের মতো কি যেন ভাসতে ভাসতে মাটিতে নামছে। প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি কী ঘটছে। একটু পর নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি ঘাসের ওপর সাদা আস্তরণ। বুঝে গেলাম এটাই সেই কাক্সিক্ষত তুষারপাত। জ্যাকেট পরে বাইরে গিয়ে সেই তুষার যখন হাত দিয়ে ধরছিলাম তখন একেবারেই অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল যার সাথে পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতাই মেলে না। মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালাম। কত বৈচিত্র্য নিয়েই না তিনি এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন!
প্রথম প্রথম তুষারপাত শুরুর পর কয়েক ঘণ্টা চলত। এক-দুদিন পর তা গলেও যেত। তুষার গলে গেলে রাস্তা কাদা কাদা হয়ে যায়। নগর পরিসেবার বিশেষ গাড়িতে তখন রাস্তা পরিষ্কার করে। জানুরারির প্রথম দিক থেকে তাপমাত্রা কখনো কখনো হিমাঙ্কের ৩০ ডিগ্রি নিচেও নেমে যায়। বাতাসের কারণে সেই তাপমাত্রা মনে হয় আরও অনেক কম। এই জন্য আবহাওয়া পূর্বাভাসকারী সংস্থা দুই ধরনের পরিমাপক প্রকাশ করে- মূল তাপমাত্রা (temperature) এবং অনুভূত তাপমাত্রা (wind chill)। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস সঠিক হয়। কেউ বাইরে যাওয়ার আগে পূর্বাভাস অনুযায়ী শীত প্রতিরোধক প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়। বাসগৃহ, অফিস, স্কুল, যানবাহন, দোকানপাট সবই কৃত্রিমভাবে উষ্ণ রাখা হয়। উন্মুক্তস্থানে থাকাকালীনই শুধু শীতের তীব্রতা অনুভূত হয়। তাও ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত শীতকালীন পোশাক পরে চলতে তেমন অসুবিধা হয় না। তাপমাত্রা আরও কমলে বাইরে বেশিক্ষণ থাকলে কানের লতি জমে খসে পড়ে বা ত্বকের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। একে বলে Frostbite। একবার ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (wind chill -৪৫) এর মধ্যে যখন মেট্রোরেল থেকে ক্লাসরুমের দিকে চোখ ছাড়া বাকি সবকিছু ঢেকে ঢুকে যাচ্ছি তখন মনে হচ্ছিল চোখের মধ্যে কেউ যেন সুচ ফুটিয়ে দিচ্ছে। নিঃশ্বাসে যতটুকু জলীয় বাষ্প ছিল তা নাক থেকে বেরিয়েই বরফ হয়ে ভুরুতে জমা হচ্ছিল। চোখের পানি বরফ হয়ে পাপড়ি ফেলা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। দৌড়ে বিল্ডিংয়ের উষ্ণ পরিবেশে ঢুকে তবেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
জানুয়ারি থেকে মার্চ এই সময়টায় তাপমাত্রা যেমন কম থাকে তেমনি তুষারপাত একবার শুরু হলে কয়েকদিন ধরে চলে। রাস্তা-ঘাট ছাড়া অধিকাংশ জায়গায়ই কয়েক ফুট বরফের নিচে ঢাকা থাকে। অবস্থা বেশি খারাপ হয় যখন তুষার ঝড় হয়। এ সময় বাইরে যাওয়া একেবারেই নিরাপদ নয়। তুষারের কণা শরীরের উন্মুক্ত স্থানে তীরের মতো বিঁধতে থাকে। রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যায় বলে গাড়ি প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ হারায়। তীব্র তুষার ঝড় হলে দিনের বেলাও মনে হবে যেন রাতে আঁধার নেমে এসেছে। তুষার গলে পানি হওয়ার পর হঠাৎ করে তাপমাত্রা কমে গেলে রাস্তার ওপর হালকা বরফের স্তর জমে। একে বলে Black Ice. আইসের ওপর গাড়ি চালানো খুবই ঝুকিপূর্ণ। এরকম পরিবেশে আমার গাড়ি একবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপরীত দিকের লেন অতিক্রম করে রাস্তার পাশে জমে থাকা এক ফুট উঁচু তুষারের স্তূপের ওপর উঠে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে, বিপরীত দিক থেকে তখন কোনো গাড়ি আসেনি। কয়েকদিন তুষারপাতের পর যখন সূর্যের দেখা পাওয়া যায় মনটা ভালো হয়ে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে রৌদ্রজ্জ্বল প্রকৃতি দেখে মনে হবে বাইরের উষ্ণতায় একটু বেড়িয়ে আসি। কিন্তু ভুল। সূর্যালোকের উপস্থিতি মানেই উত্তাপ নয়। কম প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিয়ে বাইরে গেলেই তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়।
উত্তর মেরুর কাছাকাছি বলে শীতকালে রাত অনেক বড় (১৫-১৬ ঘণ্টা) এবং দিন অনেক ছোট (৮-৯ ঘণ্টা) হয়। শীতের সাথে যুদ্ধ করতে শরীর সতেজ রাখতে যথেষ্ট ঘুমাতে হয়। জেগে থাকা অবস্থায় বারবার চা-কফি খেতে হয়। প্রচুর ফল, সবজি এবং অন্যান্য ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হয়। ঘরের মধ্যে নিয়মিত ব্যায়াম করতে পারলে আরও ভালো।
তাই বলে অটোয়াবাসী কি পুরো শীত নিরানন্দে বন্দি অবস্থায় থাকেন? একেবারেই না। শিশু-কিশোররা তুষার দিয়ে বল বানিয়ে ছোড়াছুড়ি করে মজা করে। কেউ কেউ তুষারের স্তূপ করে তৈরি করে নানা ঢঙয়ের তুষার-মানব, তুষারপাতহীন আলোকজ্জ্বল দিনে ছেলে-মেয়ে নবীন-প্রবীণ অনেক মানুষই বেরিয়ে পড়েন।
অটোয়া শহরের পাশ দিয়ে চলা অটোয়া নদী এবং শহরের মধ্য দিয়ে চলা রিডো ক্যানালসহ সব জলাশয়ের জলই তখন পুরু বরফে পরিণত হয়। গ্রীষ্ম কিংবা হেমন্তের প্রবাহমান নদী যখন শীতে বরফে পরিণত হয় তার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতিই অন্যরকম। চারদিকে বরফের শুভ্রতা হৃদয়ে অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করে। কেউ কেউ নদীর উপরিতলের পুরু বরফ খুড়ে তার মধ্যে বড়শি ফেলে বরফের তলে প্রবাহমান হিমশীতল পানিতে থাকা মাছ শিকার করেন। আবার কেউ কেউ আইস হকি খেলেন, স্কিয়িং করেন, স্নোবোর্ডিং করেন। আইস স্কেটিং করার জন্য আমিও একজোড়া স্কেটস কিনেছিলাম। অল্প অল্প শিখেছিলাম। তবে আমার বেশি ভালো লাগত বরফ-নদীতে বা বরফ-খালে হেঁটে বেড়াতে। আমার বাসা নদীর পাশে এবং বিশ্ববিদ্যালয় খালের পাশে হওয়ায় এই সুযোগটা আমি বরাবরই পেতাম। জানুয়ারিতে সিটি সেন্টারের কাছে রিডো ক্যানেলের পাশে (Winterlude ) নামে একটা উৎসব হয়, যেখানে বরফের চাঁই কেটে কেটে তৈরি করা হয় অসম্ভব সুন্দর সব ভাস্কর্য। কানাডা-আমেরিকার অন্যান্য শহর থেকেও লোকেরা ভিড় জমায় সেইসব ভাস্কর্য দেখতে।
ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে নদীর বরফ যখন গলতে শুরু করে সেটাও এক সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করে। প্রথমে বড় বড় বরফের টুকরো ভাসতে থাকে, যা গলে গলে ক্রমশ ছোট হতে থাকে। নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই দৃশ্য দেখার মজাই অন্যরকম। তিন-চার মাস তুষারের নিচে চাপা থাকা ধূসর ঘাস তুষার গলে যাওয়ার সাথে সাথে আবার সজীব হয়ে সবুজ হয়ে ওঠে। পত্রবিহীন গাছগুলো আবার পাতা ছাড়তে শুরু করে। শীতে হারিয়ে যাওয়া পাখিদের কিচিরমিচির আবার শুরু হয়। কান্না-হাসির দোল দোলানো আমাদের জীবনও যেন প্রকৃতির ঋতু বৈচিত্র্যকেই ধারণ করে!
মো. আনিসুর রহমান
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।