ভ্রমণ মানেই নতুন জায়গা, নতুন অভিজ্ঞতা, আর জীবনের রুটিন থেকে সাময়িক বিরতি। কিন্তু দীর্ঘ ভ্রমণ, বিশেষ করে বাস, ট্রেন বা বিমানে দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর, শরীর ও মনের উপর এক ধরনের ক্লান্তি নেমে আসে। এতে ভ্রমণের আনন্দ অনেক সময় ম্লান হয়ে যায়। দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণে ক্লান্তি কমিয়ে আনতে কিছু কার্যকরী উপায় জানা থাকলে পুরো ভ্রমণটা হতে পারে অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক ও উপভোগ্য।
এই প্রতিবেদনে দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্তি কমানোর ১২টি কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
১. ভ্রমণের আগেই পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন
ভ্রমণে বের হওয়ার আগের রাতে ভালো ঘুম না হলে, শরীর আগে থেকেই ক্লান্ত থাকবে। ফলে ভ্রমণের সময় সেই ক্লান্তি দ্বিগুণ হয়ে উঠবে। তাই যাত্রার আগের রাতে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো জরুরি। রাতে ঘুমাতে সমস্যা হলে হালকা গরম দুধ, আরামদায়ক পরিবেশ ও নিরবতা ঘুমে সহায়ক হতে পারে।
২. আরামদায়ক পোশাক পরুন
দীর্ঘ যাত্রায় শরীরকে আরাম দেওয়া সবচেয়ে জরুরি। টাইট পোশাক, সিন্থেটিক ফ্যাব্রিক বা ভারী জামাকাপড় শরীরে অস্বস্তি তৈরি করে ক্লান্তি বাড়িয়ে তোলে। এ কারণে সুতি বা পাতলা নরম কাপড়ের পোশাক পরুন। আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে অতিরিক্ত কাপড় বা চাদর সঙ্গে রাখুন।
৩. সময় মতো পানি পান করুন
ভ্রমণের সময় অনেকেই পানি কম খান যাতে বারবার বাথরুমে যেতে না হয়। কিন্তু শরীরকে হাইড্রেটেড না রাখলে ক্লান্তি, মাথা ব্যথা, ওজনে ভার লাগা এসব সমস্যা হয়। তাই প্রতি ঘণ্টায় অন্তত একবার ১/২ গ্লাস করে পানি পান করুন এবং বোতলজাত মিনারেল ওয়াটার সঙ্গে রাখুন।
৪. হালকা ও স্বাস্থ্যকর খাবার খান
ভ্রমণে ভারী ও তৈলাক্ত খাবার খেলে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, হজমে সমস্যা হয়, এবং ঘুম ঘুম ভাব আসতে পারে। এ জন্য ফল, বাদাম, স্যান্ডউইচ, বিস্কুট, ও হালকা খাবার সঙ্গে রাখুন। বেশি লবণ ও চিনি এড়িয়ে চলুন।
৫. মাঝে মাঝে হালকা স্ট্রেচিং করুন
যদি আপনি বাস, ট্রেন বা বিমানে ভ্রমণ করেন, অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকলে পায়ের পেশি শক্ত হয়ে যায়, রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। তাই প্রতি ১-২ ঘণ্টা পর একটু দাঁড়িয়ে হালকা হাঁটা বা স্ট্রেচিং করুন; হাত-পা ঘোরান, ঘাড় ঘোরান।
৬. শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলুন
ভ্রমণে ক্লান্তি কমাতে আগে থেকেই নিয়মিত হালকা ব্যায়ামের অভ্যাস রাখলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। প্রতিদিন অন্তত ২০-৩০ মিনিট হাঁটাচলা বা হালকা যোগব্যায়াম করতে পারেন। শরীর যত ফিট থাকবে, ভ্রমণ তত সহজ হবে।
৭. মানসিক প্রস্তুতি নিন
অনেক সময় ভ্রমণের মানসিক চাপ – সময়মতো পৌঁছানো, টিকিট, ব্যাগ, নিরাপত্তা – এগুলো ক্লান্তির অন্যতম উৎস হয়। এ কারণে যাত্রার পরিকল্পনা আগেই করুন। কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিভাবে যাবেন – সব লিখে নিন। কিছু ভুল হতেই পারে – মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলে চাপ কম হয়।
৮. আরামদায়ক আসন বেছে নিন
ভ্রমণের সময় আসনের আরাম অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিমানে বা ট্রেনে জানালার পাশে বসলে মাথা হেলানো যায়। বাসে যাত্রার সময় সামনের আসন তুলনামূলকভাবে কম কাঁপে। হেড রেস্ট, নেক পিলো ও ল্যাম্বার সাপোর্ট ব্যবহার করুন।
৯. হালকা বিনোদন উপভোগ করুন
দীর্ঘ সময় বসে থাকতে থাকতে একঘেয়েমি এসে পড়ে, যা মানসিক ক্লান্তির জন্ম দেয়। তাই পছন্দের গান শোনা, অডিওবুক, পডকাস্ট, হালকা সিনেমা এসব মানসিক প্রশান্তি দেয়। বই পড়তেও পারেন।
১০. পর্যাপ্ত বিরতি নিন
ড্রাইভিং করে ভ্রমণ করলে প্রতি ২ ঘণ্টা পরপর বিরতি নেওয়া জরুরি। একইভাবে দীর্ঘ ট্রেন বা বাস যাত্রায়ও স্টপেজে একটু হাঁটা, প্রস্রাব-পায়খানা, হালকা নাস্তা – এগুলো ক্লান্তি কমায়। বিরতি নিয়ে হালকা হাঁটা শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়। একঘেয়েমি ভাঙে, মন ভালো হয়।
১১. সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলুন
একাকীত্ব ও নিরবতা দীর্ঘ যাত্রাকে আরও ক্লান্তিকর করে তোলে। তাই পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সঙ্গে মজার গল্প, স্মৃতি রোমন্থন করুন। নতুন কারো সঙ্গে আলাপ করলে সময় দ্রুত কেটে যায়।
১২. প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে রাখুন
ভ্রমণের সময় যেসব ছোট জিনিসপত্র লাগে, সেগুলো সঙ্গে থাকলে অপ্রত্যাশিত ঝামেলা কম হয় এবং মানসিক চাপ কমে। যেমন: চোখ ঢাকার মাস্ক; কানের হেডফোন; নেক পিলো; ওষুধ (মাথাব্যথা, বমিভাব, গ্যাস্ট্রিক); টিস্যু ও স্যানিটাইজার; পাওয়ার ব্যাংক ইত্যাদি।
দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্তি অনেকাংশেই স্বাভাবিক ব্যাপার, তবে সচেতন পরিকল্পনা ও কিছু সহজ পন্থা অনুসরণ করলেই এই ক্লান্তিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। শরীর ও মনকে আরামে রাখার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, হালকা খাবার, বিশ্রাম, ও সময়ানুবর্তিতা অপরিহার্য। ভ্রমণ যেন কষ্ট না হয়ে আনন্দের স্মৃতি হয়ে থাকে, তার জন্যই প্রয়োজন কিছু বাস্তবমুখী অভ্যাস।