লেখকঃ ড. মো. আনিসুর রহমান
আমার উচ্চতার তুলনায় এটার উচ্চতা বেশি ছিল বলে প্রথমদিকে এক বগলের নিচে সিট রেখে অন্য হাতে হ্যান্ডেল ধরে, এক পা সাইকেলের বডির ভেতর দিয়ে অন্য প্রান্তের প্যাডেলের ওপর রেখে বেশ কসরত করে চালাতাম। পরের শ্রেণিতে উঠে যখন সিটে বসে চালাতে শিখলাম তখনও দুই পা একই সঙ্গে প্যাডেলের নাগাল পেত না। এক পা দিয়ে প্যাডেলে যখন চাপ দিতাম তখন অন্য পা শুন্যে উঠে যেত। অবশ্য সিট থেকে শরীর রডের ওপর নামিয়ে এনে দাঁড়িয়ে চালালে দুই পা একই সঙ্গে প্যাডেলের নাগাল পেত।
তখন পিরোজপুরের অধিকাংশ রাস্তা ছিল ইট বিছানো। তবু ‘শহর ছাড়া রাঙা ইটের ওই অমসৃণ’ পথগুলোই মন ভোলাত। সেইসব পথ ধরে শহরের যে কোনো দিকে ২/৩ কি.মি সাইকেল চালিয়ে গেলেই দুপাশে ধানক্ষেত আর নদী-নালা যখন চোখে পড়ত, তখন সব অবসাদ দূর হয়ে মনটা সতেজ হয়ে উঠত। কলেজ জীবন পর্যন্ত একদিনে ২০ কি.মির বেশি চালাইনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হলে ছিলাম বলে সাইক্লিংয়ে ভাটা পড়ে। ১৯৯৫ সালে লেকচারার হিসেবে নিয়োগপাপ্তির পর সাইক্লিং পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। সমাজে চলমান ভুল ধারণায় চালিত হয়ে আমিও ভাবতে শুরু করেছিলাম যে, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদমর্যাদার সঙ্গে সাইক্লিং যায় না!
সেই ভুল ভাঙল যখন ১৯৯৮ সালে MSc করতে ব্যাংককের AIT-তে গেলাম। সেখানে ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে প্রফেসর পর্যন্ত সবাই সাইকেল চালাতেন। একজন ছাত্র বা ছাত্রী AIT-তে ভর্তি হওয়ার পর তার অন্যতম প্রথম কাজ ছিল হাজার চারেক বাথ দিয়ে একটা সাইকেল কিনে ফেলা। আর সাইক্লিং আগে শেখা না থাকলে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে শিখে নেয়া। ভিন্ন ভিন্ন ক্লাস অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন ভবনে হত, যেই ভবনগুলো আবার সব সময় কাছাকাছি নয়। প্রত্যেক ভবনের সামনেই সুশৃংখলভাবে সাইকেল রাখার জন্য সুব্যবস্থা ছিল। প্রতি তলায় তিনজন ছাত্র বা ছাত্রী থাকতে পারে এমন দ্বিতল ভবনে ছাত্র-ছাত্রীরা থাকতো। এরকম কয়েকটি ভবনের সমষ্টি অভিহিত হতো ভিলেজ নামে। ভিলেজ-১, ভিলেজ-২, ভিলেজ-৩ ইত্যাদি। আমরা এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যাওয়ার জন্য, বিকালে বেড়ানোর জন্য, বাজার করার জন্য সাইকেল ব্যবহার করতাম। পুরো ক্যাম্পাসটাই ছিল সাইকেলবান্ধব।
প্রফেসরদের সাইকেল চালানো দেখে দেখে শিখে নিলাম- যে কোনো বয়সী বা যে কোনো পদমর্যাদাধারীর জন্য সাইকেল সমানভাবে এক শরীরবান্ধব আনন্দময় বাহন।
২০০০ সালে MSc এর একটা টার্ম জার্মানির TU-Dresden বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। ড্রেসডেনে মাত্র মাস চারেক ছিলাম বলে সেখানে সাইকেল কিনি নাই। তবে এক বন্ধুর একটা গিয়ার ওয়ালা সাইকেল ধার করে চালাতাম। জীবনে ওই প্রথম গিয়ার ওয়ালা সাইকেল চালানো। এলবে নদীর তী ঘেঁষে গিয়ার ওয়ালা সাইকেল চালাতে চালাতে নিজেকে মনে হতো রাজা! ওখানেও আমাদের সুপারভাইজার ষাটোর্ধ প্রফেসর রাসেলকে মাঝে মাঝে সাইকেলযোগে বাসা থেকে কর্মস্থলে আসতে দেখেছি।
২০০৩ সালে কানাডয় Ottawa University-তে পিএইচডি করতে গিয়েছি। বছরের একটা বড় অংশ তুষারপাত হয় বলে সেখানে রাস্তাঘাট মাত্র ৪/৫ মাসের জন্য সাইক্লিংয়ের উপযোগী থাকে। তবুও প্রত্যেক রাস্তায় একটা লেন নির্দিষ্ট থাকে সাইক্লিংয়ের জন্য। গ্রীষ্মকালে শনিবার দিনগুলোতে অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র বাড়ির সামনে মানুষ খুব কম দামে বিক্রি করে। একে বলে গ্যারেজ সেল। একটা সাইকেল মাত্র ২০ ডলার দিয়ে কিনেছিলাম গ্যারেজ সেল থেকে। নতুন কিনতে গেলে ওটার দাম পড়ত ৩০০ ডলার। টপ গিয়ারে চিকন চাকার ওই রোড বাইকটা অনেক জোরে চলত। চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত একটা ভ্যালিতে অটোয়া নদীর পাড়ে অটোয়া শহর অবস্থিত। বেশকিছু জংগলও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এসব পাহাড়-নদী-জঙ্গলের মধ্যে সাইক্লিং করার জন্য অনেক ট্রেইল আছে। ট্রেইলগুলো দিয়ে আমার ‘পঙ্খীরাজ’টা চালিয়ে বেড়ানোকালীন নিজেকে মনে হতো দ্বিগবিজয়ে বের হওয়া কোনো অশ্বারোহী সেনা! সে সময়েই আমি মনে মনে পরিকল্পনা করেছিলাম যে, ডিগ্রি শেষে দেশে ফিরে একটা ভালো সাইকেল কিনব। প্রসঙ্গত কানাডার প্র্রধানমন্ত্রীও মাঝে মাঝে তার বাসভবন থেকে সংসদ ভবনে যান সাইকেলে চড়ে!
২০১০ সালে কানাডা থেকে পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরলাম। সোবহানী ভাইয়ের কাছে শুনলাম উনি মাস ছয়েক আগে একটা রোড বাইক কিনেছেন। কিন্তু সেটা চালিয়ে মজা পাচ্ছেন না। তাই ওটা বিক্রি করে দিয়ে একটা মাউন্টেইন বাইক কিনবেন। কানাডায় আমার রোড বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল, তাই আমি উনার রোড বাইকটা কিনে নিলাম এবং নিয়মিত চালাতে শুরু করলাম। অফিস রুমে আমার একাধিক সেট পোশাক থাকত। সাইক্লিং করে ঘেমে গেলে ভার্সিটির পুকুরে বা ডিসিপ্লিনের বাথরুমে স্নান সেরে পোশাক পাল্টে নিতাম। প্রথম দিকে ক্যাম্পাসে সাইকেল চালাতাম শুধু আমি আর সোবহানী ভাই। ২০১১ সালে প্রফেসর হওয়ার পর একাডেমিক ভবনে একদিন সাইকেল রাখছি, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নিরাপত্তারক্ষী কাছে এসে বলল-
– স্যার, একটা কথা বলব?
– বলেন
– কিছু মনে করবেন না তো?
– না
– স্যার আপনাকে সাইকেল চালানো মানায় না। একটা গাড়ি অথবা অন্তত একটা মোটর সাইকেল কিনেন।
– আমি গাড়ি থেকে নামলে আমার কাছে এসে এরকম আপন ভেবে কথা বলতে পারতেন?
– না, স্যার। তব্ওু…
– শুনেন, আমি টাকা বাচানোর জন্য সাইকেল চালাই না। প্রথমত এটা চালিয়ে আমি অনেক আনন্দ পাই। দ্বিতীয়ত এতে আমার যে ব্যায়াাম হয় তা শরীর সুস্থ রাখে। তৃতীয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ির সময় সূচির ওপর আমাকে নির্ভর করতে হয় না যা আমার স্বাধীনতা অনেক বাড়িয়ে দেয়। সর্বোপরি এটা চালানোর সময় আমি নিজেকে স্মরণ করাতে পারি যে একজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে আমার কোনো পার্থক্য নাই। এরকম আরও অনেক সুবিধা আছে বুঝলেন?
– তাইলে স্যার ঠিকই আছে।
আমার বয়স ৫০ ছুঁইছুঁই। এখনো দিনে ১২০/১৩০ কিমি সাইকেল চালানোর তৌফিক আল্লাহ দিয়েছেন। জীবনের নিয়ম মেনে এই ক্ষমতা দিন দিন কমতে থাকবে। কিন্তু শয়তানের ধোকায় পড়ে নিরহংকার থাকার ক্ষমতা যেন বিন্দুমাত্র না কমে- মহান আল্লাহর কাছে এটাই আমার প্রার্থনা।