পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
বিমানবন্দরে কাস্টমসের বৈতরণী পার হবার পরই একজন এসে প্রত্যেক যাত্রীকে একটি করে পানির বোতল ও খেজুরের প্যাকেট দিয়ে গেলেন। এজেন্ট শুধু বিমানের টিকিট ও ভিসার কাজ করে দিয়েছে। সৌদিতে থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের ব্যবস্থা আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। লাগেজ নিয়ে বের হবার পর মক্কা যেতে এক আরব যুবক ট্যাক্সিওয়ালা চাইল ২০০ রিয়াল। আমরা ১০০ রিয়াল বলে সামনে এগোলাম। পাশ থেকে এক বাংলাদেশি কর্মী ভাই বললেন যে, ট্যাক্সিওয়ালা বেশি চায়নি। তবু যাচাইয়ের জন্য সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। সেই ট্যাক্সিওয়ালাও আমাদেও পেছনে এসে বললো- ১৫০ রিয়ালে যাবো কিনা। আমরা না বলাতে সে ১০০ রিয়ালেই রাজি হয়ে গেলো। আমরা আসরের নামাজ পড়ে গাড়িতে উঠতে চাইলে সে বললো তার গাড়িতে জায়নামাজ আছে। তার গাড়ির পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে পার্কিং লটেই নামাজ আদায় করলাম। যাত্রার শুরু হলো। ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল সে। চালাতে চালাতে গল্প করছিলো। ভালোই ইংরেজি বলে। নাম আব্দুল্লাহ। আমরা আশা করছিলাম মক্কা পৌঁছে ইফতার করতে পারবো। কিন্তু মক্কা থেকে অল্প দূরে থাকতেই মাগরিবের সময় হয়ে গেলে আব্দুল্লাহ একটা মুদি দোকানে গাড়ি থামালো। আমিও নামলাম। তিনজনের ইফতারি সামগ্রী জড়ো করলো আব্দুল্লাহ। আমি দাম দিতে গেলাম। কিন্তু কিছুতেই দাম দিতে দিলো না সে। বললো- হাজি তোমরা আমার দেশের মেহমান, আমি তোমাদেরকে খাওয়াবো। মাগরিবের অল্প পর হোটেলের কাছে পৌঁছে গেলাম। টিপস দিলাম ২০ রিয়াল। কিন্তু ও মনে করলো- আমি বুঝি ইফতারির দাম হিসাবে ওটা দিচ্ছি। তাই কিছুতেই সে ওটা নিতে চাচ্ছিলো না। যখন ওকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে, এটা ইফতারির জন্য নয় বরং ভালো গাড়ি চালানোর টিপস, তখনই সে সেটা নিতে রাজি হলো।
মেহেদি আমার অনেক পুরোনো বন্ধু। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চার বছর একসাথে ছিলাম; খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেওয়ার সময়ে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আমরা সহকর্মী হিসাবে ছিলাম একই ডিসিপ্লিনে। তারপর ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত একসাথে একই সুপারভাইজারের অধীনে পিএইচডি করার সময় কানাডার অটোয়াতে একসাথে ছিলাম ছয় বছরের মতো। ফলে দীর্ঘ সময়ে দুইজনের বন্ধুত্ব প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হয়েছে। পিএইচডি শেষে আমি ফিরে এলাম বাংলাদেশে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর মেহেদী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে যোগদান করলো সৌদি আরবের তায়েফ ইউনিভার্সিটিতে। তায়েফ থেকে মক্কা মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। তাই পরিকল্পনা করেছিলাম যে, উমরাহ করার পর মেহেদির বাসা ঘুরে আসব। যাবার আগে মেহেদির সাথে যোগাযোগ করলে ও জানালো যেহেতু আমরা যাচ্ছি রমজানের শেষ ১০ দিনের মধ্যে এবং ওরও সম্ভাবনা আছে ওই সময় হারাম শরিফে ইতেকাফ করার। তাই হারাম শরিফেই আমাদের দেখা হবার সম্ভাবনা আছে ইনশাআল্লাহ।
আমাদের সফর ছিল সংক্ষিপ্ত। তিনদিন মক্কায় এবং একদিন মদিনায়। ২৪ রমজান মক্কায় উমরাহ শেষ করে মেহেদির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু ওর ফোন বন্ধ পেলাম। পরের দিনও যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলাম। ২৭ রমজান যেহেতু আমরা মদিনা যাব, তাই ২৬ রমজান যোহর নামাজের আগে বাসস্ট্যান্ডে দুই ভাই গেলাম ট্যাক্সি ও বাসের খরচ এবং সময়সূচি সম্পর্কে জানতে। তখন হোয়াটসঅ্যাপে মেহেদির মেসেজ পেলাম। সে জানাল- হারাম শরিফের কোনো গেটের কাছে ইতেকাফ করছে। যোহরের নামাজ শেষে গেলাম সেই গেটে। কিন্তু সেখানে ইতিকাফ করছেন অনেক মানুষ। তাদের মধ্য থেকে মেহেদিকে খুঁজে বের করা কঠিন কাজ। সেখানে ইতিকাফকারী দুই বাংলাদেশি ভাইকে বাংলায় কথা বলতে দেখে তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম-
মেহেদি নামে কোনো বাংলাদেশিকে চিনেন, যিনি এখানে ইতিকাফ করছেন?
-উনি কি প্রফেসর?
-জী
-আমরা তো এইমাত্র একসঙ্গে তাওয়াফ করে ফিরলাম। ওই যে ওইখানে উনি ঘুমাচ্ছেন।
মেহেদির বিছানার কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে হাত উঁচু করলাম। ও পুরু লেন্সের চশমা ব্যবহার করে। কিন্তু এক সময় ওর চোখে চশমা ছিল না। সালাম শুনে হাত উঁচু করে সালামের জবাব দিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। বুঝলাম ও আমাকে চিনতে পারে নাই। অন্যদের বিছানা ডিঙিয়ে ওর বিছানায় গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে ডাক দিতেই চিনতে পেরে ভীষণ খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরলো। বললো-আর একটু আগে এলে আমাকে এখানে পেতে না।-কেন?
-তাওয়াফ করতে গিয়েছিলাম। তাওয়াফ শেষে মাত্রই ফিরলাম।
– আলহামদুলিল্লাহ।
তারপরে মেহেদির সাথে ছিলাম ইফতারের পর পর্যন্ত। এই সময়টাতে আমল করার ফাঁকে ফাঁকে পুরোনো দিনের গল্প চলছিল। ইফতারিতে অনেক কিছু খেলাম। এতেকাফকারীদের জন্য সৌদি সরকার ইফতারির ব্যবস্থা করে। তার বাইরেও মেহেদি এবং আশেপাশের মানুষেরা বিচিত্র সব খাবার খাওয়ালেন। এক ফাঁকে মেহেদিকে জিজ্ঞাসা করলাম-মক্কা থেকে মদিনা যেতে ট্যাক্সি নিলে ভালো হবে না বাসে গেলে ভালো হবে?
-ট্রেনে যাও। নতুন বুলেট ট্রেন চালু হয়েছে। ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার বেগে চলে। মাত্র দুই ঘন্টায় পৌছে যাবে মদীনায়।
-কালকেই যাবো। এত অল্প সময়ে ট্রেনের টিকিট কাটা ঝামেলা না?
-আমার কাছে অ্যাপস আছে। আমি কেটে দিচ্ছি।
অনলাইনে ও টিকিট কাটলো। দুই ভাইয়ের টিকিটের দাম আসে সাড়ে পাঁচশত রিয়ালের মতো; যা বাংলাদেশি প্রায় ১৬০০০ টাকা। মেহেদিকে টাকা দিতে চাইলে সে তা নিতে অস্বীকার করে বলল যে, এটা তার পক্ষ থেকে দুই হাজির জন্য উপহার। অনেক চেষ্টা করেও যখন তাকে টাকাটা দিতে পারলাম না তখন বন্ধুর জন্য ত্যাগের আনন্দ তার কাছ থেকে নতুন করে শিখলাম।
অটোয়া ইউনিভার্সিটিতে আমার অন্য দুই সহপাঠী আবদুর রহমান ও শামীম। ছাত্রজীবন থেকেই দুজনেই খুব ধার্মিক। কানাডায় থাকাকালীন খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমরা। পিএইচডি শেষ করার পর শামিম যোগদান করে রিয়াদে কিং ফয়সাল ইউনিভার্সিটিতে আর আব্দুর রহমান যোগদান করে মদিনা ইউনিভার্সিটিতে। আব্দুর রহমান মদিনাতেই থাকে। শামীমও আমাদের সৌদি সফরের সময়ে সপরিবারে মদিনায় অবস্থান করছিল। মদীনায় পৌঁছে শামীমকে ফোন দিলাম।
-শামীম আমি এখন মদীনাতে। তোমার সঙ্গে দেখা হবে কিভাবে?
– আজ তারাবির পর দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। ক’দিন আছো মদিনায়?
-মাত্র একদিন-একরাত। আগামীকাল সকালে জেদ্দা হয়ে দেশে ফিরে যাবো ইনশাআল্লাহ।
-তাহলে আজ রাতে তোমরা আমাদের সাথে খাবে।
-না শামীম। আজ ২৭ রমজান, কদরের রাত। খাবারের ঝামেলার কোনো দরকার নেই।
-অসুবিধা নেই, তারাবির নামাজ এবং তাহাজ্জুদের নামাজের মধ্যে একটু সময় পাওয়া যাবে ওই সময় একসাথে খাব।
-দেখা হওয়াটাই জরুরি, খাবারের ঝামেলা বাদ দাও।
-ঝামেলা আর কি? আমরা তো আমল বাদ দিয়ে খাওয়া দাওয়া করছি না। হাজিদের খেদমত করাও একটা বড় আমল।
তারাবি নামাজের পর আব্দুর রহমান ও শামীমের সাথে দেখা হলো। ওরা আমাদের দুই ভাইকে গাড়িতে করে নিয়ে গেল আব্দুর রহমানের বাসায়। সেখানে সৌদি আরবের সবচেয়ে ভালো খাবারের দোকান আল রোমান্সিয়া থেকে আনানো হরেক রকম খাবার অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। অনেক খাবারের নামও জানি না। মহাতৃপ্তি নিয়ে আহার শেষে আবার ওরা মদীনা শরিফে পৌঁছে দিল তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য।
মহান আল্লাহ এই সকল উদার মানুষের উত্তম প্রতিদান দিন এবং আমাদেরকেও উদারতা শিক্ষা দিন। আমিন।