ভ্রমণ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। হঠাৎ কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আকর্ষণ অনেকেই উপেক্ষা করতে পারেন না। বিশেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পরিকল্পনা ছাড়া বেরিয়ে পড়া আমাদের দেশে একেবারেই নতুন কিছু নয়। তবে সমস্যা হয় তখনই, যখন গন্তব্যে পৌঁছে দেখা যায়, হোটেলে জায়গা নেই বা আগেই বুকিং না করায় কোনো হোটেলেই রুম খালি নেই।
এমন পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আতঙ্ক বা হতাশ না হয়ে, সচেতন ও কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নিলেই সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো, হঠাৎ বেড়াতে গিয়ে হোটেল না পেলে কী করবেন, তার বিস্তারিত নির্দেশনা ও করণীয়।
শান্ত থাকুন ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করুন
হোটেল না পেয়ে আতঙ্কিত বা বিরক্ত হয়ে পড়লে তা সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলে। তাই প্রথমেই মাথা ঠান্ডা রাখুন এবং কিছুক্ষণ বসে পরিস্থিতি বুঝে নিন। আপনি কোথায় এসেছেন, সেখানে আশেপাশে আরও কোন জায়গায় থাকার সুযোগ আছে কি না, তা ভাবুন।
স্থানীয় লোকজনের সাহায্য নিন
যেকোনো জায়গায় সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ও সাহায্যপ্রবণ। স্থানীয় দোকানদার, রিকশাচালক, সিএনজি ড্রাইভার, বা চায়ের দোকানের মানুষদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন—এই এলাকায় নতুন কোনো গেস্ট হাউস বা ছোট হোটেল আছে কি না। অনেকে হয়তো এমন কোনো আবাসিক হোটেলের কথা বলবেন যেটি অনলাইনেও রেজিস্টার্ড নয়, কিন্তু নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী।
অনলাইন অ্যাপ ও ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন
এখন ইন্টারনেটে যুগা। তাই হাতের স্মার্টফোন দিয়ে ‘Booking.com’, ‘Agoda’, ‘GoZayaan’, ‘Airbnb’, ‘OYO’, ‘HotelTonight’ বা Google Maps-এর মাধ্যমে আশেপাশে কোনো হোটেল খুঁজে বের করুন। অনেক সময় দেখা যায়, অনলাইনেই রুম পাওয়া যায় কিন্তু সরাসরি গেলে ‘ফুল’ বলা হয়।
এছাড়াও ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে স্থানীয় ট্রাভেল গ্রুপগুলোতেও পোস্ট দিতে পারেন। অনেক সময় স্থানীয় গাইড বা হোটেল মালিকরা এসব গ্রুপে সক্রিয় থাকেন এবং দ্রুত রেসপন্স দিয়ে সাহায্য করেন।
পর্যটন তথ্য কেন্দ্র বা থানা পুলিশের সাহায্য নিন
কিছু জনপ্রিয় ভ্রমণস্থলে পর্যটন অফিস, বিট পুলিশিং অফিস বা ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি হেল্প ডেস্ক থাকে। আপনার যদি কোনো উপায় না থাকে, তাহলে কাছের থানায় গিয়ে সমস্যাটি জানান। অনেক সময় পুলিশ সদস্যরাই স্থানীয় পরিচিত গেস্ট হাউস বা বাসাবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
গেস্ট হাউস বা বাসায় ভাড়া থাকা বিবেচনায় নিন
এখন অনেক জায়গায় ‘হোম স্টে’ বা বাসাভাড়াভিত্তিক থাকা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ নিজের বাড়ির একটি রুম ভাড়া দেন পর্যটকদের জন্য। এটা শুধু সাশ্রয়ীই নয়, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস জানারও সুযোগ তৈরি করে দেয়। এয়ারবিএনবি বা ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে আপনি এসব ব্যবস্থা পেতে পারেন।
স্থানীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ছাত্রাবাসে সাময়িক থাকার অনুরোধ করুন
বিশেষত এক রাত পার করার জন্য আপনি স্থানীয় মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় গিয়ে ইমাম, পুরোহিত বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে থাকতে চাইলে অনেক সময় তারা সহযোগিতা করেন। তবে এটি হতে হবে একান্ত প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে এবং ভদ্রভাবে অনুরোধ করতে হবে। তাছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বা কলেজ এলাকার কাছাকাছি থাকলে, ছাত্রাবাস বা মেসে স্বল্প সময়ের জন্য থাকার সুযোগও মিলতে পারে।
রাতটা অন্যভাবে কাটিয়ে দিন
অনেক সময় যদি কোনো নিরাপদ জায়গায় থাকার ব্যবস্থা না হয়, তাহলে আপনি নিচের কিছু বিকল্প ভাবতে পারেন—
- ২৪ ঘণ্টা খোলা কোনো রেস্টুরেন্ট বা চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ বসে সময় কাটান।
- রাতের শেষ ট্রেন বা বাসে কাছাকাছি অন্য শহরে চলে যান, যেখানে হোটেল পাওয়া সহজ হতে পারে।
- যদি গ্রুপে থাকেন, তাহলে গন্তব্য থেকে একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় জায়গায় হোটেল খুঁজুন।
পরবর্তী যাত্রার জন্য শিক্ষা নিন
এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা ছাড়া কোথাও যাওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখা উচিত:
- হোটেল অগ্রিম বুকিং করা
- অন্তত কিছু হোটেলের নাম-ঠিকানা ও নম্বর মোবাইলে সংরক্ষণ করে রাখা
- বিকল্প থাকার ব্যবস্থার পরিকল্পনা রাখা
- সম্ভাব্য ব্যস্ত মৌসুমে (ঈদ, পূজা, ছুটি) ভ্রমণ এড়ানো অথবা আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া
ব্যাকআপ প্ল্যান থাকা
ভ্রমণে যাওয়ার আগে আপনি একটি ব্যাকআপ প্ল্যান রাখতে পারেন—
- ২-৩টি হোটেলের কন্টাক্ট নাম্বার লিখে রাখা
- ব্যাগে ছোট মশারি, চটজলদি বিছানো যায় এমন পাতলা চাদর, টর্চ ইত্যাদি রাখা, যাতে প্রয়োজনে কোনো অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত জায়গায় রাত কাটানো যায়
- ফোনে জরুরি নম্বর সেভ করে রাখা (ট্যুরিস্ট পুলিশ, স্থানীয় পরিচিত, পরিবারের সদস্য)
সতর্কতা ও নিরাপত্তা প্রথম
অচেনা জায়গায় রাত কাটানো মানেই কিছুটা ঝুঁকি। তাই কিছু বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে:
- পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কোনো অপরিচিতের প্রস্তাবে সাড়া দেবেন না
- মাদক বা সন্দেহজনক পরিবেশের জায়গায় থাকবেন না
- কোনো ব্যক্তিগত তথ্য বা ভ্রমণ পরিকল্পনা স্থানীয় অচেনা কাউকে বলবেন না
- গুগল ম্যাপ, লাইভ লোকেশন ফ্যামিলি বা বন্ধুকে শেয়ার করে রাখুন
ভ্রমণ আনন্দের, তবে হঠাৎ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা আরও জরুরি। হোটেল না পাওয়া মানেই যাত্রা ব্যর্থ—এমন ভাবার কিছু নেই। বরং সচেতনতা, কৌশলী সিদ্ধান্ত এবং কিছুটা সাহস নিয়ে আপনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। সঠিক পরিকল্পনা ও বিকল্প ভাবনা থাকলে, হঠাৎ বেড়িয়ে পড়াও হতে পারে জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।