মো. জিয়াউল হক হাওলাদার
আঠারো শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ার দিকে তৎকালীন ব্রিটিশ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির শাসনাধীন বঙ্গীয় অঞ্চলে উদারতাবাদ ও আধুনিকতার দর্শন নিয়ে যে বেঙ্গল রেনেসাঁ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তাতে ব্রাহ্ম সমাজ অনস্বীকার্যভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, বেঙ্গল রেনেসাঁর সূচনা হয়েছিল রাজা রামমোহন রায়ের সাথে এবং শেষ হয়েছিল নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে। উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরও। তিনি ঊনিশ শতকের হলেও এখনো আমাদের কাছে একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত তার বিভিন্ন অবদানের জন্য, বিশেষ করে বিধবা বিয়ে আন্দোলনের জন্য। বিদ্যাসাগর একটি আলোকিত সমাজ গঠনের জন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন। যদিও বঙ্গীয় নবজাগরণ আন্দোলন প্রধানত বাঙালি উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের দিয়ে পরিচালিত হতো। তবে কিছু বিখ্যাত মুসলিম ব্যক্তিত্ব এখানে ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক উত্তর ভারতীয় সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণভাবে এক পরিবর্তনমূলক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- বিদ্রোহী কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরিবার। তারা এই উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতীয় পরিচয় গঠন ও দেশভাগ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রবন্ধ, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কবিতা, বিভিন্ন ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিয়ে লেখা এবং মানবতা ও প্রেমের গান বাংলার রেনেসাঁকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
বেঙ্গল রেনেসাঁ তথাকথিত প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান-ধর্মীয় ভূমিকা, বর্ণপ্রথা, যৌতুক, সতীদাহ ও ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলেছিল। রেনেসাঁর পূর্বে আন্তঃধর্মীয় বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। বাংলার নবজাগরণের আন্দোলনের সাথে সাথে আন্তঃধর্মীয় বিয়ে শুরু হতে থাকে। ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আন্তঃধর্মীয় বিয়ের স্বীকৃতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এটাও উল্লেখ করা জরুরি যে, বাংলার নবজাগরণের সময় বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ভূমিকা ছিল বেশ কয়েকজন বাঙালি বিজ্ঞানীর। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- রেডিও সায়েন্সের জনক জগদীশ চন্দ্র বসু, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উদ্ভাবক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রসায়নবিদ প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, আশুতোষ মুখার্জি প্রমুখ।
বঙ্গীয় নবজাগরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ভারতীয় সমাজ বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শৈল্পিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি আমূল পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছে। ব্রাহ্ম সোসাইটি সম্পর্কে বর্ণনা করার সময় দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সামনে চলে আসে। এরা হলেন- রাজা রামমোহন রায় ও কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এদেরকে ইতিহাসের বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক হিসেবে স্মরণ করা হয়। এই মহান ব্যক্তিত্বদের অনেক উদ্যোগের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরটি গুরুত্বপূর্ণ।
বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটা দূরত্বে সদরঘাটের পাটুয়াটুলি এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে মন্দিরটি অবস্থিত। আগে এটি পূর্ব বাংলা ব্রাহ্ম সমাজ মন্দির নামে পরিচিত ছিল। পূর্বে যেমন বলা হয়েছিল হিন্দু সমাজের সবচেয়ে বড় সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সমাজ ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা। ঠাকুর বংশের সদস্য হিসেবে ১৮৮৪ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম সমাজের সেক্রেটারি হন।
ব্রাহ্ম সমাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল- ধর্মীয় গোঁড়ামি, অত্যধিক অপচয়, মূর্তি পূজা, যৌতুক ইত্যাদি দূর করা এবং নারী শিক্ষা ও বিধবাদের বিয়ের স্বীকৃতি দেওয়া। এই আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে ঢাকার বহু যুবক তা গ্রহণ করেন। যদিও এটিকে একটি সার্বজনীন ধর্ম করার চেষ্টা করা হয়েছিল, তবে এটি শেষ পর্যন্ত হিন্দু ধর্মের একটি শাখায় পরিণত হয়। ১৮৮৬ সালে দীননাথ সেন ঢাকার ব্রাহ্মদের জন্য একটি মন্দির নির্মাণের প্রস্তাব করেন। এজন্য ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
চার ফুট উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর স্থাপিত ও পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রসারিত আয়তাকার মন্দিরটি ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলী অনুসারে নির্মিত। এই মন্দিরে পাঁচটি চওড়া ধাপে উঠার পর প্রবেশ করা যায়। সিঁড়ির মাঝখানে একটি খোলা খিলান পথ রয়েছে। এই মন্দিরটির আয়তন ১০০ ফুট বাই ৫৫ ফুট। মন্দিরের চারপাশে একটি ১৫ ফুট চওড়া বারান্দা ও মাঝখানে একটি বিশাল হলরুম রয়েছে। হলরুমটি হলো ৫৫ ফুট লম্বা, ২২ ফুট চওড়া ও ২১ ফুট উঁচু। এ মন্দিরে প্রতিমা পূজা হয় না। ব্রাহ্ম সমাজের গায়করা মঞ্চের সামনে বসে বিভিন্ন গান গান। শিক্ষা ও সাংবাদিকতাসহ ঢাকার অনেক সমাজকল্যাণমূলক কর্মকা-ে ব্রাহ্ম সমাজ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
ঐতিহ্যবাহী শহর ঢাকা পরিদর্শনের সময় পর্যটকরা সমাজ বিবর্তন ও বাংলার রেনেসাঁর প্রগতিশীল আন্দোলন সম্পর্কে জানতে এই মন্দিরটি দেখতে চান। মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা অনেক স্লোগান পর্যটকরা দেখতে পাবেন; যা সার্বজনীন মানবতার বর্ণনা করা হয়েছে। মন্দিরের সামনে অনেক দর্শনার্থী বই পড়ে সময় কাটান। ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরটি দেখার জন্য পর্যটকরা ঢাকা শহরের যে কোনো স্থান থেকে গুলিস্তান হয়ে বাসে করে সদরঘাট যেতে পারেন। বাংলাবাজার পয়েন্টে বাস থেকে নেমে ডানদিকে পাটুয়াটুলির দিকে মোড় নিতে হবে। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সেখানে পৌঁছতে পারবেন। প্রাইভেটকারেও এখানে আসতে পারেন। তবে পুরান শহরে রিকশা যাত্রাই ভালো।
বর্তমান সময়েও ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী সমাজ গড়ে তোলার জন্য সেই সময়কালে সংঘটিত বাংলার নবজাগরণের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে ধর্মীয়ভাবে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের এই দর্শনকে সারা দেশে এবং দেশের বাইরেও ছড়িয়ে দেওয়া বাঞ্চনীয়। আমরা বাংলার নবজাগরণ এবং ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরের প্রচার ও প্রচার কার্যক্রম যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শুরু করতে পারি।
লেখক: ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ), বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন।