পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
পাহাড় ঘেরা ও অবিরাম প্রবাহিত নদী বেষ্টিত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রাম। এখানে মণিপুরি খাবার, সঙ্গীত, নৈপুণ্য এবং শিল্প পরিবেশনা উপভোগের পাশাপাশি এই সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী তাঁত বস্ত্র বোনার প্রক্রিয়া দেখার অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন। সুন্দর চা বাগান ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিপুরা পাহাড়ের সীমান্তঘেঁষা কমলগঞ্জ সিলেট বিভাগের অন্যতম সেরা সংরক্ষিত ও মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত। এখানকার প্রধান প্রাকৃতিক আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য, সুন্দর চা বাগান, রাবার বাগানের স্থান, ছোট নদী ও স্থানীয় পুকুর। রয়েছে কামারছড়া চা বাগান, মহিমান্বিত হামহাম জলপ্রপাত, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও হরিনারায়ণ দীঘি।
কমলগঞ্জের পর্যটনের কেন্দ্রীয় আকর্ষণ মণিপুরি সংস্কৃতি। মণিপুরি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাষা এবং খাবারও ভারতের মণিপুর রাজ্যে বসবাসকারী মানুষের কাছাকাছি। মণিপুরিদের অধিকাংশই হিন্দু এবং তারা অপোপা/সনাতন ধর্মকে অনুসরণ করে। মণিপুরি সম্প্রদায়ের কিছু অংশ নিজেদেরকে বিষ্ণুপ্রিয়াদশী বলেও ডাকে। বাংলাদেশের মধ্যে মণিপুরি নৃত্য, খাবার ও পোশাক ব্যাপক জনপ্রিয় এবং দেশের পর্যটনের জন্য একটি জনপ্রিয় সম্পদ হয়ে উঠছে।
মণিপুরি রাধা-কৃষ্ণ নৃত্য, মণিপুরি মার্শাল আর্ট পরিবেশনা, কমলগঞ্জের প্রধান উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মার্চ মাসে থাবাল চোনবা নৃত্য; এপ্রিল মাসে লিকন সানাবা উৎসব/নৃত্য; সেপ্টেম্বরে দুর্গাপূজা এবং নভেম্বরের শেষে রাস পূর্ণিমা নৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মণিপুরি খাবার এর বিশেষ রেসিপির জন্য খুবই বিখ্যাত। এছাড়া এই সম্প্রদায়ের পোশাক, ঘরবাড়ির ধরন ও স্থাপত্য, কাপড় ও হস্তশিল্প, স্থানীয় স্বর্ণকারের মণিপুরি গয়না তৈরি, কাপড় ও তাঁত বোনা, মণিপুরী বৌদ্ধিক সম্পত্তি জাদুঘর, মণিপুরি সম্প্রদায় কেন্দ্র ও গ্রন্থাগার, মনিপুরি মন্দির এবং শিব আশ্রম উল্লেখযোগ্য।
কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীভুক্ত ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রামে চার বছরেরও বেশি সময় আগে এই গ্রামেরই নিরঞ্জন সিংহের বাড়িতে গড়ে ওঠে কমিউনিটি ট্যুরিজম (সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন)। শুরুতে ১০টি মণিপুরী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এই গ্রামের ৭৫টি বাড়িতে গড়ে উঠেছে এ ট্যুরিজম।
২০১৮ সালের ৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে নিরঞ্জন সিংহের বাড়ি থেকেই শুরু হয় কমিউনিটি ট্যুরিজম। বলা যায় তিনিই উদ্যোক্তা। তার বাড়ির প্রবেশপথে দেয়ালে বড় বড় করে লেখা- ‘ভানুবিল মাঝেরগাঁও মণিপুরি কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম’।
এই গ্রামের বাড়িগুলোর প্রতিটি ঘরের একটা অংশ পর্যটকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো বাড়ির দুটি, কোনো বাড়িতে চারটি কক্ষেই পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে তাঁত আছে। আছে নিজেদের ঐতিহ্য প্রদর্শনের তাক।
পেছনের গল্প
নিরঞ্জনের প্রয়াত ভগ্নিপতি রবিনের মণিপুরি তাঁতবস্ত্রের কারখানা ছিল। জাপানে তাঁতবস্ত্র রপ্তানি করতেন তিনি। জাপানি ক্রেতারা সরাসরি পণ্য তৈরির কাজ দেখতে চাইতেন। রবিন তাদের ভানুবিল মাঝেরগাঁওয়ে আনতেন। নিরঞ্জন সিংহ মণিপুরিদের জীবনযাপন, তাঁতবস্ত্র বোনাসহ এলাকার পর্যটনস্থানগুলো তাদের ঘুরিয়ে দেখাতেন। রবিন মারা যাওয়ার পর ভানুবিলে জাপানিদের আসা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১১ সাল তখন। এরপর নিরঞ্জন সাধারণ পর্যটকদের বাড়িতে রেখে তিনি নিজেদের ঐতিহ্য জানানোর ব্যবস্থা করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
আর তখনি পর্যটন ব্যবসায়ী আজিয়ার কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমের প্রবক্তা শাহিদ হোসেন শামীম এগিয়ে আসেন। তিনি অনেককে নিরঞ্জনের বাড়িতে আনতেন। মণিপুরিদের আপ্যায়নে পর্যটকরা মুগ্ধতার কথা বলতেন। শামীম বিষয়টি তৎকালীন সিলেট বিভাগীয় কমিশনারকে জানালে তিনি বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকেও এর সঙ্গে যুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ‘সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটনের মাধমে কর্মসংস্থান’ নামের এই প্রশিক্ষণের আওতায় অংশগ্রহণকারীদের বাড়িগুলো পর্যটকদের থাকার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিদের শেখানো হয়- বাড়িঘর গোছানো, রান্নাবান্না, স্বাস্থ্যবিধি, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবহার, ভ্রমণের সূচি তৈরি এবং পর্যটন গাইডের দায়িত্ব। স্থানীয়ভাবে এই পর্যটন ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটির কাজ তত্ত্বাবধান করেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। কোনো পর্যটক এলে এই কমিটির মাধ্যমেই তার সার্বিক ব্যবস্থাপনা করা হয়। পাশাপাশি পর্যটন থেকে আসা আয় বন্টনসহ অন্যান্য কাজও কমিটির মাধ্যমে হয়ে থাকে।
এভাবে এই গ্রামে শুরু হয় কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম। প্রথমে ১০টি মণিপুরি পরিবার যুক্ত হলেও এখন আছে ৭৫টি পরিবার।
এর আগে টাঙ্গাইলে এ ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে আজিয়ার ফেয়ার ট্রেড লিমিটেড। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কমলগঞ্জে এই প্রকল্প হাতে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পের লক্ষ্য দুটি। স্থানীয় মানুষকে স্বাবলম্বী করা এবং পর্যটকদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো। মনিপুরি সম্পদায়ের নারীরা পুরুষের মতো তৎপর। প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের উপার্জনের পথ খুলেছে। এই গ্রামের বাসিন্দারা এখন বাড়িতে পর্যটন সেবা দিয়ে উপার্জন করছেন। শীত মৌসুমে এটা আরও বাড়বে।
দেশে কমিউনিট ট্যুরিজম শিল্পের উন্নয়নে আজিয়ার ফেয়ার ট্রেড লিমিটেড ২০০২ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় পর্যটন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সহযোগিতায় কমলগঞ্জের ভানুবিল মাঝেরগাঁওয়ে এই কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়।
এখানে পর্যটকদের প্রয়োজেন স্বল্পকারে মণিপুরি সংস্কৃতি তুলে ধরে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজনও করা হয়। একই সঙ্গে প্রতিটি কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম পরিবারে রয়েছে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র, তাঁতবস্ত্র তৈরির প্রদর্শনীসহ মণিপুরি ছোটখাটো আরও অনেক কিছু।
দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানকার বাড়িগুলোতে পারিবারিকভাবে অবস্থান করে একে অন্যের খাবার, সামাজিকতা, সংস্কৃতি, আচর-আচরণ, সামাজিক পরিবেশ ইত্যাদি বিনিময় করার সুযোগ পাচ্ছেন। গত দুই বছর করোনাকালীন কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম অনেকটা থমকে গেলেও চলতি বছর থেকে আবারও পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় চলে এসেছে মণিপুরি কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশি পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরাও এখানে আসতে শুরু করেছেন। বিদেশিদের আগমনের ফলে দেশের বৈদেশিক আয় বাড়ছে। তবে কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমে মণিপুরীদের সীমিত আবাসস্থলে অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ থাকলে কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই ট্যুরিজম আরও সম্প্রসারণ করলে দেশের পর্যটন এগিয়ে যাবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
পর্যটকদের ব্যয়
একটা কক্ষে দুটি করে বিছানা। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া দুই হাজার টাকা। চারজনের থাকার ব্যবস্থা আছে। কেউ চাইলে একাও থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে এক হাজার টাকা। পরিবারগুলোর সঙ্গে সকালের নাশতাসহ তিন বেলা খাবারের খরচ জনপ্রতি ৯০০ টাকা। আগে ৭০০ টাকা ছিল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাড়ানো হয়েছে। এই ট্যুরিজমে একেবারে ভিন্ন পরিবেশে পর্যটকদের মুড়ির মোয়ার সাথে হারবাল চা পরিবেশন করা হয়। খাবারে নিজেদের উৎপাদিত বিষমুক্ত শাকসবজি ব্যবহার করা হয়।
নিরাপত্তা
কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমে প্রশাসনিক সহায়তার সঙ্গে পর্যটন পুলিশেরও নজরদারি রয়েছে। এখানে অহেতুক কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। মণিপুরি পরিবারের নারীরা বাড়িতে পর্যটকদের সেবাযতœ ও রান্নার কাজ করেন এবং পুরুষ সদস্যরা হাটবাজার করার সঙ্গে পর্যটকের পছন্দের মাধবপুর লেক, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হামহাম জলপ্রপাত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরতে ব্যবস্থা করা ছাড়াও গাইড হিসেবে সাথে থাকেন।
কিভাবে যাবেন
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে কমলগঞ্জের ভানুগাছ কিংবা শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশনে নেমে প্রাইভেটকার অথবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে আদমপুরের ভানুবিল গ্রামে যাওয়া যায়। সড়কপথেও সহজে ভানুবিল গ্রামে যাতায়াত করা যায়। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরত্ব ভানুবিল গ্রামের। এছাড়া শ্রীমঙ্গল বা মৌলভীবাজার থেকেও সহজে স্থানীয় পরিবহণে যাতায়াত করা যায়।
একটা কক্ষে দুটি করে বিছানা। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া দুই হাজার টাকা। চারজনের থাকার ব্যবস্থা আছে। কেউ চাইলে একাও থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে এক হাজার টাকা। পরিবারগুলোর সঙ্গে সকালের নাশতাসহ তিন বেলা খাবারের খরচ জনপ্রতি ৯০০ টাকা। আগে ৭০০ টাকা ছিল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাড়ানো হয়েছে। এই ট্যুরিজমে একেবারে ভিন্ন পরিবেশে পর্যটকদের মুড়ির মোয়ার সাথে হারবাল চা পরিবেশন করা হয়। খাবারে নিজেদের উৎপাদিত বিষমুক্ত শাকসবজি ব্যবহার করা হয়।
নিরাপত্তা
কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমে প্রশাসনিক সহায়তার সঙ্গে পর্যটন পুলিশেরও নজরদারি রয়েছে। এখানে অহেতুক কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। মণিপুরি পরিবারের নারীরা বাড়িতে পর্যটকদের সেবাযতœ ও রান্নার কাজ করেন এবং পুরুষ সদস্যরা হাটবাজার করার সঙ্গে পর্যটকের পছন্দের মাধবপুর লেক, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হামহাম জলপ্রপাত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরতে ব্যবস্থা করা ছাড়াও গাইড হিসেবে সাথে থাকেন।
কিভাবে যাবেন
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে কমলগঞ্জের ভানুগাছ কিংবা শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশনে নেমে প্রাইভেটকার অথবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে আদমপুরের ভানুবিল গ্রামে যাওয়া যায়। সড়কপথেও সহজে ভানুবিল গ্রামে যাতায়াত করা যায়। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরত্ব ভানুবিল গ্রামের। এছাড়া শ্রীমঙ্গল বা মৌলভীবাজার থেকেও সহজে স্থানীয় পরিবহণে যাতায়াত করা যায়।