লেখকঃ মহিউদ্দিন হেলাল, সম্পাদক, পর্যটন বিচিত্রা।
বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন, বৃহত্তম এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত মালনিছড়া চা বাগান সিলেট জেলায় অবস্থিত। ১৮৪৯ সালে লর্ড হার্ডসন ১৫০০ একর জায়গার ওপর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৬’র অধিক চা বাগান রয়েছে বাংলাদেশে। চা বাগানের প্রক্রিয়াজাতকরণ একটি শিক্ষণীয় ও অভিজ্ঞতামূলক ভ্রমণ অনুষঙ্গ। চা বাগানের অতীত ইতিহাস ও আকর্ষণীয় সব বাংলো বাড়ির আতিথেয়তায় এখনো অতি প্রাচীন রীতি রেওয়াজ বিদ্যমান। এ সব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যথাযথ গুরুত্বের বিবেচনায় এনে দায়িত্বশীল পর্যটন (রেসপন্সিবল ট্যুরিজম) শিল্প বিকশিত করতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে চা-শিল্পের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে।
কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম
পর্যটন শিল্পে প্রায় একযুগ ধরে হোম-স্টে নানাভাবে গুরুত্ব বহন করছে। বাংলাদেশও এই পথে হাঁটতে শুরু করেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। প্রশাসনিক স্বীকৃতি ও নীতিমালার অভাবে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের কয়েকটি গ্রাম-গঞ্জে বা পর্যটন গন্তব্যে প্রবর্তন হচ্ছে কমিউনিটি বেজড হোম-স্টে। একই সাথে শহরেও প্রবর্তন হচ্ছে পরিবার কেন্দ্রিক হোম-স্টে ব্যবস্থা। হোম-স্টের মূল ধারণাটাই হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে একটি পরিবারের সাথে অবস্থান করে তাদের সংস্কৃতি ও খাবার-দাবার উপভোগ করা।
সিলেটের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানার ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রামে মণিপুরি আদিবাসীদের নিয়ে ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম। যেখানে অর্থের বিনিময়ে স্থানীয়দের বাড়িতে থাকা ও খাবারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, আতিথেয়তা ও সংস্কৃতি উপভোগ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে অক্ষুণœ রেখে পর্যটক সেবা প্রদানের কৌশল উন্নয়নে ‘আজিয়ার ট্যুরিজম’ নিরলসভাবে কাজ করেছে এই জনগোষ্ঠীর সাথে। সহায়তা করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। ইতোমধ্যেই এখানে দেশ ও বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনায় স্থানীয় গ্রামবাসী আগের চেয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। এক সময় গ্রাম অঞ্চলে পর্যটক বা বিদেশিদের উপস্থিতিতে স্থানীয়রা স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন না, এখন সাগ্রহে পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে এই জনগোষ্ঠী। প্রাথমিকভাবে ১০টি পরিবারে এই সুযোগ সুবিধা প্রদান করলেও এখন গ্রামের প্রায় ৭৫টি পরিবার পর্যটকদের সেবা প্রদান করে থাকে। পর্যটন শুধুমাত্র বিনোদন নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম একটি মাধ্যম। তারই একটি দৃষ্টান্ত ভানুবিল মাঝেরগাঁও কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম।
‘বানিয়াচং আমার দ্যুইন-নাই’
বাংলাদেশের নৈসর্গিক ও ভৌগলিক পর্যটনের বিবেচনায় সিলেট অঞ্চল একটি আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন গন্তব্য। বাংলাদেশের ভূ-প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন গড়ে উঠলেও সিলেটের হবিগঞ্জের বানিয়াচং গ্রামটি ব্যতিক্রম। কয়েকটি ইউনিয়নে বিভক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্রাম- বানিয়াচং। উইকিপিডিয়া লিখেছে- এটি এশিয়ারও বৃহত্তম গ্রাম। এই গ্রামেই ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণকারী ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস।
ভূবন বিখ্যাত এই ভূ-পর্যটক বাইসাইকেলে বিশ্বের চারটি মহাদেশ ভ্রমণ করেছেন। তখনো অবিভক্ত ভারতবর্ষ। শেষ জীবনে রামনাথ ছিলেন কলকাতায়। লিখেছেন ভ্রমণবিষয়ক ৩০টি বই, গল্প ও উপন্যাস। তার নামে কলকাতায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘রামনাথ বিশ্বাস লেন’। বাংলাদেশের যুবসমাজ বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের সাইকেল ভ্রমণের অনুপ্রেরণায় বসিয়েছেন রামনাথ বিশ্বাসকে। তার প্রকাশিত ভ্রমণবিষয়ক বইগুলো পর্যায়ক্রমে পুনঃপ্রকাশ করা হচ্ছে পাঠকের চাহিদায়। আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে রামনাথ বিশ্বাসের দর্শন, সাইকেল চালিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ইতোমধ্যেই গঠিত হয়েছে রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার কমিটি। সম্প্রতি রামনাথ বিশ্বাস নিয়ে একটি সেমিনার হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সেখানে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- ১৩ জানুয়ারি তার জন্মদিনে রামনাথ দিবস উদযাপন, বসতভিটায় রামনাথ বিশ্বাস পাঠাগার স্থাপন এবং বানিয়াচংয়ে রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা বাইসাইকেল পর্যটকদের জন্য অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা। যেমনটি রামনাথ বিশ্বভ্রমণ শেষে বানিয়াচংয়ে তাকে দেয়া এক সংবর্ধনায় বলেছিলেন ‘বানিয়াচং আমার দ্যুইন-নাই’ (বানিয়াচং আমার দুনিয়া)। ঠিক তেমনিভাবে রামনাথের বসতবাড়িকে তীর্থস্থান গড়ে তুলতে চান বাইসাইকেল পর্যটকরা। সফল হোক এই জাগরণ, দখলদারমুক্ত হোক রামনাথের বসতভিটা।
ধীরে চলুন!
কয়েক দিন ধরে একটি বিষয়ে গভীরভাবে ভাবছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণাই যেন ভ্রমণের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি গন্তব্যের আকর্ষণীয় বিষয়ে গভীরভাবে জানা-বোঝা ও উপভোগ করার চেয়ে ছবি তোলা, ভিডিও করা, লাইভে প্রচারই যেন ভ্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে।
অথচ ভাবুন! যখন মোবাইলের দৌরাত্ম্য ছিল না, মোবাইলে ক্যামেরা ছিল না, ক্যামেরার দুষ্প্রাপ্যতা ছিল, তখন অনেক পরিব্রাজক দেশ-বিদেশ ও বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন এবং ভ্রমণ শেষে তারা লিখেছেন। যদিও তখন প্রকাশকের অনেক অভাব ছিল, প্রকাশনার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। তারপরও শত শত বছর পর তাদের লেখনির কারণেই সেসব পরিব্রাজক অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা আবার অনেককে বিশ্ব পাঠশালা ভ্রমণে আজও উদ্বুদ্ধ করে চলছে। আজও তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পড়ে সেই সময়ের সমাজব্যবস্থা, যোগাযোগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা সম্পর্কে আমরা জনতে পারি। যারা গভীরভাবে একটি গন্তব্যের নির্যাসটুকু উপলব্ধি, অনুভব ও উপভোগ করেছেন ও লিপিবদ্ধ করে অমর হয়ে আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম- হিউয়েন সাঙ (৬০২ খ্রি.), ইবনে বতুতা (১৩৪৫ খ্রি.), ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১ খ্রি.), ভাস্কো দা গামা (১৪৬০ খ্রি.), ফারদিনান্দ মাজেলান, নিকোলাস পিজেন্টো, লুইস ভারটোমেনাস (১৫০৩ খ্রি.), কাইজার ফ্রেডরিক (১৫৬৫ খ্রি.), চার্লস ডারউইন (১৮০৯ খ্রি.), সেবাস্তিন ম্যানরিখ, টমাস স্টিভেন্স (১৮৫৪ খ্রি.), রামনাথ বিশ্বাস (১৮৯৪ খ্রি.) প্রমুখ।
একবার ভাবুন! ভ্রমণে গভীরভাবে গন্তব্যের আকর্ষণ-অনুষঙ্গ, স্থানীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস উপভোগ করবেন, নাকি সোশ্যাল মিডিয়ায় হালকা বাহবা পাওয়ার জন্য ছবি ও ভিডিও করে ব্যস্ত সময় পার করবেন? অল্প সময়ে অনেক গন্তব্যে ছুটোছুটি না করে, বেশি সময় নিয়ে ভ্রমণকে উপভোগ্য করুন।
বর্তমান সময়ে পর্যটকদের ‘ধীরে চলার’ একটি চল চালু হয়েছে। বিশ্ব পর্যটন ব্যবস্থায় ইতোমধ্যে ‘ধীরে চলার’ চল (ঝষড়ি ঃৎধাবষ) বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দ্রæত সময়ে প্লেনে গন্তব্যে পৌঁছার চেয়ে, সময় নিয়ে ট্রেন, বাস বা লঞ্চে চড়ে পারিপার্শ্বিকতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করুন। গন্তব্যের আকর্ষণ, স্থানীয় সংস্কৃতি ও খাবার আনন্দের সাথে উপভোগ করুন। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যপূর্ণ কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা অর্জন করুন। আর ভ্রমণ শেষে লিখুন- ইহাই স্থায়ী। যেমনটি শতবর্ষ পূর্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় লিখেছেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহল ভরে’।
১০ম এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ার ২০২৩
পর্যটন একটি বহুমাত্রিক শিল্প। এই শিল্পের বহুমাত্রিকতার সুফল ছড়িয়ে টেকসই উন্নয়নে পর্যটন মেলা একটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম। পর্যটন বিচিত্রা আয়োজনে ২০০৭ সাল থেকে পর্যটন মেলা এই শিল্পোন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত- চার বছর নিয়মিত ‘ঢাকা ট্যুরিজম ফেয়ার’ নামে এই মেলা অনুষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে ২০১১ সাল থেকে ‘এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ার’ নামে নিয়মিত ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে আঞ্চলিক এই পর্যটন মেলা। পর্যটন শিল্প উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ‘এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ার’ আঞ্চলিক পর্যটনের টেকসই উন্নয়নে নিরব সেতু রচনা করে চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় ৯টি দেশের ১৩০টি পর্যটন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে এক অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্য দিয়ে গেল সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ৯ম এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ার-২০২২।
আসন্ন ‘১০ম এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ার-২০২৩’ আরও বর্ধিত কলেবরে ১৫টি দেশের অংশগ্রহণে অন্তত ২৫০টি পর্যটন প্রতিষ্ঠান নিয়ে ঢাকায় ২১-২৩ সেপ্টেম্বর মেলা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে পর্যটন বিচিত্রা। এই মেলায় সবার প্রতি রইল অগ্রিম আমন্ত্রণ।