করোনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন পড়েনা। কমবেশি সবাই এর সম্পর্কে জ্ঞাত। তবে, এই দানবকে সবাই সমানভাবে গ্রহণ করেনি। বয়স, জীবনযুদ্ধ, পরিবেশ, গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি বিচারে করোনাকে নানাভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। কেন না কখন, কোথায়, কিভাবে এবং কাকে সে তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তা ঠাহর করা কারো সাধ্যের মধ্যে নেই। তবে, আক্রমণের ক্ষেত্রে তাকে অনেকটা নিরপেক্ষ মনে হলেও মৃত্যুর ব্যাপারে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্টত পক্ষপাততুষ্টতা পরিলক্ষিত হয়।
এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন বয়স্করা। অর্থাৎ বয়স যত বেশি মৃত্যুর ঝুঁকি তত বেশি। গোটা বিশ্বের পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলে। বিশেষ করে, ইউরোপের ওল্ড হোমগুলোর শতকরা ৯০ ভাগ মানুষকে এই করোনা না ফেরার দেশে পাঠিয়ে তা প্রমাণ করেছে। এতেকরে বয়স্করা স্বাভাবিকভাবেই অধিক পরিমাণে সতর্ক, বিচলিত ও চিন্তিত। এতে অন্য বয়সের মানুষ এবং বিশেষ করে তুলনামূলকভাবে কম ও মধ্য বয়সীরা যখন লক ডাউন, কোয়ারান্টাইন, সোশ্যাল ডিসট্যানসিং আইসোলেশন ইত্যাদিকে আমলে নিতে চাচ্ছেনা বা তোয়াক্কাই করছেনা তখন বুড়োদের কাছে একমাত্র কাজ নিজেকে ঘরবন্দি রেখে জীবন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা।
তাই তাদের মধ্যে অন্য চিন্তার সাথে যোগ হয়েছে এখন কিভাবে বাঁচবো এবং জীবনের হিসাবটা মেলাবো। যেজন্য তারা কেবল অতীতকে রোমন্থন করছেন আর ভাবছেন, হায় কি করলাম এবং কি করা দরকার ছিল। অনেকে নিজে নিজে ভাবছনে, অনেকে তা অন্যদের সাথে শেয়ার করছেন। কেউ কেউ ফেসবুক ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমেও তাদের আকুতি নানাভাবে প্রকাশ করছেন। এতে অন্যরা তাদের সাহস যোগাচ্ছেন বটে কিন্তু একটি নিরেট খাটি কথা বলছেন না। আর তা হলো, মানুষের জীবনের হিসাব কোনদিন মেলানো যায়না। ডালি ভরা প্রত্যাশা নিয়ে কম বয়সে থাকে প্রস্তুতি পর্ব, মধ্য বয়সে বাস্তবায়ন পর্ব এবং শেষ বয়সে তাড়াহুড়ো পর্ব।
তাহলে কি কোন হিসাব মিলাতে নেই? তা বলা যাবেনা। তবে, যে হিসাব কখনো মেলেনা সে হিসাব নিয়ে অস্থির হওয়াও ঠিক হবেনা। শুধু যা একান্ত প্রয়োজন তা করা যেতে পারে। তাহলে প্রয়োজন কতটুকু? হ্যা, তা হচ্ছে এই সময়ে যা অবশ্য করনীয়ে তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা। অর্থাৎ জীবনযুদ্ধ তথা বাণিজ্য শেষ করে যেহেতু এবার অবসরে সেহেতু হিসাবটা হবে স্রেফ গোছানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এতে যদি কোন সম্পদ থাকে তাহলে যারা তাতে হকদার বা পাওনাদার তাদের মধ্যে আইনসম্মতভাবে ও ধর্মীয় বিধান মতে ভাগবাটোয়ারা করে দিয়ে নিজেকে শুন্য তথা কুইট করে ফেলা। তার সাথে ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক কোন বিশেষ দায়িত্ব পালন বাকী থাকলে তা সমাপ্ত করা।
তারপর? তারপর ইহকালের সব কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে ধীরে ধীরে আলাদা করে ফেলা এবং পরোকালের প্রস্তুতি হিসেবে যা যা করণীয় তা শুরু করে দেয়া। এভাবে বাকীটা জীবন নিজেকে গুটিয়ে রাখা এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করা। এক সময় মৃত্যু আসলে তাকে স্বাভাবিকভাবে আলিঙ্গন করা। কারণ, মৃত্যু শাস্বত এবং চিরন্তন কিন্তু তা অজানা। তাই মৃত্যুকে স্বরণে রাখতে হবে, কিন্তু অস্থির হওয়ার দরকার নেই। হ্যা, জীবন নিয়ে চিন্তাভাবনার এই ছকটি একান্তই আমার নিজস্ব। তবে, বাস্তবতার নিরিখে এবং বিজ্ঞান ও ধর্মের আলোকেই তা ধারণ করা।
যেমন বিজ্ঞান বলছে পঞ্চাশ পেরোলে আস্তে আস্তে গোছানোর কাজ শুরু করো। কেন না ঐ সময়ে নড়াচড়ার সাথে সম্পর্কীত স্নায়ুগুলো নষ্ট হতে থাকে। তেমনি ষাট পেরুলে অবসরের চিন্তাটা কাজে লাগাও। তখন আবার মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের ব্যস্ততা শুরুই হয় পঞ্চাশের পর। তাই শেষকালে এসে সময়ের অভাবে বাঁধে যত ঝামেলা। অতএব, জীবনটাকে হিসাব-নিকাশের জালে না জড়িয়ে অথবা মৃত্যু চিন্তায় অস্থির না হয়ে স্বাভাবিক থেকে জীবনের প্রতি আরো অধিক যত্নবান হওয়াটাই শ্রেয়। কেননা চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, End of life care should begin when you need it and may last a few days, or for months or years. আবার পাক কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, “আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ মরতে পারেনা, এজন্য নির্দিষ্ট সময় লিখিত আছে” (আলে-ইমরানঃ১৪৫)।