- নীরু শামসুন্নাহার #
বর্ষা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ঋতু, প্রকৃতির অসামান্য এক দান । এ সময় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস জুড়ে বর্ষাকালের ব্যপ্তি। এই অপরূপ ঋতুতেই বাঙালির হৃদয় প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে প্রবল আনন্দে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। এ সময় বিশেষ ধরনের উৎসবের আয়োজনে মেতে ওঠে বাংলাদেশের অধিবাসীরা। আর যেখানে উৎসব সেখানেই অবধারিতভাবে হরেক রকম ঐতিহ্যবাহী জিনিস-পত্রের সমাহার এবং রীতিমতো রসনাবিলাসী রকমারী খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেন অঞ্চলবাসী। সমাজের সব ধরনের মানুষের আনন্দময় এবং সরব উপস্থিতিতে বর্ষার উৎসব সার্বজনীন এক রূপ পরিগ্রহণ করে।
“বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে
নিরন্তর ঝরে যাও অঝোর ধারায়;
করুণায় আর্দ্র হয়ে মানবমঙ্গলে
এই ঋতু মাঙ্গলিক ময়ূর-আনন্দে মাতো
কৃষিসভ্যতার সকল সন্তান…”
( বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে, রফিক আজাদ)
যেহেতু বর্ষার উৎসব, আষাঢ়- শ্রাবণ মাস জুড়েই নৌকা বাইচের আয়োজন উৎসবের একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকে। তাই অবধারিতভাবে নৌকা বাইচকে বাংলাদেশের বর্ষাকালে আয়োজিত অন্যতম জাতীয় উৎসব হিসেবে বলাটা বাহুল্য হবেনা বোধ করি। এই উৎসব বাংলাদেশের প্রায় সব ভাটি অঞ্চলেই আয়োজন করা হয়। এ সব আয়োজনে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নৌকার দেখা মেলে । নৌকাবাইচ উপলক্ষে নৌকাগুলোকে লোকশিল্পের মোটিফ দিয়ে চিত্রিত করা হয় এবং রঙিন কাগজের সাহয্যে চমৎকার করে সাজানো হয়। বাইচের সওয়ারীদের সাজ-সজ্জাও দেখার মতো। নৌকার মাঝখানে দাঁড়ানো মূল গায়েন হাতে রঙিন রুমাল,পায়ে ঘুঙ্ঘুর. কাঁধে থাকে গেরুয়া রঙের উত্তরীয় বেঁধে উৎসাহমূলক লোকগীতি গাইতে থাকেন। নৌকার গতির সাথে তাল মিলিয়ে নদীর পাড় ধরে ছুটতে থাকে শিশু-কিশোরের দল।
এ ছাড়া, ভাটি অঞ্চলে মনসার ভাসান নিয়ে গীত পরিবেশনের আসর বসে রাতের বেলা কোন কৃষকের বাড়ির উঠোনে। বর্ষার উৎসবের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী বিষয় হিসেবে মধ্যযুগের মনসা- মঙ্গল কাব্যের ধারাবাহিকতার রেশ এখনো বাংলাদেশের কোথাও কোথাও দেখতে পাওয়া যায়। অবিরল বৃষ্টিপাতের মধ্যে প্রস্ফুটিত বর্ষার অন্যতম ফুল কদম, ছাতিম আর গাবফুলের মদির সুগন্ধ বাংলার মানুষকে সৃষ্টিশীল এবং মানবিক করে তোলে। গ্রামের নারীদের সৃজনশীলতার একটা অন্যতম সময় এই বর্ষাকাল। ঘনঘোর বরিষায় সহজে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে দৈনন্দিন কাজগুলো করা যায়না বলে ঘরের মা – মেয়েরা মিলে বর্ষায় সেলই করবেন বলে সিঁকেয় তুলে রাখা গত বর্ষায় শুরু করা নকশি-কাঁথা সেলাই করতে বসেন। এটিও সারা বাংলার ঘরে ঘরে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ রচনা করে। সেলাইয়ের ফোঁড়ে, ফোঁড়ে পুরনো কাপড়ের পরতে পরতে উঠে আসতে জীবনের কথকতা। এটিও হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের বর্ষার উৎসবের একটা অত্যন্ত প্রাণময় এবং বর্ণিল অংশ।
বর্ষার উৎসবের সাথে যুক্ত হয় বর্ষার উপযোগী রকমারী মুখরোচক সব খাবার। এর মধ্যে অন্যতম ভোজন-রসিক বাঙালির পাতে দেয়ার জন্য সুগন্ধী চিনিগুড়ি চালের ভুনা খিচুড়ির সাথে কলাপাতায় মোড়ানো পদ্মার ভাপা ইলিশ, সরষে- বাটা ইলিশ, কাঁচা তেঁতুল দিয়ে নতুন বর্ষার জলের চক্চকে চেলা অথবা পাবদা মাছের ঝোল, শেষ পাতে পায়েস অথবা চন্দ্রপুলী পিঠা! আষাঢ- শ্রাবণ জুড়ে চাই বৃষ্টি দেহে- মনে। বর্ষা এক মানবিক এবং সার্বজনীন ঋতু।
এই হলো আপাততঃ বাংলাদেশের বরষার উৎসবের সংক্ষিপ্ত বয়ান।
——
ড. নীরু শামসুন্নাহার , শিল্পকলা গবেষক, প্রাক্তন পরিচালক
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর