- লেখক: দীপ কুন্ড #
কলকাতার কথা মনে হলেই মনে হয় সিটি অফ কালচার, সিটি অফ জয়, সিটি অফ জয়, সিটি অফ হেরিটেজ সর্বপরি সিটি অফ প্যাসন,সিটি অফ প্যালেস- ভালোবাসার শহর কলকাতা, তিলোত্তমা কলকাতা। একে যতভাবে যতবারেই দেখি এর রূপ যেন শেষ হয় না। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে নতুন রূপে ধরা দেয় এটি আমাদের সামনে।
কলকাতার প্রতিটি রাস্তা, উত্তর-দক্ষিন কলকাতার পুরোনো বাড়ি , রাজবাড়ী, ঠাকুর দালা, গঙ্গার ঘাট, টানা রিক্সা, তেলেভাজার দোকান, কলেজ স্ট্রীটের প্যারামাউন্ট এর শরবত, মিত্র ক্যাফের ফিস কাটলেট, কুমোরটুলির ঘিঞ্জি গলি এক অনবদ্য আকর্ষণে টানতে থাকে আমাদের বাঙ্গালিদের।
যদিও কলকাতা নিত্যনতুন রূপে দেখা দেয় আমাদের সামনে তবুও উৎসবের শহরের মূল আকর্ষন দূর্গা পুজো, পুজোতে এক আলাদা চেহারা পায় এই জাদুর শহর, ব্যানারে ফেস্টুনে আলোক সজ্জায় এক অন্য কলকাতার দেখা পাই আমরা, সারাবছর ঘরের কোনে বসে থাকা বুড়ো দাদু ও ঠাকুমার হাত ধরে লাঠিতে ভর দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে ঠাকুর দেখতে, সারা রাত প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা, আড্ডা ! এগরোল, পানিপুরী, বেনারসী পান খাওয়া, সে এক অন্য রকম আনন্দ। বড় দিন বা ঈদ এ ও পিছিয়ে নেই কলকাতা, বড়দিনের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয় পার্ক স্ট্রীট এর প্রতিটি অলিগলি রেস্টুরেন্ট। আলোকমালায় সজ্জিত হয় প্রতিটি দোকান গীর্জা ঘরবাড়ি। তবে হেঁটে কলকাতাকে যতটা চেনা যায় বোঝা যায় উপলব্ধি করা যায় তা আর কোন কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমাদের বাংলাদেশিদের কলকাতা ভ্রমণ শুরু হয় মূলত কলকাতার মীর্জাগালিব স্ট্রীট থেকে যেখানে বাংলাদেশের সব বাস কাউন্টার এর অবস্থান আর পাশেই নিউমার্কেট থাকাতে আমাদের পছন্দের প্রথম তালিকাতেই থাকে এ এলাকা।
কলকাতার ভ্রমণ যদি আমরা এখান থেকে শুরু করতে চাই তবে প্রথমেই দেখে নেওয়া যায় জানবাজার রাজবাড়ী, রানী রাসমণির স্মৃতিবিজড়িত এই প্রাসাদ স্বরুপ বাড়ী এখন প্রায় চাল ডাল মশলার আড়তে পরিণত হয়েছে, এখানকার ঠাকুর দালানের কাজ চোখ ধাধিয়ে দেয়। রাজবাড়ি দেখা শেষ করে হাটতে হাটতে চলে যেতে পারি আমরা ধর্মতলা বা এসপ্লানেডে এখানে ট্রাম ডিপোর মধ্য দিয়ে হেঁটে ঢুকতে পারি ডেকার্স লেন এ। এখানকার স্ট্রীট ফুড এর খ্যাতি জগত বিখ্যাত, এখানে অনায়েসে চেখে দেখতে পারি আমরা ফ্রাইড রাইস বা চিলিচিকেন বা নিরামিষ সব্জী দিয়ে রাধাবল্লভি ! সকালের খাওয়া সেরে এবার আমরা যেতে পারি রাজ ভবনের দিকে যদিও ঢুকতে পারবো না তবুও পাইরে থেকে এর শোভা অতুলনীয়, এটি ব্রিটিশ ভারতের বড় লাট এর বাস ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হত, বর্তমানে এটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপালের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এবার আমরা সামনে এগোলে দেখতে পাবো সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, তারপর ই রাইটার্স বিল্ডিং এখান থেকেই মূলত অফিস পাড়া শুরু, এখানকার স্থাপত্য দেখলে মনে হবে এটিই কি কলকাতা ! আমাদের ঠিক বাড়ির পাশের অচিন নগর, মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য শৈলীর রাইটার্স বিল্ডিং পুর্বে ছিল কলকাতা তথা সুতানটী-গোবিন্দপুরের জমিদার বড়িষার বিখ্যাত সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের কাছারী বাড়ী।
এর পর একে একে দেখে নেওয়া যায় জেনারেল পোস্ট অফিস, পোস্ট মিউজিয়াম, ফেয়ারলি প্লেস, রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, এর পর হাটতে হাটতে চলে যাওয়া যায় ফেয়ারলি প্যালেস গঙ্গার ঘাট এ, এখান থেকে হাওড়ার লঞ্চ ছাড়ে ১০/১৫ মি পর পর, এর যেকোন একটিতে উঠে গঙ্গার হাওয়া খেতে খেতে চলে যাওয়া যায় নদীর ওপাড়ে হাওড়া স্টেশন এ, হাওড়া জংশন রেলওয়ে স্টেশন ভারতের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে কমপ্লেক্স আর বড় স্টেশনের মুকুট তার মাথায়। ১৬৪ বছরের পুরনো এ স্টেশনটির প্ল্যাটফর্ম সংখ্যা ২৩ ও ট্র্যাক ২৬টি। এর পর আমরা হেঁটে পাড় হবো বিখ্যাত হাওড়া ব্রীজ,১৯৪৫ এ নির্মিত এই কান্ট্রিলিভার ব্রীজ টি সম্পুর্ণ লোহার তৈরি, ব্রীজ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে যাবো অপরপারে, মল্লিক ঘাটে, এখানকার বিখ্যাত ফুলের বাজার দেখে আমরা উঠে পড়বো এসপ্লানেডগামী যেকোন বাসে।
এসপ্লানেড নেমে আমরা দেখে নেবো ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হগ মার্কেট এর পর এখান থেকে চলে যাবো কলকাতা মিউজিয়াম দেখেতে। শ্বেত শুভ্র মিউজিয়ামের করিডরের ভিতর হাটতে হাটতে চএল যেতে পারি অতীত কোন যুগে । এর পর দেখে নিতে পারি অদূরের এশিয়াটিক সোসাইটি বা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ বা পার্ক স্ট্রীট সিমেট্রী, এর পর নিজের পায়ের উপর যদি ভরসা থাকে আর মনে যদি জোর থাকে তবে হাটতে হাটতে চলে যেতে পারি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এ পথে পড়বে বিড়ালা প্লানেটেরিয়াম, এর পর ভিক্টোরিয়ার প্রাচীন কলকাতায় অবগাহন করে ব্রিটিশ দের নিজস্ব স্থাপত্য শৈলী আর রানীর পতি শ্রদ্ধার নিদর্শন থেকে গড়ের মাঠের মধ্য দিয়ে বাদাম খেতে খেতে চলে যাবো প্রিন্সেপ জেমস ঘাটে, এটি পূর্বে জাহাজযোগে কলকাতায় আগত সাহেব-সুবা বিশেষ ব্যাক্তিদের অভ্যর্থনা ঘাট রূপে ব্যবহৃত হত। এখানে গঙ্গার হাওয়া খেতে খেতে সন্ধ্যেটা কাটানো যায় অনায়াসে। ডান পাশে একটু এগিয়ে গেলেই বাবু ঘাট, এখান থেকে হাওড়া ব্রীজ তথা রবীন্দ্র সেতু ও বিদ্যাসাগর সেতু সমদূরত্বে দেখা যায়, রাতের সেতু দুটির আলোকসজ্জাও দেখবার মত।
কালী কলকাত্তা ওয়ালী, অর্থাৎ মা কালীর নিজের শহর আপন আবাস ভূমি কলকাতা, অনেকের মতে কালীক্ষেত্র বা কালীঘাট থেকেই কলকাতা নামের উৎপত্তি, তাই কলকাতা এলাম আর মন্দির দর্শন করব না এ ভাবাই যায় না, আমরা আমাদের দিন শুরু করতে পারি রানী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিনেশ্বর কালী মন্দির দর্শনের মাধ্যমে, তবে এ ক্ষেত্রে পদযুগলের উপর ভরসা না রেখে, বাহন ব্যাবহার করাই শ্রেয় কারণ দক্ষিনেশ্বর শহর থেকে প্রায় বারো ১২ কিলোমিটার দূরে। বারো টি আটচালা শিব মন্দির সহ শ্রী রামকৃষ্ণ দেব পূজিত মূল মা ভবতারিনী মন্দিরটি নবরত্ন। এখান কার স্থাপত্য শৈলী তে খুজে পাওয়া যায় বাংলার আদি মন্দির স্থাপত্য কে। এখান থেকে নৌকা যোগে আমারা চলে যেতে পারি স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠে, সর্ব ধর্মীয় উপাসনালয়ের সমন্বিত করে তৈরী হয়েছে এখানকার প্রার্থনা গৃহ টি, এখানকার মিউজিয়ামটিও অনেক সমৃদ্ধ। এখান থেকে চলে যেতে পারি আমরা কুমোরটুলিতে, গঙ্গার ধারদিয়ে কুমোরটুলি দিয়ে হাটার সময় ই মনে হবে এ কোন আশ্চর্য পৃথিবীতে এলাম, কাদামাটী থেকে বের হচ্ছে অপূর্ব সব শিল্পকর্ম । এখানে দেখে নিতে পারি অষ্টধাতুর আদি ঢাকেশ্বরী বিগ্রহ যা ১৯৪৭ এ দেশভাগের সময় ঢাকা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল।
এর পর আমরা চলে যাবো শোভাবাজার রাজবাড়ী কলকাতার সাথে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ রাজা নবকৃষ্ণ দেব ও তাঁর শোভাবাজার রাজবাড়ির ইতিহাস, এখানকার পর্ব চুকিয়ে আমরা চলে যাব কালীঘাট মন্দিরে কলকাতার সবথেকে পুরোনো কালী মন্দির এটি । ঘুরে দেখা যায় বউবাজার ফিরিঙ্গি কালীমন্দির, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ী, জোড়াসাকো ঠাকুর বাড়ী, মার্বেল প্যালেস সহ সব জানা অজানা গন্ত্যবে।
পুরনো কলকাতার গন্ধ নিয়ে আমরা মাটির ভাড়ে চা খেতে খেতে ঢু মারতে পারি কলেজ স্ট্রীট এ, এশিয়ার সবথেকে বড় বই এর বাজার এটি সাথেই আছে সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা মেডিকেল, প্রেসিডেন্সি কলেজ এর মত নামী সব প্রতিষ্ঠান, সন্ধ্যেটা কাটতে পারে আমাদের মান্নাদের কফিহাউজে মোঘলাই পরোটায় কামড় আর র কফির ইনফিউশন এ চুমুক দিয়ে। সাথে হতে পারে সেই গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডা টা আজ আর নেই !
ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে একটু আধুনিকতা আর বিদ্যা মেশাতে চাইলে যাওয়া লাগবে সাইন্স সিটি,যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, নিক্কোপার্ক, নিউটাউন, ইকোপার্ক, সিটিসেন্টার এ।
তিলোত্তমা কলকাতার মজাটা হল আপনি একে যে রূপে চাইবেন শহর আপনাকে সে রূপেই ধরা দেবে, মাতৃরূপে বা প্রেয়সী বা বন্ধু সব ক্ষেত্রেই পাবেন সমভাবে, রাস্তায় একা হাটুন বা বন্ধুর সাথে অথবা প্রেয়সীর হাত ধরে, এতটুকু নিশ্চয়তা দেওয়া যায় কলকাতা আপনাকে আনন্দ হতে বঞ্চিত করবে না ।