ইমরান উজ-জামান
নদীর পাড়ে হাজার হাজার নর-নারীর সম্মিলন। কক্সবাজারের রামুর বাকখালী নদীতে ভাসছে নানা রঙের জাহাজ। বাঁশ, বেত, কাঠ দিয়ে তৈরি খোলসে রঙিন কাগজ আর ককসিটে রঙ্গ করে আর রঙিন কাগজে সাজানো হয়েছে। বিশেষ হাতের ছোঁয়ায়, বিশেষ নকশার এই জাহাজগুলো। যারা জাহাজ তৈরি করেন তাদের স্থানীয় ভাষায় ‘ছেরা’ বলা হয় যার বাংলা ‘কারিগর’। সাজানো ঘরটা চারটা অথবা পাঁচটা লম্বাকৃতির আঞ্চলিক ইঞ্জিন নৌকা পাশাপাশি বেঁধে তার ওপর রাখা হয়েছে। অপূর্ব কারুকার্যে তৈরি দৃষ্টিনন্দন জাহাজগুলো বাকখালী নদীর এদিক ওদিক যাচ্ছে, আসছে। জাহাজে জাদি, মন্দির, সিংহ, সাপ, প্লেন এবং বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতিসহ রাখাইন ধর্মকাহিনীর নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এসব জাহাজে।
রামুর পূর্ব রাজারকুল, হাজারীকুল, হাইটুপী রাখাইন পাড়া, হাইটুপী বড়–য়াপাড়া, দ্বীপ-শ্রীকুল, জাদিপাড়া ও মেরংলোয়া গ্রাম থেকে মোট ৮টি কল্পজাহাজ ভাসানো হয়েছে। এ বছরের ‘জাহাজ ভাসানি’ উৎসবে বাকখালীর পাড়ে ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় এমপিসহ ঢাকা থেতে আগত অতিথিবৃন্দ। জাহাজ তৈরির ৮টি সংঘকে দেয়া হয় ক্রেস্ট, শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয় ঢাকা থেকে আগত ও স্থানীয় শিল্পীবৃন্দ।
প্রতিটিতে লাগানো মাইক, শিশু-কিশোররা জাহাজে চড়ে নানা বাদ্য বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, চকরিয়া, উখিয়া, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসবে যোগ দেন উৎসবপ্রিয় মানুষ। হাইটুকি-শ্রীকুল আর রাজারকুল বাকখালী নদীর দুই পাড়ের গ্রামের মানুষের আজ আনন্দ উদযাপন আর উপভোগের বাইরে কোনো কাজ নেই।
৯ অক্টোবর প্রবারণা, পরদিন ১০ অক্টোবর ‘জাহাজ ভাসানি’ উৎসবে বাকখালী নদীর দুই পাড়ে বসে মানুষের মেলা। বাইপাস থেকে নেরুলোয়া, চৌমুহনী, চেরেংগা হয়ে বাকখালী নদী পর্যন্ত ৭টি বৌদ্ধমন্দির বা ক্যাং। এই ক্যাংগুলোকে কেন্দ্র করে পল্লীতে জাহাজ ভাসানোর আগে থেকে মাসজুড়ে চলতে থাকে আনন্দ আয়োজন।
সারাদিন জাহাজ নিয়ে বাকখালী পরিভ্রমণ ও দুই পাড় থেকে মানুষের অংশগ্রহণ শেষে সন্ধ্যায় শেষ হয় যুবক-যুবতীদের জাহাজ পরিভ্রমণ। শেষে নৌকা থেকে জাহাজগুলোকে আলাদা করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। কিছু জাহাজ আবার এমনি নদীর পাড়ে পড়ে থাকে।
ইঞ্জিনচালিত নৌকার সারিতে বসানো জাহাজগুলোকে পালকির মতো মনে হচ্ছিল। এই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে না থেকে, মন চাচ্ছিল যুবক-যুবতীদের সঙ্গে উৎসবে অংশ নিতে। রাখাইন বন্ধু উসাই মং যেন মনের কথা বুঝতে পারলেন, বললেন- দাদা উঠে আসেন। উঠে পড়লাম জাহাজে, দেখি স্বর্গের খোঁজ পাওয়া যায় কিনা। জাহাজের এক পাশে বাঁশের মাচানে বসে বাকখালীর নরম পানির ছটায় পরিবেশে স্বর্গের আবেশ যেন বিরাজ করছিল। জাহাজ একবার নদীর এই পাশে ভিড়ে আবার অন্য পাশে। বাকখালীর প্রবল ¯্রােত জাহাজকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, যুবকরা বুক পানিতে হেঁটে হেঁটে জাহাজ টেনে নিয়ে আসে ঘাটে। এভাবে চলতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
এই জাহাজ ভাসানোর প্রস্তুতি সেই মাসাধিককাল থেকেই শুরু হয়েছে। প্রতিদিন রাতের খাবার সেরে পাড়ার শিশু কিশোর ও যুবকরা জাহাজ তৈরি করে। ঢোল, কাঁসর, মন্দিরা, বাঁশিসহ নানা বাদ্য বাজিয়ে পাড়া থেকে জাহাজ তৈরির টাকা সংগ্রহ করা হয়। নানা বাদ্যের তালে তালে সমস্বরে গাওয়া হয় বুদ্ধ-কীর্তন অথবা অন্য কোনো গান।
‘শুকনো ডালে ফুল ফুটিল,
স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এল,
কে কে যাবি আয়রে,
বুদ্ধের মতো এমন দয়াল আর নাইরে’
কীর্তনের সঙ্গে সমান তালে চলে নাচও। এভাবে পাড়ার প্রতিটি বাড়ি বাড়ি এবং নিজের পাড়া ছাড়িয়ে অন্য পাড়ায়ও চলে যায় উৎসাহী এসব শিশু-কিশোরের দল। প্রবারণা পূর্ণিমার আগের দিন পর্যন্ত চলে টাকা সংগ্রহ ও জাহাজ তৈরির এই আনন্দ যজ্ঞ।
জাহাজ তৈরির জন্য অর্থ সংগ্রহে গেলে পাড়া-পড়শিরা যার যার সাধ্যমতো সহায়তা দেন। এ সময় কোনো বাড়িতে প্রত্যাশিত অর্থ বা চাঁদা না দিলে ওই বাড়ির ওঠানে দীর্ঘক্ষণ নাচ, গান করে এর প্রতিবাদ জানানো হয়। দাবি পূরণ হলেই সাধু, সাধ, ধ্বনিতে নেচে গেয়ে ওই বাড়ি ত্যাগ করেন তারা।
প্রবীণদের মুখে শোনা যায়, দুই-চার বছর আগেও রাতের বেলায় কল্পজাহাজ তৈরি এবং পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে জাহাজের জন্য অর্থ সংগ্রহের আনন্দ ছিল আরেকটি উৎসবের মতো।
তিনমাস বর্ষাবাস বা বর্ষাব্রত শেষে সারা দেশে নানা আনুষ্ঠানিকতায় প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করা হলেও এই দিনটিকে ঘিরে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বাঁকখালী নদীতে আয়োজন করা হয় জাহাজ ভাসান উৎসব। কক্সবাজারের চৌফলদন্ডী, চকরিয়ার হারবাং ও খুরুশকুলের রাখাইনেরাও ছোট্ট পরিসরে জাহাজ ভাসান উৎসবের আয়োজন করে। তবে শত বছর ধরে একমাত্র রামুতেই বর্ণাঢ্য আয়োজনে জাহাজ ভাসান উৎসব পালন করা হয়।
প্রচলিত আছে, আজ থেতে প্রায় দুইশ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ¤্রাজংবার্ন প্রথম জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এই উৎসবের প্রচলন হয়। যার বয়স প্রায় শত বছর।
এই জাহাজ ভাসানি উৎসবের ধর্মীয় ঐতিহাসিক ঘটনা আছে। যা বুদ্ধরা সত্য বলে মানে, মহামতি বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে বৈশালী রওনা করলেন। পথে নাগলোকের মহাঋদ্ধিমান অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন নাগেরা বুদ্ধকে সেবা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। নাগলোকের পাঁচশত নাগরাজ জাহাজসদৃশ্য পাঁচশত ঋদ্ধিময় ফণা বুদ্ধসঙ্গীসহ পাঁচশত ভিক্ষুসংঘের মাথার ওপর বিস্তার করলো। বুদ্ধর প্রতি নাগদের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ দেখে দেবলোকের দেবতারা, ব্রহ্মলোকের ব্রহ্মরা বুদ্ধকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করতে শুরু করলেন। সেই দিন মানুষ, দেবতা, ব্রহ্মা, নাগ সবাই শ্বেতছত্র ধারণ করে ধর্মীয় ধবজা উড্ডয়ন করে বুদ্ধকে পূজা করেছিল। বুদ্ধ সেই পূজা গ্রহণ করে পুনরায় রাজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। সে শুভ সন্ধিক্ষণ ছিল শুভ প্রবারণা দিবস। মূলত এ হৃদয়ছোঁয়া চিরভাস্বর স্মৃতিকে স্বরণ করে বাংলাদেশের বৌদ্ধরা, বিশেষ করে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রবারণা পূণিমায় বাকখালী নদীতে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত স্বর্গের জাহাজ ভাসিয়ে প্রবারণা উদযাপন করেন।
রাখাইদের অন্যান্য উৎসবগুলোর মধ্যে গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ এই ত্রিবিধ স্মৃতিবিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমা।
গৃহত্যাগ সন্ন্যাস গ্রহণ বুদ্ধত্ব লাভের পর সারনাথে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুর প্রতি ধর্মচক্র প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রথম ধর্মপ্রচার ত্রিবিধ ঘটনার সাথে বিজড়িত আষাঢ়ী পূর্ণিমা বা বর্ষাব্রত।
বৈশাখ মাসের প্রথম দিন তারা সাংরাই উৎসব পালন করেন। জলকেলি বা লেই খেখু সাংরাইয়ের অন্যতম একটি আকর্ষণীয় পর্ব।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজের কৃত অপরাধ পাপ করে পরিশুদ্ধ হয়। আকাশে ফানুস বাতি উড়িয়ে তারা পুণ্য সঞ্চয় করে।
প্রবারণা পূর্ণিমা অর্থাৎ আশ্বিনী পূর্ণিমার পরবর্তী পূর্ণিমা দিনের মধ্যেবর্তী সময়ে কঠিন চীবর দান উৎসব হয়। দানের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে কঠিন চীবর দান। রাখাইন নারীরা তাঁত স্থাপন করে। রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে চীবর করে সংঘের নির্বাচিত ভিক্ষুকে চীবর দান করে থাকে। ত্রিচীবর হলো- সংঘটি, উত্তর এবং অন্তরবাসক। একদিনে বুনে কাপড় দান করা হয় বলে এর নাম চীবর দান।
রাখাইন বিয়ের আছে ভিন্নতা, সাধারণত ফসল তোলার মৌসুমে রাখাইরা বিয়ের অনুষ্ঠান করে থাকে। দুই পক্ষের সম্মতিতে ভালো দিন তারিখ দেখে আংটি পরানো হয়। বিয়ের কয়েক দিন আগে থেকে চলে ছেলে ও মেয়ে বাড়িতে উৎসব। মেয়ের বাড়িতেই হয় বিয়ের প্রধান আয়োজন। পাত্রপক্ষ বাজি ফুটিয়ে, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে কনেবাড়ি আসে। ঐতিহ্য অনুযায়ী বরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়াও একটি লম্বা দা, পাখা, তামাক খাওয়ার পাইপ সাথে নিয়ে আসে বরপক্ষ। বিয়ের আসরে বর-কনের জন্য সজ্জিত মঞ্চে বসে বরকে নাস্তা ছাড়াও তবারক দেয়া পান খেতে দেয়া হয়। লগ্নে কনেকে বরের পাশে বসানো হয়। বয়স্ক একজন বিশেষ পায়েস খাইয়ে দেন বরকে। বর-কনে একে অন্যকে খাইয়ে দেয়। ঐতিহ্য অনুযায়ী বিয়ের দিন বর পরে লুঙ্গি, ফতুয়া ও পাগড়ি এবং কনে পরে লুঙ্গি, ব্লাউজ। ওড়নার মতো একখ- কাপড় বদল হয়। ৩-৪ দিন পর কনেবাড়ি থেকে কনে নিয়ে বর নিজের বাড়ি যায়।
মৃত্যু রাখাইনদের অন্যতম বড় উৎসব। রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবাদ আছে, ‘জন্মে কাঁদো, মৃত্যুতে হাসো।’ গৌতম বুদ্ধের মতানুসারে, ‘জীবন হলো দুঃখের অসীম সমুদ্র। জীবনের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে নির্বাণ প্রাপ্তি। আর এই নির্বাণ আসে মৃত্যুতে। তাই মৃত্যু আনন্দের ও অপার শান্তিময়।’ সেই মতানুসারে রাখাইনেরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত করে জীবনকে স্মরণীয় করে তোলে। যাকে রাখাইন জাতির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির অংশ বলা যায়। বিশেষ করে রাখাইন পুরোহিতদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে কেন্দ্র করে আয়োজন হয় বর্ণিল উৎসবের।
রাখাইন সমাজ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধধর্মের সূত্র পিটকে গৌতম বুদ্ধের অতীত জীবনের কাহিীন বর্ণিত আছে ‘জাতক’ হিসেবে।
লেখক : সাংবাদিক, পরিভ্রাজক ও লোক গবেষক।