পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
১৭৪৮ সালে ১১৫৩ বঙ্গাব্দে রাণী ভবাণীর স্বামী রামকান্ত ইহলোক ত্যাগ করার পর নবাব ‘আলীবর্দি খাঁ’ রাজা রামকান্তের স্ত্রী রাণী ভবানীর ওপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তখনকার দিনে জমিদার হিসাবে একজন নারী অত্যন্ত বিরল ছিলেন, কিন্তু রাণী ভবাণী রাজশাহীর বিশাল জমিদার কার্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নির্বাহ করেন।
রাণীর শেষ জীবনে তখকার নাটোর রাজ্যের অধীন ভূমির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার বর্গ মাইলেরও অধিক। মোট ১৩৯ পরগনার ১৭৪১৯৮৭ টাকা নবাব সরকারের রাজস্ব ধার্য ছিল। ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামকান্ত ১৮ বৎসর বয়সে স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করেন। তার সময়ে ১৬৪ পরগনা নাটোর রাজ্যের অধিকারভুক্ত হয়। একজন ইংরেজ লেখক হলওয়েল ধারণা দেন যে জমিদারী এস্টেটের বার্ষিক খাজনা ছিল প্রায় ৭ লক্ষ রুপী এবং বার্ষিক অর্জিত রাজস্ব ছিল প্রায় ১৫ লক্ষ রুপী।
পরবর্তীতে রাণী ভবানী রঘুনাথ লাহরীর সাথে তার মেয়ে তারার বিয়ে দেন এবং রাণী ভবানী তার জামাতার হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে নবাব সরকার জামাতার নামে জারি করেছিলেন। কিন্তু ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে সেই প্রিয় জামাতার মৃত্যু হওয়ায় আবার তাকে রাজ্যভার গ্রহণ করতে হয় এবং একমাত্র কন্যা তারা বাল্য বিধবা হয়ে তার সাথে বাস করতেন।
১৭৮৬ সাল পর্যন্ত নাটোর রাজ্য ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে বৃহত্তম জমিদারি। তার রাজত্বকালে জমিদারী বর্তমান নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এজন্য তাকে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বলা হতো। প্রজা সাধারণের কল্যাণের জন্য রাণী ভবানী সুদীর্ঘ ৫০ বছর দক্ষতার সাথে তিনি বিশাল জমিদারী পরিচালনা করেন।
রাণী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত মূল ভবনটিই ‘রাণী ভবানীর রাজবাড়ী’ অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী নাটোর রাজবাড়ি। গোটা রাজবাড়িতে ছোট-বড় ৮টি ভবন, ২টি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর আছে। প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রবেশমুখে রয়েছে বিশাল একটি পুকুর, সেই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাট দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। জলটুঙ্গি, তারকেশ্বর, গোপীনাথ, আনন্দ, ও মহাল নামে রাজবাড়ীর ছোট পুকুরগুলির নাম। রাজবাড়ি ঘিরে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি।
জানা যায়, এই বেড়চৌকি রাজবাড়িতে বহিশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করত। অপরূপ কারুকার্যখচিত বিশাল এই রাজবাড়ির মোট আয়তন ১২০ একর। রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলো হলো- শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালীবাড়ি মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দির।
পুরো রাজবাড়ি ঘিরে আছে বিশাল সব গাছ। রয়েছে নানা জাতের ফুলগাছ। পাশেই নবনির্মিত কমিউনিটি সেন্টার। কমিউনিটি সেন্টার ধরে সামনে গেলে তারকেশ্বর মন্দির। আরেকটু সামনে এগিয়ে ডান দিকে বিশাল মাঠ। মাঠের বিশাল প্রন্তরে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে রাজবাড়ির একতলা ভবনটি। এই অংশের নাম ছোট তরফ।
এর ঠিক উল্টো দিকে বড় তরফ। যমজ প্রায় বড় তরফের সামনে রয়েছে বিশাল পরিখা ও পুকুর। সামান্য দূরেই রাণি মহলটিতে রাণি ভবানী বাস করতেন। এখন রাণি মহল আছে নামমাত্র। শুধু সাইনবোর্ডে লেখা দেখে চেনা যায়। এখানে একটি অতিথিশালা আছে, নাম মাত্র। তবু ভগ্নপ্রায় অতিথিশালা দেখে সে সময়কার নাটোর রাজার অতিথিসেবার কিছুটা নমুনা পাওয়া যায়। চলতি পথে দেখা যায় ছোট তরফের একটি ভবনের নাম হানি কুইন ভবন।
রাজবাড়ির আঙিনায় রয়েছে বিশাল বিশাল আটটি শিবমন্দির। মন্দিরগুলোতে এখনো রীতি মেনে নিয়মিত পূজা-অর্চনা করা হয়। দৃষ্টিনন্দন এই মন্দিরগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবেই। মন্দিরের দেয়ালজুড়ে রয়েছে প্রাচীন টেরাকোটার শিল্পকর্ম। মন্দিরকে ঘিরে আছে একটি শিবমূর্তি, ফণা তোলা সাপের মূর্তি, একজন বাউলের মূর্তিসহ নানা রকমের শৈল্পিক কারুকাজ। ওপরে ওঠার জন্য প্রতিটি ভবনের পাশেই রয়েছে লোহার তৈরি ঘোরানো সিঁড়ি।
রাণী ভবাণীর নাটোর রাজবাড়ী বাংলাদেশে একটি দর্শনীয় স্থান। দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণর হাতে রাজ্যভার দিয়ে তিনি মুর্শিদাবাদ চলে আসেন ও বড়নগরে কন্যাসহ বাস করতে থাকেন। ওয়ারেন হেস্টিংস পরবর্তী কালে জোরপূর্বক তার নাটোর জমিদারি কেড়ে নেন। মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগীরথী নদী তীরবর্তী বড়নগরে তার নির্মিত ১০০টি শিবমন্দির ছিল। কালের প্রবাহে অল্প কয়েকটি মন্দির টিকে আছে। মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা শৈলী আজও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।
কীভাবে যাওয়া যায়
নাটোর শহরের যে কোন স্থানো থেকে সরাসরি রিকশা বা অটোরিকশাযোগে যাওয়া যায়।