পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
পর্বতপ্রেমী বড় ভাইয়ের লাইফের প্রথম হাইকিংয়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সময় উঠে এসেছে আলীর সুড়ঙ্গের নাম। আলীকদম থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দূরে মাতামুহুরি-তৈন খাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দুই পাহাড়ের চূড়ার মাঝে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট আলীর সুড়ঙ্গ তখন ছিল তাদের জন্য এক রহস্যের নাম।
যে পাথুরে পাহাড়ে এই সুড়ংঙ্গের অবস্থান তার নাম আলীর পাহাড়। এই সুড়ঙ্গ নিয়ে রহস্যের যেন শেষ নেই। নানা রুপকথা, উপকথা, কিংবদন্তি এই নিয়ে। স্থানীয়দের কাছে এই গুহা আলীর সুরম নামে বিশেষ ভাবে পরিচিত। সরকারি নথিতে ঘুরছে সে পুরাকীর্তি হিসাবে। তাদের মুখে আলীর সুড়ঙ্গ নিয়ে মিথ, কল্পকথা শুনে এখানে যাবার জন্য একটা ফ্যাসিনেশন তৈরি হয় আমাদের মধ্যে।
কিংবদন্তি বলে হযরত শাহজালাল-এর নেতৃত্বে ৩৬০ আউলিয়া যখন এই বঙ্গদেশে আসেন তাদের একটি দল ধর্ম প্রচারের কাজে সিলেট অঞ্চলে আসেন। আর একটি অংশ আসে পার্বত্য এলাকায়। সেই দলে আলী নামে কোনো আউলিয়া ছিলেন যিনি বান্দরবানের এই অংশে ধর্ম প্রচারের কাজে আসেন। তার কদমেই এই অঞ্চলে ইসলামের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার হয়েছিল বিধায় জায়গাটির নাম হয়ে যায় আলীকদম। তবে সুড়ঙ্গের নামের পিছে রহস্যটি আজও আজানা রয়ে গেছে।
টিওবি’র লেখার সূত্র ধরে আমাদের আলী কদমের অভিযান শুরু হলো তুক অ দামাতুয়া ট্রেইল দিয়ে। এরপর ডিম পাহাড় পাড়ি দিয়ে চলে এলাম গল্পের আলী কদমে। পরের দিন শুরু হলো আলীর সুড়ংঙ্গের যাত্রা। তুক অ ঝর্ণায় যাবার ফলে আগের দিন বেশ ধকল গিয়েছিল দেহে, তবে এখানেও যে এতটা ভয় জাগানো ট্রেকিং করতে হবে তা ছিল ধারণার বাহিরে।
চান মিয়া, কায়েস আর ঈসমাইল ভাই কে নিয়ে আমাদের এই ছোট দলটি ছুটে চলছে আলীর সুড়ঙ্গের উদ্দ্যেশে। দু-পাশে বৃক্ষের সারি ছায়াদানি মা হিসেবে সড়কে যেন ঝাঁকিয়ে বসেছে। পিচঢালা আঁকাবাঁকা সড়কের রোমাঞ্চে ডুবে ছিলাম আমরা। পাশ দিয়েই তো কুল কুল করে বয়ে চলছে মাতামুহরী নদী। নদীর দুই তীরেই তামাকের ক্ষেত।
নদীর জলে সাত-সকালে জীবন সংগ্রামে নেমেছে পাহাড়ের সন্তানেরা। বাশের ভেলায় কলার গাছি, মরিচ ও নানা ধরনের শাক-সবজি নিয়েই যেন ভাসিয়েছে তাদের জীবন সংগ্রামের তরী। পূর্ব দিগন্তে চোখ মেলে তাকানোর সাথে সাথেই আমাদের অটোয়ালা মামা বলে উঠলেন ওই যে আলীর পাহাড়।
আমাদের অটো বাজারের মত জায়গায় এসে ভিড়লো। অটো এখানে রেখে বাজারের এক দোকানে বসলাম। দোকানদার মামা এক চিলতে হাসি দিয়ে গদ গদ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘গাইড লাগবে মামা’। আমরা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ানোর সাথে সাথেই দুম করে এসে পড়লো গাইড। চার ফুটিয়া গাইডের এখনও লেংটি পড়ার বয়স শেষ হয়নি। সে আমাদের নিয়ে যাবে আলীর সুড়ঙ্গে। শুরু হল আমাদের যাত্রা পিচ্চি গাইডকে নিয়ে।
মাতামুহরী নদী নৌকা দিয়ে ক্রস করার পর একটি সরু পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে গিরিখাদ পেলাম। গিরিখাদ পেরিয়ে যখন এক চিলতে সরু পথ দেখতে পেলাম তখনই মনটা বেশ বিচলিত হয়ে উঠলো। সে পথ দিয়ে একটু এগোতেই বায়ে দেখতে পেলাম ঝিরির মুখ। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা আকৃতির পাথর আর পচা গাছের গুড়ি। এই রহস্যময় পথ ধরে আমাদের পথ চলা। অবাক ব্যাপার, বাহিরে দরদরিয়ে ঘামলেও সুড়ঙ্গে যাবার পথটা ছিল বেশ ঠাণ্ডা।
ঝিরির সামনের দিকের পথ বেশ চওড়া হলে আস্তে আস্তে কমতে থাকে এর প্রশস্ততা। ঝিরির পানি মাড়িয়ে যেতে বেশ ভালো লাগছিল। এক সময় পথটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বামের পথে গেলে পাওয়া যাবে একটা সরু খাদ, তাকে পাশ কাটিয়ে পাথরের চাংগর আর গাছের গুড়ির ওপর ভর দিয়ে উপরে উঠলেই দেখা যাবে একটা লোহার সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠাটা বেশ বিপজ্জনক। কারণ এর বাম পাশে কিছুটা ভাঙা। কে বা কারা এই সিঁড়িটা বানিয়ে রেখেছে তা জানি না। তবে চিন্তায় পড়ে গেলাম, এই সিঁড়ি না হবার আগে মানুষজন কীভাবে ওপরে উঠতো?
সিঁড়ির মাথায় ওঠার পর কয়েক ফুট উঁচু এক পিচ্ছিল চড়াই। কোনোমতে এই পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে সামনে যাওয়া মাত্রই গ্রাস করলো নিকষ কালো অন্ধকার। কালি গোলা অন্ধকারে টর্চ লাইটের আলো ফেলা মাত্রই বাদুড়ের ঝাপটাঝাপটির শব্দ শুনলাম। আলোর প্রতিফলনে সুড়ঙ্গের দেয়ালে এক অদ্ভুত সোনালী রূপ দেখতে পেলাম। সুড়ঙ্গের রাস্তা মসৃণ নয়, কিছুটা এবড়ো খেবড়ো। তাই আলো ফেলে চলতেও বেশ সমস্যা হচ্ছিল।
এক সময় এই পথের শেষ হয়, সুড়ংগের ছাদটা যেন নেমে এলো আরও নিচের দিকে। হামাগুড়ি দিয়ে হয়তো আর একটু এগুনো যেত কিন্তু সুড়ংগের পথটি দুভাগ হয়ে গেছে। কোনোটা দিয়ে মানুষ ঢোকার পথ নেই। তো এখানে বসেই কিছু ছবি তুলে নিলাম। এরপর যে পথে এসেছি সে পথে ফিরে গেলাম। যাত্রা এবার শুরু হলো দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের উদ্দেশ্যে।
দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ থেকে তৃতীয় সুড়ঙ্গে বেড়ানোর পথ আছে আমাদের পিচ্চি গাইড বললো। সুড়ঙ্গে ওঠার মুখেই দেখতে পেলাম একটা মাদার ট্রির পাশ দিয়ে যাবার সরু রাস্তা। সেখানে সুন্দর করে গাছের গুড়ি আর দড়ি দেয়া আছে উপরে ওঠার জন্য। গাছের গুড়ির ওপর ভর দিয়ে পাথরের খাঁজে পা রেখে দড়ি ধরে পরের পাথরের খাঁজে পা রাখতে বেশ বেগ পেতে হলো। আমাদের টিম মেম্বারদের অনেকের কালো ঘাম ছুটে গেলে এই ধাপটি পার করতে। উপরে ওঠার পর আবার সরু রাস্তা।
খানিকটা দূর এগানোর পর দেখতে পেলাম সুড়ঙ্গে ঢোকার রাস্তা, যেটা দিয়ে কোনো রকমে একটা মানুষের ঢোকা সম্ভব। কোনো রকমে উপরে ওঠার পর টর্চ মেরে দেখলাম সামনে যাবার জন্য হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে। মুখটা এত নিচু, দাঁড়িয়ে চলা সম্ভব না। আলো অমানিশার মাঝে শুনতে পেলাম হিস-হিসানির শব্দ৷ যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। বাঘকে রিপ্লেস করে সাপের ভয় বুকে ঝাঁকিয়ে বসলো। এখন ফেরার কোনো উপায় নেই।
কিছুটা পথ হামাগুড়ি দিয়ে পাড় হবার পর সুড়ঙ্গের মুখটা বড় হলো। উঠে পড়লাম। আবার সেই এবড়ো-থেবড়ো পথ পাড়ি দিয়ে এসে পড়লাম সুড়ংগের মাথায়। এখানে এসে থেমে গেল আমাদের যাত্রাপথ। কারণ এর পরের স্টেপ পার করতে এক্সট্রিম লেভেলের তেল খরচ করতে হবে। এই সুড়ংগের মাথা থেকে দেখা যাচ্ছে তৃতীয় সুড়ংগের মুখ। কিন্তু আমাদের পিচ্ছিল গিরিখাদ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে ওপার। আমাদের কাছে দড়ি থাকলে হয়তো পার হবার চেষ্টা করতাম। পথ পাড়ি দিতে হলে জানের উপর দিয়ে যাবে।
এর মধ্যে একটা পাথরের উপর দেখতে পেলাম ময়লা কুরআন শরীফ, মোমবাতি। কিছুটা অবাক হলাম কারণ কুরআন শরীফের এই রকম অবমাননা কোনো মুসলিমের পক্ষে করা সম্ভব না। বাপ-দাদাদের মুখে শুনতাম পাহাড়ের গভীরে নাকি জাদু টোনা কুফরী কালাম করা হয়। কতটুকু সত্য মিথ্যা তা জানি না। তবে মাথায় এক রহস্যের ঘোর নিয়ে বের হলাম আলীর সুড়ঙ্গ থেকে।