আজকাল সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই নজরে আসে দেশের তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন ধরনের মাদকের দিকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। আবার অন্যদিকে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র-ছাত্রী জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটি নিশ্চয়ই আমাদের জন্য একটি অশনীসংকেত। ইউ.এন.এফ.পি.এ ২০১৫ সালের প্রতিবেদের উল্লেখ করেছে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগ লোক তরুণ-তরুণী। যেখানে দেশের আগামী ভবিষ্যত নির্ভর করছে তরুণ প্রজন্মের উপর, সেখানে এই যুব সমাজ যদি ধ্বংসের পথে ধাবিত হয় তাহলে আমাদের সামনে ঘোর অন্ধকার ছাড়া আর কী বা থাকতে পারে। এরকম পরিস্থিতির অনেক কারণ রয়েছে। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হচ্ছে তরুণ-তরুণীদের নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব।
তরুণ-তরুণীদের মাদকের নেশা ও জঙ্গীবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে আমাদের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তন্মেধ্যে হচ্ছে- এদেরকে নিঃসঙ্গতার হাত থেকে রক্ষা করে বিভিন্ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা। দেশের বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণীয়স্থানে বা গন্তব্যে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কতৃপক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নিতে হবে। এতে সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। তরুল-তরুণীরা যতবেশি ঘুরে বেড়াবে ততবেশি দেশকে জানবে, জ্ঞান অর্জন করবে এবং একসময় তারা পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজে অংশগহণ করবে। মাদক এবং নেশার ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারবে। অবসরের সময়টুকু তারা ভ্রমণে ব্যয় করলে মাদক ও জঙ্গীবাদ তাদেরকে স্পর্শ করতে পারবেনা।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসকল দেশের তরুণ-তরুণীরা বেশি বেশি ভ্রমণ করে, সে সকল দেশের যুবসমাজ মেধাবী ও সৃষ্টিশীল হয়। ভ্রমণ করা তো শুধু বিনোদনের জন্য নয়। বেশি বেশি ভ্রমণ করলে জ্ঞান বাড়ে । গ্রীক ও রোমান যুগে এবং মেসোপটেমিয়ার মানুষ ভ্রমণ করতো ব্যবসা, শিক্ষা এবং নতুন নতুন জাতির সাথে পরিচিত হতে।
মানুষ যত বেশি ভ্রমণ করবে ততবেশি জ্ঞানের পরিধি বাড়বে। নতুন নতুন পরিবেশ ও সমাজের সাথে সখ্যতা ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে এবং অনুপম সাংস্কৃতিক উপাদান খুঁজে পাবে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পর্যটনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর সংস্কৃতির বিভিন্ন কার্যক্রমে নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারলে, তরুণরা আর মাদক এবং জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হবেনা।
তরুণ-তরুণীরা বেশি বেশি ভ্রমণ করলে তাঁদের নিসঙ্গতা দূর হবে। নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানের অভিযোজন ক্ষমতা বাড়বে। সোসালাইজেশন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। চিন্তার প্রসার ঘটবে। তারা শরীরে প্রতি যতœবান হবে। নেশা এবং জঙ্গীবাদ তাদের আর গ্রাস করতে পারবেনা। এজন্য তরুণ-তরুণীদের সেরকম পরিবেশ তৈরী করে দিতে হবে আমাদেরকেই। তাদের পথ দেখিয়ে দিতে হবে, সুযোগ তৈরী করে দিতে হবে। শুধু সমালোচনা করলে বা উপদেশ দিলেই চলবেনা। এরা যাতে স্বল্প খরচে কিংবা বিনা খরচে বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করতে পারে সেজন্য জেলা প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসনসহ সকল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। বিআরটিএ বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে গাড়ি দিতে পারে। স্থানীয় হোটেল, রেস্টুরেন্টগুলো তাঁদের কর্পোরেট সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সি.এস.আর.) হিসেবে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ভ্রমণকারী তরুণ-তরুণীদের অফার করতে পারে। বিভিন্ন গন্তব্যে স্থানীয় কমিউিনিটিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে হোম-স্টে ব্যবস্থা করলে তরুণ-তরুণীরা সেখানে আহার এবং রাত্রিযাপন করতে পারবে। এজন্য সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং কর্মশালা করে তরুণ-তরুণীদের ভ্রমণ বিষয়ে সচেতন করা যায়।
বর্তমান সময়ে তরুণ-তরুণীরা ভ্রমণ করছে। দিন দিন তাদের পর্যটনের দিকে বিশেষকরে এ্যডভেঞ্চার পর্যটনের দিকে আগ্রহ বেড়েছে। এটা একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু অন্যান্য তরুণ-তরুণীরা যারা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বড় হচ্ছে, বাবা-মার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে তাঁদের জন্য পর্যটনের বিভিন্ন প্যাকেজ চালু করা প্রয়োজন।
বিভিন্ন গন্তব্যে বা গ্রামে তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন গবেষণামূলক এবং কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করার প্রোগ্রাম বা প্যাকেজ চালু করা যেতে পারে। সেখানে গিয়ে তারা শিখতে পারবে কিভাবে ধানচাষ, গমচাষ, আখচাষ বা অন্যান্য আবাদ করা হয়। জাপানসহ বিভিন্ন দেশে এরকম প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। আমি নিজে দেখেছি সেখানে ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের জন্য আলাদা-আলাদা পরিবহন রয়েছে। এমনকি সরকার থেকে তাদের জন্য আলাদা প্লেনের ব্যবস্থা করে রেখেছে। প্লেন বোঝাই করে ছাত্র-ছাত্রী এবং যুবসমাজকে দেশের অভ্যন্তরে এক স্টেট থেকে অন্য স্টেটে নিয়ে যাচ্ছে। এজন্যই সেই দেশের তরুণ-তরণীরা মাদকে আসক্ত কিংবা জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকছেনা। শুধু ঘরের কিংবা স্কুলের কোণে বসে যে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যায়না তারা ভালো করে জানে। এজন্য পাঠ্যপুস্তকের বিদ্যার পাশাপাশি তরুণ-তরুণীদের জন্য ভ্রমণ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ইদানিং ঢাকা বিশ্বাদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টে কোর্সের অংশ হিসেবে ভ্রমণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে যা খুবই আশাপ্রদ। এরকম আশাজাগানিয়া কার্যক্রম আমাদের কোন কোন বিশেষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব উদ্যোগে করছেন। ঐ সকল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এরকম কাজের আর্থিক ব্যয় বহনের জন্য কর্পোরেট অফিসগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের পর্যটন নীতিমালা ২০১০ এ তরুণ-তরুণীদের পর্যটনে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন দিক উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসকল কাজ বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে আসছে আমাদের কিছু কিছু তরুণ উদ্যোক্তা। গতবছর এবং চলতিবছর ঢাকার ধানমন্ডিস্থ রবীন্দ্র সরোবরে বাংলাদেশ ইয়ুথ ট্যুরিজম ফেস্টিভাল এর আয়োজন করা হয়েছে মাসিক পর্যটন বিচিত্রার উদ্যোগে। জনাব মহিউদ্দিন হেলাল এর উদ্যোগে এ ফেস্টিভালে সাড়া দিয়েছে হাজার হাজার যুবক-যুবারা। তারা মাদকের পরিবর্তে ভ্রমণের নেশায় আসক্ত হচ্ছে। এরকম উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে আমাদের সকলকে বাংলাদেশ এর কোটি তরুণকে এক জায়গায় আনতে হবে। ভ্রমণে তাঁদের উৎসাহিত করতে হবে। মাদকের ভয়াল গ্রাস আর জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে পর্যটন হতে পারে একটি কার্যকর হাতিয়ার।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং পর্যটন বিশ্লেষক।