পূর্বকথা
সেই ২০০৪ সাল থেকেই হিমালয়ে অভিযান পরিচালনা করে আসছে বি.এম.টি.সি (বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব)। বেশিরভাগ অভিযানই সফল হওয়ার পরও বিএমটিসির উচ্চাকাঙ্খা স্তিমিত হয়নি। বিএমটিসির স্বপ্নদ্রষ্টা অ্যান্টার্কটিকা ও উত্তর-মেরু অভিযাত্রী প্রথম বাংলাদেশি অভিযাত্রী ‘ইনাম আল হক’ চিরদিন আরো একটা স্বপ্ন লালন করে এসেছেন, তা হল- হিমালয় পর্বতে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের নামটি স্থাপন করতে হবে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব?
ইতিমধ্যে বিএমটিসির আমন্ত্রণে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বাংলাদেশে আসেন বিশ্বরেকর্ডধারী পর্বতারোহী ‘পেম্বা দর্জি শেরপা’। তরুণ ও সম্ভাবনাময় এই অভিযাত্রী বিএমটিসির সদস্যদের উদ্দীপনা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে ইনাম আল হককে দিলেন অসাধারণ এক প্রস্তাব। বললেন, পৃথিবীর কোন মানুষ কখনও আরোহণ করেনি এমন এক শৃঙ্গে বাংলাদেশ ও নেপালের পর্বতারোহীরা যৌথ-অভিযান চালাবে এবং তা সফল হলে পর্বত-শৃঙ্গটির নাম হবে নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর। জানালেন, ইতিপূর্বে চীন ও জাপানের সাথে এ ধরনের দুটি সফল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
পেম্বা দর্জি শেরপার প্রস্তাবে আমরা যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গেলাম। তাঁর এই প্রস্তাবে আমাদের স্বপ্ন পূরণের দ্বার খুলে গেল। এন.এম.এ (নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন) সভাপতিকে তখন থেকেই চিঠি লিখতে শুরু করলেন বিএমটিসির প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক। তাঁরই আবেদনের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে নেপাল সরকারকে চিঠি দেয়া হল এবং নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ‘ইমতিয়াজ আহমেদ’ সরকারি পর্যায়ে লেখালিখি ও যোগাযোগ শুরু করলেন। হিমালয়ের কোন একটি অ-বিজিত শিখরে বাংলাদেশ-নেপাল যৌথ-অভিযানের অনুমোদন দেয়ার জন্য এসব চিঠিতে প্রস্তাব করা হল। কিন্তু নেপালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য আমাদের সে প্রস্তাবের তাৎক্ষনিক সম্মতি মেলেনি। হতাশ না হয়ে আমরা নেপালের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখলাম। অবশেষে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে এন.এম.এ-সভাপতির কাছ থেকে বহুল প্রতীক্ষিত ই-মেইলটি পেলেন ইনাম আল হক। এন.এম.এ-সভাপতি ‘জিম্বা জাংবু শেরপা’ লিখেছেন, নেপাল-তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত ২০,৫২৮ ফুট (৬২৫৭ মিটার) উুঁচু ‘চেকিগো’ নামের অ-বিজিত শিখরে বাংলাদেশ-নেপাল যৌথ-অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে।
ইনাম আল হক তৎক্ষণাৎ আমাদের সম্মতি জানিয়ে এন.এম.এ-সভাপতিকে ই-মেইল লিখলেন। এন.এম.এর পরিচালনা-পর্ষদের সভায় বিষয়টি উত্থাপন করলেন জিম্বা জাংবু শেরপা। প্রস্তাবটি অনুমোদন করল পরিচালনা-পর্ষদ। আমাদের আকাংক্ষিত অনুমোদন তো পাওয়া গেল; কিন্তু অজ্ঞাত এই চেকিগো শিখরে অভিযান পরিকল্পনা করতে যেয়ে কিছু তথ্য চমকে দিল আমাদের।
এন.এম.এর তথ্য-মতে চেকিগো শিখরে ইতিপূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১৩টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে, কিন্তু সবই ব্যর্থ। এ পর্যন্ত চেকিগো শিখরে কেউ সাফল্য লাভ করেনি; কোন পথে ও কীভাবে আরোহণ-পরিকল্পনা করলে সাফল্য আসবে সে ধারণা কারো নেই। এই পরিসংখ্যানে দেখেই বোঝা যায়, চেকিগো কত কঠিন ও ভয়ংকর এক শিখর। হিমালয়ে এমন অনেক শিখর আছে যা উচ্চতায় এভারেস্টের চেয়ে ছোট হলেও কৌশলগত আরোহণের দিক থেকে অনেক বেশি কঠিন ও বিপজ্জনক। আমরা চিন্তিত হয়ে পরলাম, এমন একটি শিখরে বাংলাদেশ-নেপাল যৌথ-অভিযান পরিচালনা করা কি ঠিক হবে, যেখানে সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ?
প্রস্তুতি পর্ব
সেই মুহূর্তে সম্ভাব্য সাফল্য-অসাফল্য নিয়ে ভাবার মনোবৃত্তি আমাদের ছিল না। বাংলাদেশের নামে হিমালয়ের কোন শিখরের নাম রাখার কাজে নামার জন্য এটাই আমাদের একমাত্র সুযোগ। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমরা এটা পেয়েছি। এখন কি বলতে পারি, এটা নয়, আমাদের একটা সহজ শিখর চাই! অভিযানের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজে নামলেন ইনাম আল হক। অর্থের জন্য আমাদের বেগ পেতে হল না। কসমস গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ইউ.এন.বি-সম্পাদক ‘এনায়েত উল্লাহ খান’ অভিযানের অর্ধেক ব্যয় বহন করতে সম্মত হলেন। বাকি অর্ধেক ব্যয় বহন করার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এলেন প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ‘মশিউর রহমান’। ব্যবসায়িক দিক থেকে বড় কোন লাভ নেই জেনেও দেশের সম্মান ও গৌরবের জন্য এ দুই প্রতিষ্ঠানের দুই কর্ণধার শুধুমাত্র সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন।
আমরা অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করলাম। বাংলাদেশ থেকে ছয়জন ও নেপাল থেকে সাতজন অভিযাত্রীর অংশ গ্রহণের পরিকল্পনা হল। নেপালি দলের নেতৃত্ব দেবেন পেম্বা দর্জি শেরপা। বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হল। বাংলাদেশি দলের সদস্য ছিলেন নিশাত মজুমদার নিশু, সাদিয়া সুলতানা সম্পা, সজল খালেদ, নুর মোহাম্মদ ও কাজী বাহলুল মজনু বিপ্লব। এরা সবাই ভারতে পর্বত-আরোহণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং হিমালয়ে একাধিক ট্রেকিং ও আরোহণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। নেপালি দলের সদস্য ছিলেন মিংমা গ্যালজে শেরপা, দা-কিপা শেরপা, মিংমা দর্জি শেরপা, দাওয়া ইয়াংজুম শেরপা, সুস্মিতা মাসকে এবং নাওয়াং ফুটি শেরপা। দলনেতা সহ নেপালি দলের পাঁচজন এক বা একাধিকবার এভারেস্ট জয় করেছেন। হিমালয় পর্বতে প্রথম বাংলাদেশ-নেপাল যৌথ-অভিযান উপলক্ষে পতাকা-প্রদান ও সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে। নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জিম্বা জাংবু শেরপা এবং নেপালি-দলের নেতা পেম্বা দর্জি শেরপা এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নেপাল থেকে ঢাকা চলে এলেন।
যাত্রা শুরু
নিশু, সজল, সম্পা, নুর, বিপ্লব আর আমি কাঠমুন্ডুর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়লাম ১ অক্টোবর। পেম্বা দর্জি শেরপা ও নেপালি দলের সব সদস্য কাঠমান্ডু বিমান বন্দরে ঐতিহ্যবাহী শেরপা-রীতিতে আমাদের গলায় ‘কাথা’ পরিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। বিমান বন্দর থেকে আমরা নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে গেলাম। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে আমরা নগরীর কেন্দ্র ‘থামেল’ চলে গেলাম। এখানে হোটেল ‘নরবু লিনকা’ আমাদের অবস্থানের জন্য নির্ধারিত ছিল। তার পরের ব্যস্ত দিনটা আমাদের কেটে যায় অভিযানের জন্য জরুরি কেনাকাটা সারতে এবং রাতে ‘উৎসব’ নামের ঐতিহ্যবাহী নেপালি রেস্টুরেন্টে এন.এম.এর দেওয়া নৈশভোজে যোগ দিয়ে। নেপাল পর্যটন বোর্ডের সভা কক্ষে এন.এম.এ আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে সবাই যোগ দিয়েছিলাম তার পরদিন। ৪ অক্টোবর খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমরা তৈরি হলাম। সুস্মিতা মাসকে, দা কিপা শেরপা ও মিংমা গালজে শেরপা আমাদের নেওয়ার জন্য হোটেলে এলেন। ট্যাঙি চড়ে আমরা পশুপতি মন্দির পর্যন্ত গেলাম। সেখানে আমাদের জন্য মিনি-বাস অপেক্ষারত ছিল। বাবুর্চি ও তার তিন সহযোগীসহ আমরা মোট ১৭ জন অভিযানে যাচ্ছি। এছাড়া আমাদের সঙ্গী হলেন নেপালের সবচেয়ে কম বয়সী এভারেস্ট বিজয়ী ‘তিম্বা চিরি শেরপা’; চমৎকার, মিশুক এবং প্রাণবন্ত এক তরুণ । প্রায় নয় বছর আগে, ২৩ মে ২০০১ তারিখে সর্বকনিষ্ঠ এভারেস্ট-জয়ী হয়ে তিনি রেকর্ড গড়েছিলেন; সেদিন তার বয়স ছিল ১৬ বছর ১৬ দিন (এর ৯ বছর পর, ২০১০ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের এক অভিযাত্রী ১৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করে সেই রেকর্ডটি ভেঙেছে)।