লেখকঃ হোমায়েদ ইসহাক মুন (হোমায়েদ ইসহাক মুন। ছবি–আভিজিৎ নন্দী ও দোলন)
বেড়াই বন্ধুদের দল বিটিইএফ এই বছরই ২২–শে পা দিতে যাচ্ছে। অতিমারি মহামারি সব কাটিয়ে আমরা প্রায় দুইটি বছর পর আবার একসাথে বেড়িয়ে পড়লাম। সবাই একসাথে বের হতে পারলে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। মানুষগুলোর মনের বয়স আর ভ্রমণের আগ্রহ এতটুকুও কমেনি। সেই পুরনো দিনের মতো বিস্তর গবেষণা আর আগাম যোগাযোগ করে অনেকগুলো নদী দেখার পরিকল্পনা করা হলো।
মে মাসে আমরা রওনা হলাম। বর্ষার মৌসুম চলে এসেছে। নদীতে পানি ভরপুর। এটাই উত্তম সময় নদী ভ্রমণের। তার আগে একটু বলে নিই- নদ আর নদীর পার্থক্য আছে শাখা প্রশাখার মধ্যে এমনটাই আমাদের সর্বসাধারণের ধারণা। আসলে ব্যাপারটি ভিন্ন। নদ ও নদীর সাথে শাখা থাকা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। এই দুয়ের মাঝে যা পার্থক্য আছে তা হলো ব্যাকরণগত। বাংলা, হিন্দি, ফারসি ইত্যাদি ভাষার ক্ষেত্রে পুরুষবাচক শব্দ সাধারণত অ-কারান্ত এবং নারীবাচক শব্দ আ-কারান্ত বা ই, ঈ-কারান্ত হয়। যেমন- রহিম (অ-কারান্ত), রহিমা (আ-কারান্ত, নামের শেষে আ আছে), রজক (অ-কারান্ত), রজকী (ঈ-কারান্ত, নামের শেষে ঈ আছে)। তেমনিভাবে ফুল-ফুলি, কুমার-কুমারী, নদ-নদী ইত্যাদি। তাই যে সব নদীর নাম পুরুষবাচক অর্থাৎ অ-কারান্ত সেগুলো নদ আর যেগুলোর নাম নারীবাচক অর্থাৎ আ-কারান্ত বা ঈ, ই-কারান্ত সেগুলো নদী। এই কারণে ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী থাকলেও এটি নদ। একই কারণে নীল নদী নয় নদ। অনেকে আমাজন নদী বললেও উপরোল্লিখিত কারণে তা হবে নদ।
রাত সাড়ে ৯টায় রাজধানীর এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। দলে ১৪ জন। পুরনো সেই মুখগুলো আবার একত্র হলাম। নতুনদের মধ্যে দোলন আর বিদ্যুৎ ভাই মুখ চেনা থাকলেও একসাথে ট্রিপে যাওয়া হয়নি। টিকিট চাইতে টিটি আসলে রবিন ভাই বলে উঠলো- ‘আমি রেলমন্ত্রীর জামাই’। সবাই একযোগে হেসে উঠলাম।
ভোর সাড়ে ৬টায় কুড়িগ্রাম স্টেশনে নামার পরই শুরু হলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। বাংলাদেশের উত্তরের শেষ প্রান্তে এই কুড়িগ্রাম স্টেশন। ছিমছাম আর ভিড়ভাট্টা কম। স্টেশনের সাথে লাগোয়া হোটেলে আমরা নাস্তা সেরে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। তিন মরতবা চা খাওয়া হয়ে গেল, তাও বৃষ্টি থামার নাম নেই। স্টেশনের শেষ মাথায় অল্প হেঁটে গেলে টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার তল। বৃষ্টি মাথায় এই স্নিগ্ধ সকালটা একটু উপভোগ করে নিলাম।
সকাল ১০টা বেজে গেল বৃষ্টি থামতে। তারপর এক অটোয় গাট্টি-বোচকা ও শুকনো খাবার-দাবার এবং অন্য তিনটিতে আমরা সবাই চাপাচাপি করে রওনা হলাম যাত্রাপুরের পথে। ঘাটে আমাদের জন্য নৌকা বাঁধা আছে। ধরলা নদীর শাখার ওপর ভাঙা সেতু পার হওয়ার পর ভালো লাগা আরও দিগুণ হলো। এখানে হালকা বসতি, বড় কোনো গাছ চোখে পড়লো না। ধান উঠতে শুরু করেছে এখন, বৃষ্টিটা আর দুই দিন পর এলে চাষিদের কষ্ট থাকত না।
যাত্রাপুর যখন গিয়ে নামলাম তখন ভরদুপুর। নৌকায় তিনদিন থাকার জন্য সদাইপাতি কিনতে আমরা কজনা বাজারের দিকে গেলাম। শুক্রবার বলে বেশিরভাগ দোকানই ছিল বন্ধ। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের মতো গুছানো নৌকা নয় এটি। সবকিছু আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। সুতরাং খানা-দানা, সদাইপাতি, থালা-বাটি সবকিছুর আয়োজন করেই নৌকায় উঠতে হলো।
তিনদিনের জন্য বাজার করলাম- চাল, ডাল, মুরগি, সবজি, মোটা সাদা প্লাস্টিক, আরও টুকটাক সদাইপাতি। রান্না করার জন্য গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডারের ব্যবস্থা আছে। এবার মনে হচ্ছে একটু আরাম করে রান্না করতে পারব। নৌকা ট্রিপে রান্না নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। নৌকাটির গলুই বেশ চওড়া, দুইজন পাশাপাশি শুয়ে জলের সৌন্দর্য দেখতে পারবে। শক্তপোক্ত বাঁশের ছই আছে। এর ওপর জনা দশেক বসা যাবে। নাওয়ের শেষ প্রান্তে কাঠের ওপর তক্তা আর শক্ত বেড়া দিয়ে টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিচে চাপাচাপি করে আমাদের ১৪ জনের শোয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নৌকার মাঝি আছেন তিনজন। কুড়িগ্রামের শাহজাহান ভাই আমাদের এই নৌকা ঠিক করে দিয়েছেন। তিনি আমাদের সাথে যুক্ত হবেন পরশুদিন।
দুধকুমার নদীর উজান ধরে আমাদের নৌকা চলতে শুরু করলো। আজকে এবং আগামীকাল কেবল উজানের দিকেই চলতে থাকব আমরা। চিলমারী বন্দর থেকে আরও উত্তরে ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি গিয়ে আবার ভাটির দিকে ফেরত আসব। নদীটার দুই পাড়ে বালি আর বালি। দূরে দূরে ঘরবাড়ি। মাঝে মাঝে তিনকোনা নীল রঙা ঠেলা জাল দিয়ে কেউ কেউ মাছ ধরছেন। উজান থেকে ঢল নামছে জোরে। এটা হচ্ছে সেই নদী যে নিত্যই এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে। নদীটা আঁকাবাঁকাও বটে। আমরা চলার পর থেকেই পূবধারে ভাঙনের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। নদীর মাঝখানেও এক দুজায়গা উঁচু হয়ে থাকতে দেখলাম। মনে হলো সদ্য প্রসূত চর; চরগুলোর এখানে সেখানে দুচার গাছি ঘাস দেখলাম। কাছে পিঠে দেখলাম কিছু ধ্যানী বক আর মাছরাঙা।
আকাশে মেঘ জমে আছে। দুধকুমার নদীতেও বহমান স্রোত। নৌকার সামনের অংশটা মাখন জায়গা। কয়েকজন জায়গাটা আগেই দখল করে বসে পড়েছে। নৌকার চোখা জায়গায় পানি কেটে যাওয়া দেখা যায়। যেন মেঘ ফুঁড়ে নীল আকাশের বুকে ঢুকে যাচ্ছি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সবার চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। হাঁড়িতে চা বসালাম। সন্ধ্যা যখন রাতে গড়াল তখন আমরা নৌকা থামানোর কথা ভাবলাম। আয়নালের ঘাটে নৌকা থামলো। উপজেলা নাগেশ্বরী। পল্লব ভাইয়ের কাছে জানলাম, কুড়িগ্রামে সাড়ে চারশ চর আছে। সংখ্যাটা অবাক হওয়ার মতোন। বসতি আছে যে চরগুলোয় তার সবগুলোতেই বিদ্যুৎ আছে। তবে চরের লোক পাকা ঘর বাধে না। বসতিগুলো বয়স্ক হওয়ার সময়ও পায় কম। বার বারই ভাঙাগড়ার মধ্যে থাকতে হয় তাদের। বড়জোড় মসজিদটা হয় পাকা আর তা নদীর ধার থেকে দূরেই হয়।
কুড়িগ্রাম কৃষিপ্রধান অঞ্চল। ধান, গবাদি পশু আর মাছ নিয়েই তাদের জীবন। কোনো কোনো চরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নেই। ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আয়নালের ঘাটে লোকসমাগম থাকে। স্থলপথে যারা বগুড়া থেকে, রংপুর থেকে বা ঢাকা থেকে এসে পূবপাড়ে যেতে চান তারা এই ঘাটের ওপরই নির্ভরশীল। পারাপারের নৌকাগুলো ফেরি কিছিমের। আমরা ঘাটে এসে জুয়েল চাচার দোকানে চা খাই আর আড্ডা দিই। চাচা আমাদের এখানে বেড়াতে আসার উদ্দেশ্যটাকে ঠিক মেলাতে পারছিলেন না। বিশ্বাসযোগ্য করতে আমাকে আস্তে করে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আপনারা খালি খালি এখানে বেড়াইতে আহেন নাই, নিয়শ্চই অন্য কামে আইছেন’। আমি চাচাকে যতই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি, কাজ হয় না।
পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায় আজগর মাঝি নাও ছাড়লেন। আমরা ভূরুঙ্গামারীর দিকে এগোতে থাকলাম। এই অঞ্চলে রুই মাছকে ভূরুঙ্গা বলা হয়। আসলে এখানে রুই মাছকে তিন নামে ডাকা হয়। একদম ছোট থাকতে ভূরুঙ্গা, একটু বড় হলে ডোমনা আর বড় মাছকে রুই বলে।
ঘণ্টাখানেক পর জেগে ওঠা চর দেখে অভিজিৎ উৎফুল্ল হয়ে নৌকা থামাতে বলল। চরটার খাড়া পাড়, চত্বরটা সবুজে মোড়ানো। নাম ফকিরের চর। আমরা নেমে পড়লাম। দোলন ড্রোনের যন্ত্রপাতি সেট করে উড়াতে শুরু করে দিল। অভির বুদ্ধিতে আমরা খাড়া পাড়ে পা দুলিয়ে বসলাম। দোলন ছবি তুলল টপাটপ।
চলতে চলতে সূর্য যখন পশ্চিমে হেলেছে তখন আধা ডোবা চর দেখে আমরা থামলাম। জাল দিয়ে কয়েকজন মাছ ধরছিলেন, তাদের কাছ থেকে তাজা মাছ কেনা হলো। রাতে সেই মাছ ফ্রাই আর ভুনা করলাম। খেতে বসে বুঝলাম অমৃত।
যেতে যেতে বিকাল নামলে সোনাহাট সেতু দেখতে পেলাম। সেতুটা দেখার আগ্রহ ছিল সবারই। এটি উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার পূবে বঙ্গ সোনাহাট ইউনিয়নে পড়েছে। স্থানীয়রা একে পাটেশ্বরী সেতু নামেই বেশি চেনেন। সেতুর এক কিলোমিটার দূরে পাটেশ্বরী বাজার এককালে দারুণ জমজমাট ছিল।
শুরুর দিকে ছিল রেল সেতু এখন সড়ক সেতু। তিনটি যুদ্ধের সাক্ষী এই সেতু তার মধ্যে দুটিই বিশ্বযুদ্ধ। ইতিহাস বলছে, ১৮৮৭ সালে ব্রিটিশরা তাদের সৈন্য ও রসদ পরিবহণের জন্য লালমনিরহাট থেকে ভূরুঙ্গামারী হয়ে মনিপুর যাওয়ার জন্য গোয়াহাটি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করে। তারই অংশ হিসেবে এটি তৈরি করা হয়। সৈতুটি ১২০০ ফুট দীর্ঘ। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা এর একটি অংশ ভেঙে দেন যেন পাকবাহিনীর চলাচল ব্যাহত হয়।
এই নদী পথ ধরে গিয়েছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা (১৫৯১-১৬৬৩)। তিনি ঢাকা ও এর আশপাশে সৈন্য চলাচল, যন্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ পরিবহণের নিমিত্তে দুটি রাস্তা ও সেতু তৈরি করেছিলেন। কয়েকটি দুর্গ তৈরি করেছিলেন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংহত করার স্বার্থে।
ফিরতি পথে দুধকুমার পেরিয়ে আমরা পেলাম ধরলার মুখ, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তার মুখ তারপর যমুনা। কুড়িগ্রাম থেকে গাইবান্ধার ওপর দিয়ে এলাম জামালপুর। এরপর ঢাকার বাস ধরবো। উজান ভাটির এই নদীতে ভাসতে ভাসতে স্মৃতির পাতায় আরও কিছু সুন্দর সময় যোগ হলো।