লেখকঃ রোদেলা নীলা
বেলা যতো বাড়ছে শহরে লোক বেড়ে চলেছে, সিবিডির বাইরে অন্যান্য সাবার্ব (outlying part of a city or town) থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসছে। তাদের কোলে বিড়াল কুকুর প্রিয় প্রাণীরাও আছে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম দুপুর বারোটাতেই ডার্লিং হারবার ভোরে গেছে লোকে। আমি খুবই মন খারাপ নিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো বায়না ধরলাম ছোট ভাইয়ের কাছে- মসী, (আদরের ডাক) আমি কিন্তু সারারাত জেগে থার্টি ফাস্ট দেখবো। তুই না করতে পারবি না।
-এটা কি বাংলাদেশ পেয়েছো আপু, তোমার যখন যা ইচ্ছা যেমন ইচ্ছা তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো, তোমাকে সিটি বাসের কার্ড করিয়ে দিচ্ছি, হেলথ ইন্সুরেন্স করে দিচ্ছি, তুমি শুধু মোবাইলটা সাথে রাখবা আর আমার এই ভিজিটিং কার্ড ধরো- এটা রাখলেই হবে, তারপর তুমি হারিয়ে যাও কোনো সমস্যা নাই। লোকাল পুলিশ ঠিকই তোমাকে আমার কাছে দিয়ে যাবে। এক মাসের জন্য অস্ট্রেলিয়া ঘুরতে এসেছো, মনের সাধ মিটিয়ে ঘুরো।
-আমি যদি হাঁটতে হাঁটতে এতো লোকের মধ্যে হারিয়ে যাই তাহলে বাসায় ফিরবো কিভাবে? আমি তো রাস্তা চিনবো না।
-তুমি শুধু ট্রিপল জিরোতে কল দিবা, যেখানে পথ হারাবা সেখানেই দাঁড়ায় থাকবা, ওরা তোমাকে তুলে এনে আমার কাছে দিয়ে যাবে।
উন্নত শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শুধু গল্পে শোনার মতো নয়, এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। নারী হিসেবে আমার জন্য আরও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, চল্লিশোর্ধ আমি এতদিন এশিয়ার কিছু কান্ট্রির ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, এই প্রথম ওয়েস্টার্ন কান্ট্রি, ওয়েস্টার্ন নিউ ইয়ার, সব মিলিয়ে আমার উত্তেজনার কোনো কমতি ছিল না। চৌদ্দ বছরের বালিকাদের মতো নিজেকে সাজাতে লাগলাম, এর মধ্যে আলম আমাকে একটা ফর্ম ধরিয়ে দিল; এটা হেলথ ইন্সুরেন্স কাভার করবে। আমি অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরতে এসেছি, তবুও অস্ট্রেলিয়ান সরকার আমার শরীরের দায়িত্ব নিয়ে নিল, আমিতো মুগ্ধ! খুবই আহ্লাদ করে জিজ্ঞেস করলাম – তোদের হেলথ মিনিস্টার কে, তারেতো একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার।
আলম খুবই অবাক- উনি আবার কে?
-আমিইতো জিজ্ঞেস করছি তোকে, অস্টেলিয়ার হেলথ মিনিস্টার কে? আচ্ছা বাদ দে, প্রাইম মিনিস্টার কে?
আলম বিরক্ত- এতো বড় একটা দেশ, রাজধানী সিডনিতে না ক্যানবেরাতে, এতো নাম মনে নাই আপু, তুমি গুগল করে নাও।
-কী বলিস, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম এক মাসের বাচ্চাও জানে, আর যারা তোদের জন্য এতো সুন্দর শহর মেন্টেন করছে তাদের কারো নাম তুই জানিস না?
এবার আলম ভালো ক্ষেপেছে- আমি সরকারকে ৪০% ভ্যাট দিই, আমাকে সুযোগ সুবিধা দেবে নাতো কাদের দেবে, আমি তো বসে বসে বেকার ভাতা গিলি না, আমার টাকা আমারেই দেয়।
আমি হাসলাম- কিন্তু দেশেতো আমরাও ট্যাক্স দিই, কিন্তু রাস্তা ঘাটের যা অবস্থা!
আমার অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়, এত্তো বড় একটা দেশে কে মেয়র কে পিএম আর কেইবা প্রেসিডেন্ট, অদৃশ্য এক জাদুর ছোঁয়ায় সব চলছে যেন। কেউ মিছিল নিয়ে চিৎকার করছে না, কেউ টেলিভিশনের খবরে এসে অন্য দলের গুষ্টি উদ্ধার করছে না। বান্যারে ফেস্টুনে ভরে যাচ্ছে না শহর, এ আবার কেমন দেশ! কারা চালাচ্ছে এই দেশ!
এই প্রথম মধ্যরাতে খোলা মাঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে আলোর খেলা দেখছি, ছোট ভাই অনেক্ষণ থাকলো আমার পাশে বাবার মতো ছায়া হয়ে, রাত এগারোটা, সে বলল- এটা ডার্লিং হারবার আপু, এখানে সারা রাত ফায়ার ওয়ার্ক্স হবে, আসলটা শুরু হবে বারোটায়, তুমি থাকো, আমি ঘুমাতে গেলাম। কী নিশ্চিন্তে আমার ভাই ঘুমাতে চলে গেল, আমি একা নই আমার মতো শত শত মেয়ে হারবারের মাঠে শুয়ে বসে ফায়ার ওয়ার্ক্স দেখছে। ডার্লিং হারবার বিশাল আয়তনের একটি পার্ক, মূলত লোকেরা এখানে হাঁটাহাঁটি করতে বা আড্ডা দিতে আসে আর বাচ্চারা আসে পার্কে খেলতে, এখানে বাচ্চাদের নিশ্চিন্তে বাবা মা ছেড়ে দেন, পাশেই সিকিউরিটি পুলিশ আছেন চব্বিশ ঘণ্টা। চায়না গার্ডেনে ঢুকতে টিকিট লাগলেও এই অঞ্চল সবার জন্য একেবারেই উন্মুক্ত। আমি হেঁটে হেঁটে ফায়ার ওয়ার্ক্সের মূল পয়েন্টের দিকে এগোচ্ছি, এদিকটায় আরও ভিড়, টিনএজদের দখলে পুরো হারবার। ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে। সিডনিতে বেড়ানো সব চাইতে আরামের বিষয় পাবলিক টয়লেট, কোথাও ঘুরতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়তে হয় না। এতো মানুষের মধ্যে হাঁটতে ভালো লাগছে। কারণ একটা দারুণ বাতাস বইছে সারাক্ষণ আর খোলা জায়গায় স্মোকিং কেউ করে না, তাই বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর চারদিকে তীব্র উল্লাসে সবাই একসাথে কাউন্ট ডাউন করলো- তারপর শুরু হলো হ্যাপি নিউ ইয়ার, একটি নতুন বছরে আমরা পা রাখলাম- স্বাগতম ২০২৩। কেউ নাচছে, কেউবা গাইছে, নিউ সাউথ ওয়েলসের আকাশের রং কখনো নীল কখনো বা লাল কখনো বা কমলা রঙে সেজে উঠছে, কী সুন্দর দৃশ্য! আমি প্রথমবার দেখছি বলেই হয়তো অনেক বেশি মুগ্ধ; কিন্তু সিডনিবাসীরাও কম যায় না, তারাও মেতে উঠেছে নতুন দিনের আনন্দে, ননস্টপ মিউজিক চলছে।
রাত প্রায় দুটো, ফেরার পথ ধরতে হবে। আমি পার্কের গা-ঘেঁষে হাঁটতে আরম্ভ করলাম, সবাই যেদিকে ফিরছে। লাখ লাখ মানুষ একসাথে ফিরছি, পুরো বিষয়টা অসাধারণ। চায়না টাউনের রাস্তা ধরে ডান দিকে এগোতে থাকলাম, চায়না টাউন চিনতে আমার তেমন কষ্ট হচ্ছে না, কারণ ওখানে রাস্তার ওপর হোটেলে অনেকেই খাওয়া দাওয়া করে। আমিও লাল চা খাওয়ার লোভে এখানে উঁকি দিলাম। সত্যি পেয়েও গেলাম বহু আকাক্সিক্ষত লাল চা। আমাদের দেশের ঘন পাতি দিয়ে আদা চায়ের মতো জম্পেশ না হলেও গরম পেয়ালা হাতে ভালোই লাগছে, থুক্কু এটা প্লাস্টিক কাপ, ওরা যা দেবে ওয়ান টাইম, ফেরত নেবার মতো কোনো পাত্রে দেবে না।
রাত প্রায় শেষ করেই আমি ফ্ল্যাটে ফিরেছি, হাতে ফ্ল্যাটের দরজা খোলার কার্ড আমার কাছে আছে, চাবি বিষয়টা এখানে তেমন ব্যবহার হচ্ছে না; সবই কার্ড ঘষাঘষির ব্যাপার। আজ বিছানা নরম না, ভাইটা জাজিম দিয়ে গেছে। তাই ঘুমটাও বেশ ভালোই হবে, কতটা যে আজ হাঁটলাম!
রাতে আমি কখনোই এসি ছেড়ে ঘুমাই না, কিন্তু পরদিন সকালে খুব গরমে ঘুম ভেঙে গেল। মাথার ওপর তাকিয়ে হা করে রইলাম- এদের দেখি সিলিং ফ্যান নাই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ট্যান্ড ফ্যান ছেড়ে নিজেকে কিছুটা মেলে ধরলাম তার সামনে। আলম কফির মগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলো- গুড মর্নিং সিস।
এই দেশে মানুষ কথায় কথায় কফি খায়, তাপমাত্রা ১২ হলেও কফি, তাপমাত্রা ৩২ হলেও কফি।
গরমে ঘেমে মুখে পানি নিয়ে কফি হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম- এতো গরম কেনরে আজকে?
আলম হাসে। এটাই অস্টেলিয়া আপু, আজ টেম্পারেচার ৩৮।
আমি তো অবাক। গতকাল ছিল ২৬ আর আজ বেড়ে ৩৮?
আলমের ঠোঁটে রহস্যের হাসি- কিছুক্ষণ পর বৃষ্টিও পাবা। চলো ছাতা নিয়ে বাইরে, তোমাকে সিডনি হারবার আর অপেরা হাউস দেখিয়ে নিয়ে আসি, না হলে বলবা সিডনি দেখালাম না।
আমি আলসেমী করলাম- এক মাস আছি, অনেক দেখা যাবে।
আলম হেসেই কুটিকুটি- এতো বিশাল নিউ সাউথ ওয়েলস, তুমি এক মাসে কী দেখবা, চলো কিছু বাজার করাও দরকার।
আধুনিক প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর স্থাপত্যশৈলীর নাম অপেরা হাউস। সিডনির অপেরা হাউজ দেখতে সাদা পাল তোলা নৌকার মতো, ভবনটির সাদা চূড়া যেন সিডনি বন্দরের অবিকল নৌকার একটি বহরের মতো দেখায়। আর তাই সব মিলিয়ে ভবনটি যেন অন্য রকম নান্দনিক মাত্রা যোগ করেছে বন্দরটিতে। এই অসাধারণ ভবনটি মহাসাগরের এক প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে; যা দূর থেকে দেখতে অনেকটা উপত্যকার মতো মনে হয়। আর তাই এই জাদুকরী নান্দনিক ভবনটি বিশ্বের অন্যান্য স্বীকৃত স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ২০০৭ সালে অপেরা হাউসকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
সিডনি অপেরা হাউসে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়েজন করা হয়। বছরে প্রায় ১৫০০টি প্রোগ্রামের মধ্যে উপস্থিত থাকে প্রায় ১.২ মিলিয়নেরও বেশি দর্শক। আর সেখানে অসংখ্য শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। আগত দর্শনার্থীদের আনন্দ দিতে অপেরা হাউসের বাইরের উন্মুক্ত স্থানে চোখ ধাঁধানো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও প্রতিদিন সূর্যাস্তের পর সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আলোক প্রদর্শনী দেখানো হয়।
এই আইকনিক ভবনটি প্রায় ১ দশমিক ৬২ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এবং এর ছাদ তৈরিতে প্রায় ১০ লাখ টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। ভবনটির দৈর্ঘ্য ৬০৭ ফুট এবং প্রস্থ ৩৯৪ ফুট। তিনটি ধাপে এটি নির্মিত হয়েছে। প্রথমে বিশাল পোডিয়াম, দ্বিতীয় ধাপে নৌকার পালের মতো ছাদ, আর তৃতীয় ধাপে ভবনটির ভেতরের কাজ। সিডনির অপেরা হাউস নির্মাণের মূল খরচ ধরা হয়েছিল আনুমানিক ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু অবশেষে ৭ মিলিয়ন ছাড়িয়ে এর চূড়ান্ত খরচ ১০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।
ভবনটির নির্মাণের সময়কাল হিসাব অনুযায়ী চার বছর ধরা হয়েছিল। কিন্তু ভবনটির জটিল কাঠামোর কারণে নির্মাণ কাজ শেষ হতে নির্দিষ্ট সময়ের থেকেও বেশি লাগে। এই কারণে চার বছরের পরিবর্তে এটি শেষ হতে প্রায় ১৪ বছর সময় লেগেছিল। প্রায় ১০ হাজার নির্মাণ শ্রমিক দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমে এই অসাধ্য সাধন করে তোলেন।
অস্ট্রেলিয়ার রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২০ অক্টোবর ১৯৭৩ সালে অপেরা হাউসের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সেবার নাকি সিডনি অপেরা হাউসের নকশাকার জর্ন উটজনকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বিষয়টা জানার পর আমার মন খুবই খারাপ হয়ে গেল, মহাসমুদ্রের এক কোণায় উপত্যকার মতো এমন মনোরম নির্মাণ যিনি করেছেন তাকে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে।
আমরা অপেরার ভেতরে প্রবেশ করলাম না, বাইরে থেকে হেঁটে হেঁটে যা দেখছি তার সৌন্দর্য লিখে প্রকাশের নয়। রেলিং ধরে তাকিয়ে আছি হারবার ব্রিজের দিকে। গিনেজ বিশ্বরেকর্ড অনুযায়ী, বিশ্বের একক স্পানবিশিষ্ট সবচেয়ে প্রশস্ত সেতু হলো সিডনি হারবার ব্রিজ। প্রায় ১ হাজার ১৪৯ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটি নির্মাণ করতে সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় ১০ বছর। সেতুটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৩২ সালের ১৯ মার্চ খুলে দেওয়া হয়। সেতুটি নির্মাণে সে সময় খরচ হয়েছিল প্রায় ৬২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। কিছুটা কান্নাও মিশে আছে সেতুটি নির্মাণের সঙ্গে। কমপক্ষে ১৬ শ্রমিক প্রাণ হারান সেতুটি নির্মাণের সময়। প্রতিবছর একত্রিশে ডিসেম্বর রাতে লাখ লাখ দর্শনার্থী এই ব্রিজের কাছে সমবেত হয়। সারা রাত ধরে চলে কনসার্ট আর আতশবাজির খেলা। গেল রাতে এখানে এলেও মন্দ হতো না, তবে ভিড় অনেক।
দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি- ব্রিজের ওপারের নীল আকাশ, সাদা মেঘ, চমৎকার আধুনিক জাহাজ ভেসে বেড়াছে জলের বুকে, পর্যটকরা বিভিন্ন ভঙিমায় ছবি তুলছেন। পাশেই সবুজ বাগান, থৈ থৈ করা জলের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য একেবারেই বুদ হয়ে আছি আমি। ব্রিজের অপর দিয়ে হাঁটার সাহস হচ্ছে না। অবাক করা বিষয় হলো বাইরে থেকে অপেরা ঘুরতে অস্ট্রেলিয়া সরকার কোনো টিকিট নিচ্ছে না, তবে ভেতরে গেলে ভিন্ন কথা। সব দেশেই স্থাপত্যশিল্প দেখতে বিদেশিদের টিকিট কাটতে হয়, আমি যত দূর জানি। এমন বিস্ময়কর সৃষ্টি বিনা খরচে দেখতে পাচ্ছি এটা তো বাড়তি পাওনা।