রোগের নাম কভিড-১৯। উৎসের নাম করোনাভাইরাস। একদিকে করছে মানুষ মাইনাস। অন্যদিকে অর্থনীতি বিনাশ। এ দানবকে থামানো দুষ্কর। তাই প্রস্তুতি চলছে অন্যভাবে। হয়তো আসবে ভেকসিন, পাগলা ঘোড়া থামাতে।
তার সাথে চলবে সরাসরি মোকাবেলার নিরন্তর চেষ্টা। এতেকরে মানুষের ইমিউনিটি তথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে থাকবে। এভাবে আস্তে আস্তে যুদ্ধও স্তিমিত হয়ে আসবে। তাই দুনিয়া থেমে থাকবেনা, মানুষ তার রাস্তা সে নিজেই খুঁজে নেবে। আর তা ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। দেশে দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজও চলছে। এতে স্বভাবিকভাবেই পর্যটন অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি হিসেবে পর্যটন শিল্পের অবস্থান সুদৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত। সেই বিবেচনায় নতুন বিশ্বে পর্যটন কেমন হবে তা নির্ধারণে ইতোমধ্যে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পর্যটনের বিশ্ব মুরুব্বী ইউ এন ডাবলু টি ও থেকে শুরু করে পর্যটনের বেসরকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ডাবলু টি টি সি; ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ই ইউ এবং জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর জোট সবাই পর্যটনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় করণীয় নির্ধারণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।
অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরাসরি এবং মোটা অঙ্কের স্বার্থ রয়েছে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেরই মজবুত অর্থনীতির ভিত্তিমূলে রয়েছে এই পর্যটন। তাই তারা সময়োপযোগীতা, দায়িত্বশীলতা ও সুসমন্বয়ের মাধ্যমে আবারো পর্যটন শিল্পকে উপস্থাপনের লক্ষে বিশেষ “কর্ম পরিকল্পনা” প্রণয়ন করেছে। অন্যদিকে জি – ২০ ভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব পর্যটনের তিন ভাগের দুই ভাগই নিজেরা দখল করে আছে। তাই তারাও করণীয় নির্ধারণে একসাথে কাজ করছে।
তবে, দায়িত্ব এবং পাণ্ডিত্য বেশি থাকায় পর্যটনের বিশ্ব মুরুব্বী ইউ এন ডাবলু টি ও-কে মূল সমন্বয়কের কাজ করতে হচ্ছে। এজন্য সক্রিয় রয়েছে তাদের গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ দল। তারা বিশ্বব্যাপী চলা ধারাবাহিক ডায়লগের নির্ঝাস এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতগুলো যাচাইবাছাই করে করণীয় নিয়ে দিক নির্দেশনা তৈরী করছেন। যা বুলেটিন আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে।
এসব বুলেটিনে থাকা দিক নির্দেশনাগুলোকে আরো কার্যকর করার জন্য সংস্থাটি বলেছে, তারা অতীথের ন্যায় তাদের সদস্য ছাড়াও সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের সকলকে প্রয়োজনীয় যেকোন সাহায্য সহযোগীতা প্রদান করবে। যেজন্য বিশেষ ঘোষণা রয়েছে সরকারী খাত, বেসরকারী খাত এবং দাতা সংস্থাগুলোকে সমর্থন যোগানোর জন্য।
এসব কর্মযজ্ঞকে সামনে রেখে ইউ এন ডাবলু টি ও “ট্যুরিজম রিকভারী টেকনিক্যাল এসিসটেন্স প্যাকেজ” এর ঘোষনাও দিয়েছে। যেখানে সরকার, প্রশাসন এবং বেসরকারী উদ্যোক্তাদের করণীয় সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।
এতে সরকারগুলোর করণীয় হচ্ছে-
অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন যোগানো, পুনর্গঠন ও পরিকল্পনা কর্মসূচীতে পর্যটনকে অন্তর্ভুক্ত করা, সমাজে পর্যটনের একটি ভালো অবস্থান থাকায় পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে এটিকে অগ্রাধিকার দেয়া, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং পুনর্গঠনে সুনির্দিষ্ট নীতি নির্ধারণ করা, পণ্য বহুরূপীকরণ এবং বাজারজাতকরণ বা বিপণন নিশ্চিত করা, দায়িত্বশীল ভ্রমণ ও পর্যটন নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও দাতা সংস্থাগুলোর সাহায্য নেয়া।
আবার পর্যটন প্রশাসনের করণীয় হচ্ছে-
সরকার যেন কোন অবস্থাতেই পর্যটনের জন্য ২০২০ সালের ঘোষিত বাজেট এবং তৎসম্পৃক্ত কোন সম্পদ প্রত্যাহার না করে তা খেয়াল রাখা, পর্যটক গন্তব্য এবং পর্যটকসহ সকল পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিধি নিশ্চিত করা।
অন্যদিকে বেসরকারী উদ্যোক্তাদের করণীয় হচ্ছে-
পর্যটন কর্মী এবং জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতি সংহতি প্রকাশ করা, কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক মানসিক সাহস যোগান দেয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, উৎসাহপ্রদানমূলক ভিডিও দেখানো, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
তাছাড়া আরো কিছু পরামর্শ রয়েছে যা বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে কার্যকর আছে। এর মধ্যে রয়েছে-
হোটেলগুলো কর্তৃক বিনামূল্যে কক্ষ বরাদ্দ; পর্যটন যান কোম্পানী কর্তৃক বিনামূল্যে যান সরবরাহ; গাইডদের দ্বারা হাসপাতালের জন্য ভার্চুয়াল ট্যুর পরিচালন; সতির্থদের সাহায্যের জন্য সহমর্মিতা দল গঠন; যুবাদের ঋন দান; বিকল্প চাকুরী ইত্যাদি।
একইভাবে, ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল বা ডাবলু টি টি সি তাদের কার্যক্রম আরো জোরদার করেছে। তারা পর্যটক গন্তব্য এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য “সেফ ট্র্যাভেল প্রটোকল” কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। যেখানে থাকছে,
ভ্রমণ সেবা সরবরাহকারী, ট্যুর অপারেটর এবং ভ্রমণার্থী; ভ্রমণার্থী এবং কর্মচারীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা; ভ্রমণ এবং পর্যটন খাতের মধ্যে সুসমন্বয়।
তবে, ডাবলু টি টি সি দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা দিয়েছে, তারা যথা সম্ভব তাড়াতাড়ি পুনর্গঠন এবং শক্তহাতে নীতিমালা বাস্তবায়ন কাজে সরকারগুলোকে সর্বাত্বক সহায়তা দিবে। এজন্য যা যা করা দরকার তা হলো,
ভ্রমণ সুবিধা উন্নত করা; যেমন ভিসা ইত্যাদি; রাজস্ব নীতিকে আরো সহজ করা; যেমন ট্র্যাভেল ট্যাক্স ও এয়ারপোর্ট ট্যাক্স ইত্যাদি; বাঁধা অপসারণ করা; যেমন প্রবেশ; প্রণোদনা চালু করা; যেমন অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ ছোট এবং মাঝারি তথা এস এম ই ব্যবসায়ীদের জন্য ত্রাণ এবং প্রণোদনা; গন্তব্যগুলোকে সমর্থন করা; যেমন পণ্যের উন্নয়ন, প্রচার ও বিপণনের জন্য বাজেট বৃদ্ধি।
মোদ্দাকথা, করোনাভাইরাসে লণ্ডভণ্ড বিশ্ব আবার নতুনভাবে চলা শুরু করবে। সেক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প কেমন করে নিজেকে যুথসইভাবে সচল করবে তা এখন বড় জিজ্ঞাসা। তারই উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন সংস্থা, আঞ্চলিক জোট, মহাজোট ইত্যাদি। তার সাথে শরিক হয়ে নিজেদের আবারো সক্রিয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য দেশ। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় এবং কি করার আছে কিংবা কার কি দায়িত্ব রয়েছে এসব নিয়েও আমরা পর্যায়ক্রমে আলোচনার চেষ্টা করবো।
——-
লেখকঃ স;গঠক ও পর্যটন গবেষক।