করোনা ভাইরাসের সাথে জীবন ও জীবিকার যুদ্ধ চলমান। এর মধ্যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বৈশ্বিক উদ্যোগের অন্যতম হচ্ছে পর্যটন। কেন না বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল এমনকি স্বল্প উন্নত দেশের অধিকাংশই এখন পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। এজন্য গোটা বিশ্বে পর্যটন পুনরুদ্ধারে সবাই একাট্টা। কারণ, যদিও পর্যটন কর্মকাণ্ড প্রাথমিকভাবে অভ্যন্তরীন পর্যটন দিয়ে শুরু হবে তবুও তাকে “নিউ নরমাল” বা নতুন বিশ্ব উপযোগী করা খুবই কঠিন। বলতে গেলে পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি লক্ষ কোটি পর্যটন কর্মীকে বাঁচানো এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা।
এসব সমস্যা মোকাবেলায় সার্বিক নেতৃত্ব ও পরামর্শ সহায়তা দিচ্ছে পর্যটনের বিশ্ব মুরুব্বী জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা বা ইউ এন ডাবলু টি ও। তাদের দেয়া পরামর্শে প্রতিটি সদস্য দেশ নিজেদের করে সমস্যা মোকাবেলা করছে এবং প্রস্ততি নিচ্ছে। এ নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তার সাথে আমাদের সরকারী এবং বেসরকারী খাতের করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ পর্যায়ে আমরা “বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড” বা বিটিবি এর পর এবার “বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন” বা বাপক এর করণীয় নিয়ে আলোচনা করবো।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বা বাপক ১৯৭৩ সালে তার যাত্রা শুরু করে ভালোই চলছিল। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে কাজ করতে গিয়ে তাকে আমলাতান্ত্রীক কোন জঠিলতায় পড়তে হয়নি। তাছাড়া ইউ এন ডি পি এবং আই এল ও’র সহায়তা থাকায় আন্তর্জাতিক পর্যটনের বলয়ে থেকে অনেকটা স্বাধীনভাবেই কাজ করতে সক্ষম ছিল। তাই সংস্থাটি বেশ দক্ষতা এবং সুনামের সাথে মানুষের মাঝে ভ্রমণ এবং পর্যটনকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। মানুষকে শেখায় কি করে পর্যটনকে শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ, পেশা, ব্যবসা, বিনিয়োগ ইত্যাদি কাজে লাগানো যায়। কিন্তু পরবর্তীতে বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসার পর সবকিছু পালটে যায়। সরাসরি আমলাতন্ত্রের অধীনে আসায় এর আছর লাগে এবং বিমানের মত দানবের নীচে চাপা পড়ে। এতে বাপক তার স্বকীয়তা হারায় এবং কর্মকাণ্ডের গতি হারিয়ে ফেলে।
শেষতক পর্যটন শিল্প সম্পৃক্ত সবার দাবী ও প্রবল ইচ্ছাকে পদদলিত করে আমলাদের কারসাজিতে ২০০৮ সালে একক “পর্যটন আইন” প্রণয়ন না করে ২০১০ সালে করা হয় আলাদা “পর্যটন বোর্ড” আইন। এতে আইনগতভাবে বাপক অনেকটা ফোকলা হয়ে শুধু ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড এবং প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ নিয়েই সন্তোষ্ট থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড বা বিটিবি অনেকটা কাগুজে বাঘে পরিণত হয়। কেন না হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, শত শত মানুষের জনবল, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও পরিচিতি সবই থেকে যায় বাপকের কাছে। তাই এসব ঘাটতি নিয়ে এন টি ও হিসেবে বিটিবি’র পক্ষে এখন পর্যন্ত কোমর সোজা করে পর্যটন উন্নয়ন ও প্রচারের এতসব দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছেনা। তার উপর এসে পড়েছে করোনায় লণ্ডভণ্ড নাজুক শিল্প পর্যটনের সাথে সম্পৃক্ত জনবল ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচানো এবং পর্যটন পুনরুদ্ধার করে একে সচল করার গুরু দায়িত্ব। কিন্ত তা বিটিবি’র পক্ষে যে অনেকটা দুরূহ এবং প্রায় অসম্ভব তা সরকার তথা সকল পক্ষকে মেনে নিতে হবে এবং সবাইকে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে অন্তত এই আপোদকালীন সময় মোকাবেলা করতে হবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বা বাপকের উপর বিশেষ গুরুদায়িত্ব বর্তাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাপক তার আবাসিক স্থাপনাগুলো করোনা যুদ্ধাদের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিয়েছে এবং কিছু কিছু ত্রাণ বিতরণ করেছে। আবার আবাসনের ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগ ছাড়ের ঘোষণাও দিয়েছে। এজন্য বাপক অবশ্যই ধন্যবাদ পাবে। তারপরও পর্যটনের এই বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য বাপককে তার দেশজুড়ে ত্রিশের অধিক ব্যবসায়ীক স্থাপনা, শত শত অভিজ্ঞ জনবল, দেশ সেরা পর্যটন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, বিশাল সম্পদ ও পরিচিতি ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে যা যা করতে হবে তা হলোঃ
১। এন এইস টি টি আই থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা দক্ষ পর্যটন কর্মী হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় চাকুরী হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তাদেরকে প্রয়োজনে বাপকের নিজস্ব তহবীল থেকে হলেও সাধ্যমত আর্থিক সাহায্য এবং অনুপ্রেরণা ও মানসিক সহায়তা দেয়া।
২। নিউ নরমালে পর্যটন শিল্পে যাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি দেখা না দেয় সে লক্ষে সরকারের তরফ থেকে প্রশাসনিক মন্ত্রণায়ের মাধ্যমে তহবীল গঠন করে যেসব দক্ষ ও অভিজ্ঞ পর্যটন কর্মী এই পেশা থেকে ঝরে পড়ছেন তাদেরকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাছাই করে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য সহযোগীতার ব্যবস্থা করা ।
৩। ট্যুর অপারেশন, ট্র্যাভেল এজেন্সি, ম্যানেজিং ও সুপারাভাইজিং, ট্যুর গাইডিং, হাউসকিপিং, ফুড সার্ভিস,ফুড প্রিপারেশন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যমান ও দক্ষ পর্যটন কর্মীদের জন্য নতুনভাবে শুরু হতে যাওয়া পর্যটন কর্মকাণ্ড উপযোগী এবং এস ও পি তথা স্বাস্থ্যবিধি ও অন্যান্য পর্যটন আচরণবিধি সম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ।
৪। নিউ নরমালে যেহেতু দেশের সবগুলো পর্যটক গন্তব্যে পর্যটকদের আগমনের অনুমতি দেয়ার সুযোগ থাকবেনা সেহেতু প্রধান প্রধান গন্তব্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর বিধ্বস্ত সাধারণ অবকাঠামো ও পর্যটন অবকাঠামোর ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৫। প্রথম পর্যায়ে এবং প্রাথমিকভাবে পর্যটন কর্মকাণ্ড চালু হতে পারে এমন পর্যটক গন্তব্যগুলো এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য গন্তব্যগুলোর পর্যটন পণ্য ও সেবা চিহ্নিত করে সেগুলোর মান বৃদ্ধি করা।
৬। পর্যটক গন্তব্যগুলোতে সার্বিক পর্যটন কর্মকাণ্ড সূচারুরূপে পরিচালনা করা, স্থানীয় পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশ এবং টেকসই পর্যটন নিশ্চিত করাকে সামনে রেখে অনতিবিলম্বে পর্যায়ক্রমিকভাবে রেসপনসিবল বা দায়িত্বশীল পর্যটন শুরু করার লক্ষে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় চিহ্নিত সাতটি অংশিদারকে নিয়ে কমিটি গঠন করা।
৭। বাপকের “ট্যুর ডিভিশন”-কে আরো শক্তিশালী করে অভ্যন্তরীণ পর্যটনে নেতৃত্ব দেয়া এবং বেসরকারী খাতকে শৃঙ্খলা বজায় রেখে ও নিয়মনীতি মেনে ট্যুর পরিচালন শুরু করার ব্যাপারে সার্বিক সহায়তাদানে সক্ষম করে প্রস্তুত করা।
৮। পর্যটক এবং পর্যটন সেবা প্রদানকারী পক্ষগুলো যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি ও অন্যন্য নিয়মাবলী মেনে যথারীতি পর্যটন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে কি না তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা।
অবশ্য এসব দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইনে যাই লিখা থাকুক আর যেই এন টি ও হোক না কেন প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় তথা সরকার তার প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বিবেচনা করেই দায়িত্ব বণ্টন করে থাকে এবং এভাবেই গত অর্থ বছরে বাজেট বরাদ্দও রেখেছে। এবারও তার কোন ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। সে অনুযায়ী বাপকের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে দেশের বিদ্যমান ও সম্ভাব্য পর্যটক গন্তব্যগুলো চিহ্নিতকরণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, আধুনিকীকরণ, পর্যটন পণ্য উন্নয়ন এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি কাজগুলো। তাই যোগ্যতা, সক্ষমতা ও ন্যায়পরায়নতার বিচারে বাপকই হচ্ছে এসব কাজ করার অধিকারী। তার সাথে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন আগেকার মত তার নিজ মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে সংকটে পড়া দেশের পর্যটন শিল্পকে পুনরুদ্ধারে গৌরবময় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।