- লেখকঃ দীপ কুন্ড #
আমরা যারা ঢাকা শহরে থাকি তথা বাংলাদেশে থাকি তারা এই চারশো বছরের পুরোনো শহর টাকে কতটুকে চিনি, কখনো কি ভেবেছি এই শহর নিয়ে বা পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি এই শহরের আনাচে কানাচে ? সেই চিরচেনা শহরের চেনা অচেনা দিক গুলো নিয়েই এই চেনা অচেনার ঢাকা।
তা চেনা টা শুরু হোক ঢাকার প্রানকেন্দ্র শাহবাগ থেকেই, শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর যেতে, দোয়েল চত্বরের উল্টো দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ঢাকা গেট। ঢাকা শহরকে মগ জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য মীর জুমলা প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থার অংশ হিসেবে এটি গড়ে তুলেছিলেন, একারণে এটি মীরজুমলা গেট নামে পরিচিতি পায়, পরবর্তীতে এটিকে রমনা গেট ও বলা হত।
ঢাকা গেটের পাশেই বিশাল তিনটি সমাধি সৌধ। এখানে দেশের তিন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতার সমাধি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব বাংলাদেশের ৩ নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওরার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন এর কবরের উপর নির্মিত হয়েছে ইসলামী স্থাপত্য রীতির এই আধুনিক স্থাপত্য টি।
তিন নেতার মাজারের পাশেই মোঘল আমলের তৈরী তিনগম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে। মসজিদের নাম হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ। শিলালিপি অনু্যায়ী জানা যায় ১৬৭৯ সালে শাহজাদা মুহম্মদ আজমের সময়ে ঢাকার বণিক খাজা শাহবাজ এটি নির্মান করেন। টার মৃত্যুর পর মসজিদের পাশেই উঁচু ঢিবিতে তাকে সমাহিত করা হয়।
বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল এলাকা পরিচিত ছিল বাগ-ই-মুসা খাঁ নামে। হাকিম হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, বাগানটিকে মুসলমানদের বাগান ও বলা হত। মুসা খাঁ ছিল বাংলার বারো ভুইয়ার অন্যতম ঈসা খাঁর পুত্র। সুবেদার ইসলাম খার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দি হয়েছিলেন মুসা খাঁ। কিন্তু ইসলাম খাঁ সদয় ব্যবহার করেছিলেন তাঁর সঙ্গে।
বর্তমানে শহীদুল্লাহ হলের পাশেই মুসা খাঁর মসজিদ। হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে এটি মুসা খাঁর ই তৈরি কিন্তু অনেকের মতে এর স্থাপত্য রীতি দেখে মনে হয় শায়েস্তা খানী রীতিতে নির্মিত মসজিদ টি আসলে নির্মাণ করেছিলেন মুসা খাঁর পৌত্র দিওয়ান মুন্ওয়ার খান। এর বিশেষত্ব হচ্ছে একটি উঁচু প্লাটফর্মের উপর মসজিদটি নির্মিত। মসজিদটির পাশেই সমাহিত আছেন মুসা খাঁ ।
উল্লেখ্য যে, নবাবপুরের কাছে মুনওয়ার খাঁর বাজার বসিয়েছিলেন মুসা খাঁর পৌত্র মুনওয়ার খাঁ।
নিমতলী প্রাসাদটি ধ্বংস হয়ে গেলেও এশিয়াটিক সোসাইটি কমপ্লেক্স এর ভিতরে এর আকর্ষণীয় ফটক রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে লেফটেন্যান্ট সুইনটিন ১৭৬৬ সালে নায়েবে নাজিম জসরত খানের আবাস্থল হিসেবে নিমতলী প্রাসাদ নির্মান করেন। ঢাকার নায়েব নাজিমরা ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত এখানে বসবাস করেছেন।
কার্জন হলের উত্তর দিকে সাদা রঙয়ের গম্বুজ ওয়ালা ভবনটি পুরোনো হাইকোর্ট ভবন। ইউরোপীয় ও মোগল স্থাপত্য রীতির মিশ্রণে সুরম্য এ স্থাপনাটি তৈরী হয়েছিল ব্রিটিশ গভর্ণরের বাসভবন হিসেবে ১৯০৫ সালে। ভবনটি বিভিন্ন আকারের সারি সারি কক্ষ সমূহ সহ বিশাল চতুরভুজাকার বেষ্টনীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। সাদা মার্বেলে শোভিত একটি প্রশস্ত সিঁড়ি বর্গাকার প্রবেশকক্ষ থেকে বারান্দার পেছন দিক দিয়ে উপরে উঠে গেছে। এই ভবনে ছোট বড় ৫০ টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে বৈঠকখানা, খাবার ঘর, শয়নকক্ষ, ড্রেসিংরুম, বাতিঘর, গুদামঘর, ভাড়ারঘর, রয়েছে। এর লাগোয়া পূর্বপাশেই হাইকোর্ট মাজার। আর একেবারে পূর্ব পাশের বড় গম্বুজ ওয়ালা বিশাল ভবনটি বর্তমান হাইকোর্ট ভবন।
পুরান ঢাকার আতশখানায় অবস্থিত এই মসজিদটি ১৭০৬ সালে নায়েবে নাজিম ফররুখশিয়ারের শাসনামলে নির্মিত হয়। ঢাকার প্রধান কাজী ইবাদুল্লাহের আদেশে খান মুহাম্মদ মৃধা এটি নির্মান করেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বর্তমানে মসজিদটি সংরক্ষন করছে। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির বিশেষত্ব হলো ৫.১৮ মিটার উঁচু প্লাটফর্মের উপর স্থাপিত এর ভিত্তিটি। ৩৮ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০.৪৮ মিটার প্রস্থ মঞ্চটির নিচে টানা করিডোর ও ছোট ছোট বেশ কতগুলো কক্ষ রয়েছে। মোগল রীতিতে নির্মিত মসজিদ টিতে উঠতে পূর্বদিকে একটি সিঁড়ি রয়েছে। লালবাগ কেল্লার উত্তর পশ্চিম দিকে এই মসজিদটি অবস্থিত।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অনেক আর্মানীয়রা বাস করত। একারনেরই উক্ত স্থানের নাম আরমানিটোলা হয়েছিল। মূলত সম্রাট আকবরের অনুমতি সাপেক্ষে আর্মানীয়রা ভারতে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা, বসতি স্থাপন ও গীর্জা নির্মান করেন। ব্যাবসার কারণে ঢাকায় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বসতি স্থাপন ও গীর্জা নির্মান করে তাঁরা প্রার্থনা শুরু করে। তাদের কারো মৃত্যু হলে তেজগাঁও রোমান ক্যাথলিক মিশন এর পাশে তাদের মরদেহ সমাহিত করতো। ১৭৮১ সালে একজন বিত্তবান আর্মানীয় নিকোলাস পোগজ ক্যেক বিঘা জমিতে ওই ক্ষুদ্র গীর্জার স্থলে একটি বিশাল গীর্জা নির্মান করেন। তিনি গীর্জাটির নামকরণ করেন চার্চ অব দ্যা রিজারেকশন।
পুরোনো ঢাকার সদরঘাটের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ্ পার্ক । পুর্বে এর নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক। ১৮৫৮ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার শাসন ভার গ্রহনের ঘোষণা এই পার্কে পাঠ করা হয় বলে একে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামকরন করা হয়। ভিক্টরিয়া পার্কের পূর্ব নাম ছিল আন্টা ঘর ময়দান।
পার্কের পশ্চিমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এবং উত্তর পশ্চিমে জেলা আদালত ও ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ভারতের শেষ মুঘল সম্রাট ২য় বাহাদুর শাহ্ জাফরের নামে এর নাম করণ করা হয় বাহদুর শাহ্ পার্ক।
১৭ শতকে সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থাপন করলে রাজধানীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে বেশ কিছু কামান তৈরী করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কালে খাঁ জমজম ও বিবি মরিয়ম, বিশালত্বে ও নির্মান শৈলীতে এ দুটি কামান ভারত খ্যাত। কালে খাঁ জম জম বুড়িগঙ্গা নদীতে তলিয়ে গেলে বিবি মরিয়ম হয়ে ওঠে দর্শনীয় । বিবি মরিয়মের দৈর্ঘ্য ১১ ফুট, মুখের ব্যস ৬ ইঞ্চি। ঢাকার কামান তৈরির কারিগর জানার্দন কর্মকার এটি তৈরি করেন অত্যন্ত শক্ত পেটানো লোহা দিয়ে। সুবাদার মির জুমলা ১৬৬১ সালে আসাম অভিযানের সময় ৬৭৫ টি কামান ব্যবহার করেন , এদের মধ্যে বিবি মরিয়ম ছিল সর্ববৃহৎ। যুদ্ধে বিজয়ের স্মারক হিসেবে এটিকে বর কাটরার দক্ষিণে সোয়ারী ঘাটে এর পর ১৮৪০ সালে চকবাজারে, ১৯২৫ সালে সদরঘাটে, গতশতকের মাঝামাঝিতে গুলিস্থানে এবং সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে ওসমানি উদ্যানের প্রধান ফটকের পেছনে স্থাপন করা হয়।
ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত মোগল শাসনের ধারাবাহিকতায় যে স্থাপত্যরীতি প্রচলিত রয়েছে তারই উদাহরণ ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’টি। ধারণা করা যায়, ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ মসজিদটি নির্মাণ করেন। অন্য এক তথ্যে জানা যায়, নবাব শায়েস্তা খাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বুজুর্গ উদ্দিন (উমিদ) খাঁ এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে, মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্বাবধানে আছে। ছাদে রয়েছে তিনটি বড় গম্বুজ এবং চার কোণের প্রতি কোনায় একটি করে অনু গম্বুজ থাকায় একে সাত গম্বুজ মসজিদ বলা হয়। এর আয়তাকার নামাজকোঠার বাইরের দিকের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে ১৭.৬৮ এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। এর পূর্বদিকের গায়ে ভাঁজবিশিষ্ট তিনটি খিলান এটিকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। দূর থেকে শুভ্র মসজিদটি অত্যন্ত সুন্দর দেখায়। মসজিদের ভিতরে ৪টি কাতারে প্রায় ৯০ জনের নামাজ পড়ার মত স্থান রয়েছে।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত শাহী ঈদগাহ একটি প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা। ১৬৪০ খৃস্টাব্দে বাংলার সুবেদার সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন।
ঢাকায় অবস্থিত মোঘল স্থাপত্য নিদর্শনসমূহের অন্যতম এই ঈদগাহ। তৎকালীন সময়ে ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহটি মূল শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল। মূল শহর অর্থাৎ পুরনো ঢাকায় বেশ কয়েকটি সুলতানি ঈদগাহ থাকলেও বড় আকারে কোন ঈদগাহ ছিল না। তাই মীর আবুল কাসেম ঈদগাহের জন্য জায়গা খুজতে থাকেন। অবশেষ তিনি ধানমন্ডি এলাকা বেছে নেন। কাজেই মূল নগর থেকে কিছুটা দূরে খোলা জায়গায় এবং সাত মসজিদের কাছে হওয়ায় ধানমন্ডি এলাকাতে ঈদগাহটি নির্মিত হয়।ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত ঈদগাহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ১৬৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত সাত মসজিদ রোডের ধানমন্ডি ঈদগাহ ঢাকায় অবস্থিত মুঘল স্থাপত্য নিদর্শনসমূহের অন্যতম এই ঈদগাহ।ধানমন্ডির শাহী ঈদগাহ বড়-বড় দালানকোঠার আড়ালে পড়ে গেছে বলে সহজে চোখে পড়ে না। ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো শাহী ঈদগাহ দৈর্ঘ্যে ১৪৫ ফিট ও প্রস্থে ১৩৭ ফিট। এর চারকোণে অষ্টচূজাকৃতির বুরুজ রয়েছে। তিন ধাপের মিম্বার ঈদগাহের উত্তর পাশে রয়েছে। ঈদগাহটি চারদিকে ১৫ ফিট উচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তবে বর্তমানে কেবল পশ্চিম দিকের প্রাচীরটিই মোঘল আমলের। পশ্চিম প্রাচীরের মাঝ বরাবর প্রধান মেহরাব।
বাংলাদশের পুরানো ঢাকার আরমানিটোলা-র আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত ‘তারা মসজিদ’। খ্রিষ্টীয় আঠারো শতকে ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান) এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তারা মসজিদের আরও কিছু প্রচলিত নাম আছে, যেমন, মির্জা গোলাম পীরের মসজিদ বা সিতারা মসজিদ।
সতের শতকে দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরে নির্মিত মোঘল স্থাপত্য শৈলী অনুসরণে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদের কোথায়ও এর তৈরির সময় উল্লেখ নেই বলে কবে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়, তার সুস্পষ্ট কোনো নথি পাওয়া যায়নি। তবে, মসজিদটি তৈরির পর ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে মির্জা গোলাম পীর মৃত্যুবরণ করেন।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। এই সময় মসজিদটির আকার বৃদ্ধি করা হয়। এই সময় এর পূর্বদিকে একটি বারান্দা যুক্ত করা হয়। এই সময় মসজিদের মেঝে মোজাইক করা হয়। চিনিটিকরি (Chinitikri) কৌশলের এই মোজাইকে ব্যবহার করা হয় জাপানী রঙিন চীনা মাটির টুকরা এবং রঙিন কাঁচের টুকরা। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এই মসজিদটির পুনরায় সংস্কার করা হয়। এই সময় পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটো গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে এর গম্বুজ সংখ্যা পাঁচটিতে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে মসজিদের জায়গা সম্প্রসারিত হয়।
তিলোত্তমা নগরী এই ঢাকার রয়েছে চারশ বছরের ইতিহাস, দু’পায়ের উপর ভরসা থাকলে চিরচেনা এই শহর কে আবিষ্কার করা যায় নতুন রূপে, উপভোগ করা যায় আসল ঢাকা শহর কে, জাদুর শহরকে
তথ্যসূত্রঃ স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী, মুনতাসীর মামুন, চিনবো এবার বাংলাদেশ-কামরান চৌধুরী, ইন্টারনেট