ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা আসে আকাশ-ভরা মেঘমালা আর প্রকৃতির নানাধরনের আশীর্বাদ নিয়ে। কবি নির্মলেন্দু গুণ বর্ষা ঋতুকে বর্ষারানী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কবি কালিদাসের ভাষায় বর্ষার মেঘ হচ্ছে সৌন্দর্য-সখা এবং লোভনীয় সম্ভোগের। তিনি বর্ষাকে অনুভব করেছেন অনুরাগের গভীরতায়। গ্রীষ্মের খরদাহ তাপকে হটিয়ে দিয়ে বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি হয়ে ওঠে ঘন-সবুজ এবং রূপবতী। বর্ষা আমাদের জন্য প্রশান্তি নিয়ে আসে; সঙ্গে আনে নানাধরনের সুস্বাদু খাবার। খাল-বিল-নদীগুলো বর্ষার পানিতে হয়ে ওঠে যৌবনবতী। সারাদেশের পর্যটন আকর্ষণগুলো বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকা এবং ঝরনাগুলো হয়ে ওঠে উচ্ছল এবং তাদের মাঝে নেমে আসে প্রাণস্পন্দনের গতিধারা।
এই বর্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটের পাহাড়গুলো হয়ে ওঠে চোখ ধাঁধানো সবুজময়, যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে আর বলে-আয় সবুজ দামাল ছেলে-মেয়েরা তোদের নিয়ে দিনরাত খেলা করি; এখানে ঘুমাবি এবং এখানেই থাকবি। নদীর দু’ক‚ল ঘেঁষে ফোটে রাশি রাশি শুভ্র কাশবন। বাংলাদেশের বর্ষা জ্যোৎস্নারাত্রিতে আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং মায়াবীপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের নদী এবং হাওরগুলোর পানিতে যখন জ্যোৎস্নার আলো পড়ে আর টলমল স্নিগ্ধ পানিতে মাখামাখি করে তখন এর যে রূপ উপচেয়ে পড়ে তা পর্যটকদের মাতাল করে দেয়।
বর্ষায় বাংলাদেশ পর্যটকদের জন্য অনেকভাবে বেশি বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। বর্ষার হিজল, তমাল, কদম, কামিনী আর যূথিকার ফুলের গন্ধে পর্যটকদের মন আবেগি হয়ে ওঠে। মনে হয় প্রেমের দোলা দিয়ে যায় পর্যটকদের হৃদয়ে। বাংলার বর্ষা ঋতুর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে কবি নজরুল লিখেছেন-‘রিমঝিম রিমঝিম ঐ নামিল দেয়া/শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া/ঝিলে শাপলা, কমল ঐ মেলিল দল/মেঘ অন্ধ গগন, বন্ধ খেয়া’। তিনি আরো লিখেছেন-‘আজ যেনো মেঘের মাথায়/ আম, জাম আর কাঁঠাল ছায়ায়,/ বর্ষার রূপ দেখ দ’ুচোখ ভরে/নদ-নদীতে খেলা করে।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ বর্ষা হচ্ছে নবযৌবনের প্রতীক। তিনি লিখেছেন-‘এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,/গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন-ভরষা-/দুলিছে পবন সনসন বনবীথিকা,/গীতময় তরুলতিকা।’
বর্ষা ঋতুতে সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। বর্ষা ঋতুতে ইলিশ-খিচুড়ি কিংবা চিংড়ি-খিচুড়ি খাওয়ার স্বাদই আলাদা। আমাদের এসব ঐতিহ্যবাহী বিদেশি পর্যটকরা বেশ পছন্দ করে। তাই বাংলাদেশের অনেক হোটেল, মোটেল এবং রিসোর্ট ইলিশ-খিচুড়ি এবং সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা (শুঁটকি, মাছ, কচু, ঢেঁড়স ইত্যাদি) অফার করে এই ঋতুতে।
বর্ষায় বাংলাদেশের যে সব পর্যটন স্পট বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত স্থান সেগুলো হচ্ছে-বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল, বগালেক; রাঙ্গামাটির-কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝরনা, রাজবাড়ি, সাজেক ভ্যালি; খাগড়াছড়ির আলুটিলা, রিচাং ঝরনা; সিলেটের তামাবিল, জাফলং, রাতারকুল, হামহাম ঝরনা; মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, বড়লেখার মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত; সিলেটের হাকালুকি এবং সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর; বৃহত্তর বরিশাল ইত্যাদি। এসব স্পটে ঢাকা থেকে বাসে করে গিয়ে স্থানীয় গাড়িভাড়া করলে চলাচলে সুবিধা হবে এবং সময় বাঁচবে আর নয়তো স্থানীয় সিএনজিতে ভাড়া বেশি লাগবে।
বর্ষায় বাংলাদেশের আরেকটি প্রধান আকর্ষণ নৌকাবাইচ। প্রতিবছর বর্ষায় যখন নদীগুলোতে পানিতে টইটম্বুর হয়ে পড়ে তখন আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচের। বাংলাদেশের পদ্মা নদী, ভৈরব নদী, ব্রহ্মপুত্র নদী, সুরমা নদী, মধুমতি নদীসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানের ছোট-বড় নদীতে আয়োজন করা হয় এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ তাই নদীগুলোতে এই সময় অনেকে বড় জাহাজ ভাড়া করে নৌভ্রমণের আয়োজন করে থাকেন। এছাড়া, বর্ষাকালে মাঝিরা যখন দেশি পালতোলা নৌকা নিয়ে ভাটিয়ালি গান গেয়ে চলে যেতে থাকে তখন সব দেশি-বিদেশি পর্যটক মুগ্ধ হয়ে শোনেন।
বর্ষাকালে বাংলাদেশের হাওরগুলো পর্যটনের জন্য খুবই চমৎকার স্থান হয়ে ওঠে। হাওরগুলোতে নৌকা করে জ্যোৎস্না রাত্রি উপভোগ করা; নিজ-হাতে মাছ ধরে নৌকাতেই রান্না করে খাওয়া এক অসাধারণ আনন্দের ব্যাপার হয়ে ওঠে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য এটি এক অনন্য পর্যটন আকর্ষণ।
বর্ষা ঋতুতে বাংলাদেশে জন্মে অনেক ধরনের শাক-সবজি এবং ফল যা পৃথিবীর অনেক দেশেই জন্ম না। বর্ষা ঋতুর উল্লেখযোগ্য ফলের মধ্যে হচ্ছে- রসালো কাঁঠাল, আনারস, ডালিম, পেয়ারা, করমচা, নুনচা ইত্যাদি যা পুষ্টি এবং স্বাদে ভরপুর। বর্ষা ঋতুতেও প্রচুর আম পাওয়া যায়। তাই পর্যটকরা এগুলোর স্বাদ উপভোগ করতে পারেন এই ঋতুতে বাংলাদেশ ভ্রমণ করে। এসব কিছুই নিয়ে বাংলাদেশের অনেক ট্যুর অপারেটর বর্ষায় ভ্রমণের বিভিন্ন প্যাকেজ অফার করে থাকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য। বর্ষায় সাধারণত জাপানি, চীনা, ইউকে এবং ইউএসএ ট্যুরিস্টরা বাংলাদেশে বেশি ভ্রমণ করেন। এদেশের বর্ষা তাদের কাছে অনেক সুন্দর।
বর্ষায় বাংলাদেশের পালাগান, কবিগান এবং কাওয়ালি গানের আসর বসে আর নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খেলা হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, সাপলুডু । এসব খেলায় গ্রাম-বাংলার তরুণ-তরুণী থেকে যুবক-যুবতী এমনকি অনেক বয়স্ক নিমগ্ন থাকেন। আর এসব খেলা দেখে বিদেশি পর্যটকরা বেশ মজা পান। পর্যটকরা যখন গাড়িতে করে ট্যুরিস্ট স্পটে ভ্রমণ করতে যান, তখন রাস্তার দু’পাশে সবুজ ধান, পাট, ধৈঞ্চা এবং অন্যান্য সবুজ ফসলের ক্ষেত দেখে মুগ্ধ হন। কারণ এত সুন্দর সবুজ ফসলের মাঠ, এলোমেলো বাতাসে পাতা-দোলানো দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ তারা খুব কমই দেখেন। এগুলো তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে থাকেন।
বর্ষায় টানা জাল কিংবা চাঁই দিয়ে মাছ ধরার এমন দৃশ্য আর কোথায় পাওয়া যাবে বাংলাদেশ ছাড়া? তাই বিদেশি পর্যটকরা তো বটেই, আমাদের নগরের বাসিন্দারাও বিমোহিত হন এসব দৃশ্যপটে। অনেক বিদেশি এসব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছা পোষণ করেন এবং অনেকক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করে থাকেন তারা।
বর্ষা ঋতুতে পর্যটন স্পটগুলোতে বেড়াতে গেলে নানধরনের পোকামাকড়ের অদ্ভুত শব্দ শুনতে ভালো লাগে। রাতের বেলায় ব্যাঙসহ নানাধরনের পোকা অবিরাম ডাকতেই থাকে। বর্ষা ঋতু বাংলাদেশের আশীর্বাদের ঋতু, কারণ এ মাসের অবিরাম বৃষ্টি আমাদের ফসল এবং মিষ্টি পানির চাহিদা মিটিয়ে থাকে। চাষাবাদ এবং নৌপথকে চলাচলের উপযোগী করে তোলে।
তাই বাংলাদেশের অনেক জায়গা বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে আত্মীয়ের বাড়িতে নৌপথে বেড়াতে যাওয়া এবং বিয়ে-শাদির ধুম পড়ে যায়। নৌপথে পর্যটকরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারে।
বাংলাদেশ যে একটি নদীমাতৃক দেশ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডেল্টা তা বর্ষাাকালেই ভালোভাবে বোঝা যায়। আকাশপথে ভ্রমণ করলে ওপর থেকে দেখা যায়, বিশাল বিশাল জলরাশির আধার আর সবই মিষ্টি পানির আধার। বর্ষা ঋতুতে এগুলোতে নানাজাতের মাছ আসে ডিম ছাড়তে। এ মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু এবং আমিষের অনন্য উৎস। এগুলো পর্যটকরা বেশ উপভোগ করেন।
অন্যান্য ঋতুর তুলনায় বর্ষা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে অনেক অবদান রাখতে পারে। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে আমাদের আরো বেশি বর্ষা-প্যাকেজ অফার করতে হবে। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরো প্রচারণায় নামতে হবে। বর্ষা মৌসুমের ওপর পর্যটন বিষয়ে ভিডিওক্লিপ এবং টিভিসি তৈরি করে তা বিদেশে প্রচার করা হলে এ ঋতুতে বাংলাদেশে আরো বেশি বেশি পর্যটক আসবে।
লেখক: পর্যটন গবেষক এবং ব্যবস্থাপক (পিআর অ্যান্ড এসপি), বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন