পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
সকালে উঠে পাশেই হাটখোলা বাজারে সকালের পালা পাট বেচা-কেনার হাট বসেছে, ঘণ্টা দুয়ের মধ্যে সেই হাট শেষ। দু-কদম হাটতেই একটা টিনের ঘরে ‘নবজাগরণ নাট্যগোষ্ঠী ভাসান যাত্রা’ লেখা সাইন বোর্ড। তার মানে আমরা রাতে এই ঘরের দুইশ গজের মধ্যে ঘুমিয়েছি। কি দুশ্চিন্তাটাই না করেছি সারারাত। যাক বাবা বাঁচা গেলো। নাশতা করে পাশেই পাঁচঠিকড়ি কুমারবাড়ি ঘুরে আসা গেলো। এখানকার কামারদের প্রধান তৈরি পণ্য মাটির টয়লেট চাক। কিছু কিছু দইয়ের হাড়ি ও সরা হয়। কয়েকজনের সাথে কথা বলে কলকি কিনে ফিরতি পথ ধরলাম। কারণ এখনো পর্যন্ত ভাসান গানের দলের সাথে দেখা হয়নি।
বাজারে ফিরতেই ঘরের সামনে একজন দাঁড়িয়ে বললেন- আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন?
হে, আপনি?
আমি ভাসান দলের জোকার।
বাহ! আমার নাম ইমরান আর তার নাম ইসমাইল।
আসেন ঘরে আসেন, বলে নিজে সরে গিয়ে দরজা ফাঁকা করে দিলেন।
ঘরে প্রবেশ করে বসতে বসতে একের পর এক সকলে এসে হাজির। শুরু হয়ে গেলো সাজগোজ। সুমি সাজিয়ে দিচ্ছে সকলকে। সুমি হিজরা।
এক সময় সাজগোজ সম্পন্ন করে নৌকায় উঠার পথ ধরলো। আমরাও প্রথম থেকেই ক্যামেরা ধরলাম। ক্যামেরা চালাচ্ছেন ইসমাইল ভাই।
বাজারের বটগাছের তলে আসর করে বিদায়ের গান শুরু করলো দল।
একটা ভিক্ষা দেন গো নগরবাসীরা,
সতি বেহুলা করে গো ভিক্ষা
পতির লাগিয়া রে।
নৌকায় গিয়ে উঠে দল। চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, লখাই, সখী, বাসুকি, নিরা সকল চরিত্র স্ব স্ব পোশাকে । ভাসান গানের নৌকায় উঠতে হলে দিতে হবে টাকা। টাকা নিয়ে নৌকার পার্শ্ব দিকে বসানো হচ্ছে। মাঝখানটা ফাঁকা রাখতে হবে। কারণ সেখানে নাচবে বেহুলা-আর সখী।
নৌকা ছেড়ে দেয়া হলো। কিবোর্ড, ঢোল, মৃদঙ্গ, হারমোনিয়াম, মন্দিরা নিয়ে বসেছে বাদ্যযন্ত্রীরা। নেয়া হয়েছে বড় আকারের স্পিকার। কানে তালা লাগার যোগার।
গান ধরেছে,
বেইলা সাবান মাখে গায় রে
আহা রে সুন্দরী বেইলা রে।
হাঁটু পানিত নাইম্মা বেহুলা
হাঁটু মাঞ্জন করে রে
আহা রে আল্লাদের বেইলা রে।
কোমর পানিত নাইম্মা বেইলা
কোমর মাঞ্জন করে রে
আহা রে সুন্দরী বেইলারে।
গান চলতেই থাকে। এর মাঝে নদীর ঘাটে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে আসে বন্ধুসহ লখীন্দর। কোমর মাঞ্জন আর বুক মাঞ্জন দেখে লখাই তো ক্র্যাশ। কাছে আসতে গিয়ে বড়শির ছিপ লেগে বেহুলার কলসি ভেঙে যায়। বেহুলা বাড়ি গিয়ে কী জবাব দেবে। কলসি চায় লখাইয়ের কাছে।
কলসি গড়াইয়া দেও রে কুমার
কলসি গড়াইয়া দেও রে।
কলসির পিছে লেইখখ্খা গো দিও
লখিন্দরের নাম ও রে।
গ্রামের ঘাট থেকে ডাক দেয় ‘ওই ফটিক ভাই, আমাগো বাড়িত আহো।’
ফটিক শেখ নৌকা ভেড়াতে বলে।
ঘাটে নৌকা লাগলে দল নামে বাড়িতে। উঠানে হোগলা পেতে দেয়া হয়। বাদক দল বসে বাজাতে শুরু করে।
নাচে মন দেয় বেহুলা আর সখী।
ওই যে যায় যে বেইলা নতুন বাজারে,
বানিয়ার দোকানে গো বেইলা এ এ
বেইলা সিন্দুর খরিদ করে এ এ।
গ্রামের দুই বাড়ির উঠানে গান করে, ফের নৌকায় উঠলো দল। ধারাবাহিক গান চলছে।
প্রেম, প্রণয়, বিয়ে, বাসরঘর এবং সাপে কাটা। শেষে ভেলাতে করে নিরার সহযোগিতায় পাতালপুরিতে গিয়ে লখাইকে সুস্থ করে তোলা। স্বামী এবং ছয় ভাসুরকে নিয়ে ঘরে ফেরা। পুরা কাহিনি নাট্য নৃত্য-গীতে পরিবেশিত হয় নৌকা এবং গ্রামের বাড়ির আঙিনায়।
সন্ধ্যায় নৌকা এসে বাড়ির ঘাটে পৌঁছায়। আমরা নেমে ব্যাগগুলো নিয়ে রওনা করি বাড়ির পথে।
টাঙ্গাইল ঘাটাইলের পাঁচঠিকড়িতে আছে ফটিক শেখের ‘নবজাগরণ নাট্যগোষ্ঠী ভাসান যাত্রা’ কথ্য ভাষায় বলে বেহুলা লখিন্দর দল। দলের সকলেই কিন্তু পুরুষ।
এবারে দেখা হলো ফটিক শেখের দলের গান।
এর আগে বাসাইলের রহিম বাদাইমার দল, অর্জুনার মজনু মিয়ার দল, তারও আগে আগতেরিল্লার মেম্বারের দলের ভাসান গানের দলের সাথে নৌকায় উঠেছি। তবে ভালো গান করে রহিম বাদাইমা।
কাহিনি সক্ষেপ বললে সকলের বুঝতে সুবিধা হবে।
বেহুলা প্রাচীন বাংলার সুবিখ্যাত মঙ্গলকাব্য মনসামঙ্গলের প্রধান চরিত্র এবং চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দরের স্ত্রী। চাঁদ বানিয়ার পুত্র লখিন্দর। আর শাহে বানিয়ার কন্যা বেহুলার জন্ম সমসাময়িক কাল। মনসা-মঙ্গল লোকচেতনার ভেতর ধারণ করেছে পৌরাণিক চরিত্রসমূহ। এর কাহিনিতে দুটি ভাগ দেখা যায়। দেবলীলা এবং নরলীলা। কাহিনীর প্রধান চরিত্র হলো- চাঁদ সওদাগর, বেহুলা ও লখিন্দর।
পার্বতী ছাড়া কারো প্রতি শিবের কাম হয় না। প্রেমে মগ্ন শিব একদিন পার্বতীর কথা চিন্তা করে কাম চেতনায় বীর্য বের হয়ে যায়। সেই বীর্য পদ্ম পাতার ওপরে রাখেন। বীর্য পদ্মের নাল বেয়ে পাতালে চলে যায়। পাতালে সেই বীর্য থেকে মনসার জন্ম। সেখানে বাসুকীর কাছে বড় হয় মনসা। বাসুকী তার কাছে গচ্ছিত শিবের ১৪ তোলা বিষ মনসাকে দেন। যুবতী মনসা পিতার কাছে ফিরে এসে তার পরিচয় দেয়। আবদার করে কৈলাসে বাপের বাড়ি যাবার। শিব তার স্ত্রী পার্বতীর ভয়ে কন্যাকে নিতে চান না। পরে মন্দিরে ফুলের ডালিতে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু পার্বতী মনসাকে দেখে ফেলে। মনসাকে সতীন মনে করে এক চোখ অন্ধ করে দেয়। মনসা পার্বতীকে দংশন করে, শিবের অনুরোধে পার্বতীকে আবার জীবিত করে তোলে। পার্বতীর রোষে মনসাকে বনবাসে দেয়া হয়। এরমধ্যে ব্রহ্মর বীর্য ধারণ করে মনসা উনকোটি নাগ জন্ম দেন। এরপর মনসা সর্পদেবী আকারে হাজির হন। বনবাস থেকে ফিরে মনসা নিজের পূজা প্রচলনের আবদার প্রকাশ করে পিতার কাছে।
লখিন্দরের পিতা চন্দ্রবণিক বা চাঁদ সওদাগর ছিলেন হিন্দু দেবতা শিবের একনিষ্ঠ পূজারী। তাই তিনি অন্য কোনো দেবতার আরাধনা করতেন না। অপরদিকে শিবের কন্যা মনসা ছিলেন সর্পদেবী, তিনি কোথাও পূজিতা হতেন না। পিতা শিবের উক্তি- যদি কোনো ভক্তিমান শৈব বা শিব উপাসক মনসার পূজা করেন তাহলেই মর্ত্যে তার পূজার প্রচলন সম্ভব। তখন মনসা চাঁদ সওদাগর কে নির্বাচন করে তাকেই অনুরোধ করেন মনসা পূজার আয়োজন করতে। শিব উপাসক চাঁদ সওদাগর মনসার প্রস্তাবে অস্বীকৃত জানান। ক্রোধোন্মত্ত মনসা অভিশাপ দেন- প্রত্যেক পুত্রের জীবন বিনাশ করবেন। একে একে লখিন্দর ব্যতীত চাঁদ সওদাগরের সকল পুত্রই সর্পদংশনে মারা যায়। তাই লখিন্দরের বিয়ের সময় চাঁদ সওদাগর অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে দেবতা বিশ্বকর্মার সাহায্যে এমন বাসরঘর তৈরি করেন যা সাপের পক্ষে ছিদ্র করা সম্ভব নয়।
সকল সাবধানতা সত্তে¡ও মনসা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সমর্থ হয়। মনসার পাঠানো সাপ লখিন্দরকে দংশন করে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে যারা সাপের দংশনে মারা যান তাদের সৎকার প্রচলিত পদ্ধতিতে না করে মৃতদেহ ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো এ আশায় যে, ব্যক্তিটি হয়তো কোনো অলৌকিক পদ্ধতিতে ফিরে আসবে। বেহুলা সবার বাধা অগ্রাহ্য করে তার মৃত স্বামীর সাথে ভেলায় চড়ে বসে। তারা ছয় মাস ধরে যাত্রা করে এবং গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে। মৃতদেহ পচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসী বেহুলাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। তবে মনসা ভেলাটিকেই কেবল ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
ভেলাটি মনসার পালক মাতা নিতার কাছে আসে। তিনি নদী তীরে ধোপার কাজ করার সময় ভেলাটি ভূমি স্পর্শ করে। নিতা মনসার কাছে বেহুলার নিরবচ্ছিন্ন প্রার্থনা দেখে বেহুলাকে তার কাছে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে পৌছে দেন।
সেখানে মনসা কাছে লখিন্দরকে ফেরত চান বেহুলা। মনসা বলেন,
তুমি তাকে (লখিন্দর) ফিরে পাবার যোগ্য, কিন্তু এটি কেবলি সম্ভব হবে যদি তুমি তোমার শ্বশুরকে আবার আমার পূজারী করতে পার।
‘পারব’ বলতেই স্বামীর মৃতদেহে জীবন ফিরে আসতে শুরু করে। ক্ষয়ে যাওয়া মাংস ফিরে আসে এবং লখিন্দর তার চোখ মেলে তাকায়।
পথপ্রদর্শক নিতাকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। বেহুলা তার শাশুড়ির সহযোগিতায় চাঁদ সওদাগরকে মনসার উপাসনা করতে সম্মত করেন।
মনসা-মঙ্গল কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অনন্য কীর্তি। হরিদাস, বিজয়গুপ্ত, নারায়ণ দাস, কেতকা দাস ও ক্ষেমানন্দ প্রমুখ মনসা-মঙ্গল রচনা করেছেন। সাধারণত রাত জেগে মনসা-মঙ্গলের নাটক পরিবেশন করা হয়। রংপুর অঞ্চলে বিষহরির গান, রাজশাহী-নাটোর অঞ্চলে পদ্মাপুরাণ গান, কুষ্টিয়ায় পদ্মার নাচন, টাঙ্গাইল জেলায় বেহুলার নাচাড়ি, দিনাজপুর অঞ্চলে কান্দনী বিষহরির গান, সুনামগঞ্জ অঞ্চলে মনসার টপযাত্রা, বরিশাল অঞ্চলের রয়ানী গান উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে এটি মনসার ভাসান নামে পরিবেশিত হয়।
পরিবেশনার রীতি, বিশ্বাস, কারণ ও ভাবের আড়াল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা আঙ্গিকে ভাসান যাত্রার পরিবেশনা রীতি চালু আছে। সাধারণত শ্রাবণ সংক্রান্তিতে এই নাট্যগুলো হয়ে থাকে। মনসা-মঙ্গলের এই পরিবেশনার পেছনেও রয়েছে নানা রকম কারণ। যেমন মানত, ইচ্ছাপূরণ, বিনোদন ইত্যাদি। এছাড়া মানত পূরণে বছরের যে কোনো সময়ই এর আয়োজন করা যায়। সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস চলে আসছে- মনসাদেবীর গান বা পূজা করলে দেবি বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেন। তবে এই পরিবেশনার জন্য আলাদা আলাদা দল আছে। তারা নিজ নিজ অঞ্চলে বিশেষ সম্মানের অধিকারী। আবার কিছু কিছু পরিবেশনকারী দল পরিবেশনার বিপরীতে কেনো সম্মানী নেন না।
মনসা-মঙ্গল কাব্য সর্পদেবী মনসাকে নিয়ে লেখা। মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিরা বৈষ্ণব পদাবলী লিখতেন। বৈষ্ণব পদাবলীতে দুনিয়ার সাথে ভাবের আড়াল আছে। কিন্তু গ্রামীণ আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে লেখা মনসা-মঙ্গল কাব্যে সে আড়াল নাই। এটা একদম সাধারণ মানুষ আর মাটির গন্ধমাখা সাহিত্য।