পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
সেপ্টেম্বরে তিনদিন টানা ছুটি পাওয়ায় উত্তরবঙ্গের বেশকিছু জেলা একসাথে টার্গেট করি। সাথে ছিল স্নেহের ছোট ভাই আজিজ।
এবারের পরিকল্পনা ছিল এরকম-
দিন ১: কুষ্টিয়া-পাবনা-নাটোর-রাজশাহী
দিন ২: রাজশাহী-চাঁপাই-নওগাঁ-জয়পুরহাট
দিন ৩: জয়পুরহাট-বগুড়া-সিরাজগঞ্জ
আমার শুরু যেহেতু কুষ্টিয়া থেকে, আমার কাছে উপায় ছিল তিনটা ১. সাইকেল কুরিয়ার করে দেওয়া (তাতে কুরিয়ার অফিস খোলার জন্য সকাল ৯/১০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়)। ২. সাইকেল সাথে করে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া। ৩. অন্য কোনো মাধ্যমে আগেই সাইকেল কুষ্টিয়া পাঠানো। প্রিয় আনোয়ার ভাই জানালেন, তার বন্ধুর (ফরহাদ ভাই) শিলাইদহ ডেয়ারি কোম্পানির গাড়িতে আমি চাইলে পাঠাতে পারি। আমি চমৎকারভাবে আনোয়ার ভাইয়ের প্রস্তাব মেনে ওনাদের পিকআপে সাইকেল কুষ্টিয়া পাঠিয়ে দিই।
বুধবার রাতে হানিফের গাড়িতে রওনা হয়ে ভোররাতে কুষ্টিয়ার গড়াই সেতুর একটু আগে আমি আর আজিজ নেমে যাই আর শিলাইদহ ডেয়ারি খুঁজে বের করি। ফরহাদ ভাই তার পুরো টিমকে যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন, তারাও আমাদের সবদিক থেকে সহযোগিতা করেন, আপ্যায়ন করেন। ভোর ৫:৪৫ নাগাদ আমরা মহান আল্লাহর নামে শুরু করি আমাদের যাত্রা
দিন ১: কুষ্টিয়া-পাবনা-নাটোর-রাজশাহী
প্রথমে ভেবেছিলাম লালন আখড়া ঘুরে আসব, কিন্তু দুজনেরই ওখানে আগে যাওয়া থাকায় পরিকল্পনা বাদ দিয়ে কবিগুরুর শিলাইদহ ঘাটের উদ্দেশে প্যাডেল বাড়াই, পথে কবিগুরুর কুঠিবাড়িতে ছবি নিয়ে ঘাটে চলে যাই খেয়া পারে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ওপারে পাবনার উদ্দেশে। লালন সেতু সাইকেলে পার হতে পারলে অবশ্য আমাদের গতিপথ ভিন্ন হতো, কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে ওটা সাইকেলবান্ধব কোনো সেতু নয়, তাই ৪০+১০ টাকা ট্রলার ভাড়া দিয়ে পদ্মা পাড়ি দিই। ভেবেছিলাম ওপারেই বুঝি পাবনা, ভুল ওপারেও শিলাইদহ আর কুষ্টিয়া, তার থেকে কিছুটা এগিয়ে পাবনা। সনেট গ্রæপে আমার রুটের কথা শুনে বলল- আমান ভাই ঈশ্বরদী আমার বাড়ি আপনার পথেই পড়বে একটু চা খেয়ে যাবেন। আমি সানন্দে ওর চায়ের নেমন্তন্ন গ্রহণ করে বিস্মিত। টেবিল ভর্তি নানান আয়োজন, আমি যতই না না করি বেচারা তত উৎসাহী হয়ে তুলে দেয়। খালাম্মা আর ভাবির প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা, মহান আল্লাহ তাদের এ আতিথেয়তার পূর্ণ প্রতিদান দিন। ঈশ্বরদী আমাদের দক্ষিণবঙ্গের সাধারণ জেলাগুলোর তুলনায় অনেক অগ্রগামী মনে হলো। যাহোক, এরপর আমাদের রুপ্পুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখে রাজশাহী যাবার কথা। কিন্তু আজিজ এখানকার অনেক খুঁটিনাটি আগে থেকে জানে বলে পাকশি মানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সূচনামুখেও গেলাম। এরপর শুরু হলো আমাদের সংগ্রাম। মহাসড়ক হিসেবে ঈশ্বরদী-লালপুর-বাঘা-রাজশাহী সাইক্লিস্টের জন্য অসাধারণ। দুপাশে আম আর লিচুর বাগান আপনাকে কখনোই ক্লান্ত করবে না সাথে রাস্তার স্মুথনেস। কিন্তু দ্বিপ্রহরে যখন আমরা তীব্র তাপদাহের মধ্য দিয়ে রাজশাহী পাড়ি দিচ্ছি তখন বুঝেছি ঢাকার গরম আর রাজশাহীর গরমের পার্থক্য। অপেক্ষাকৃত নবীন মহাসড়ক হওয়ায় দুপাশে বড় গাছের অভাব খুব অনুভব করেছি। এন্সিয়েন্ট মেরিনার গল্পের মতো অবস্থা চারদিকে শুধু পানি আর পানি কিন্তু পান করার জন্য নেই এক ফোঁটাও, আর এখানে চারদিকে শুধু ছায়া আর ছায়া কিন্তু রাস্তার ওপর নেই তার ছিটেফোঁটাও। আমরা সময় থাকায় পুটিয়া রাজবাড়ী দেখে আসায় আমাদের ১৪৬ কিলোর মতো চালানো হয় এদিন।
দিন ২: রাজশাহী-চাঁপাই-নওগাঁ-জয়পুরহাট
প্ল্যানে যদি চাঁপাই না থাকতো তাহলে আমরা যেতাম কুসুম্বা মসজিদ দেখে ঘুঘুডাঙ্গা, কিন্তু ওই যে শুরুতেই বলে রেখেছি প্যাডেলস্টেপ রাখতে চাই প্রতি জেলায় তাই চাঁপাই বাদ দেবার সুযোগ ছিল না। চাঁপাই থেকে নাচোল হয়ে ঘুঘুডাঙ্গা যাবার পথে ৫০+ কিলোমিটার রাস্তা বড় পাথরের যাতে দুর্ঘটনা কম হয়, কিন্তু আমাদের এটা বিশাল কষ্টের কারণ হয়েছে। আপনারা যারা যাবেন তারা এই পথ বিবেচনায় নেবার আগে তিনবার ভাববেন। গুগল যে সবসময় সঠিক নির্দেশনা দেয় না তা এখানেও বুঝলাম। তার নির্দেশনা ছিল বড়দাইদপুর হয়ে কিন্তু এলাকাবাসী বললেন দীঘিবাজার হয়ে যান, আমরাও তা গেলাম, কারণ আমরা ওই পাথুরে নিরাপদ রাস্তা আর নিতে পারছিলাম না।
ঘুঘুডাঙ্গা দেখার শখ দীর্ঘদিনের, তা পরিপূর্ণভাবেই মিটলো, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আপনার সব আশা একবারে মিটে গেলে আর তো যাওয়া হবে না, তাই পাহাড়পুর আর শালবন বিহার সন্ধ্যা নেমে আসায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরে আমরা রাত্রিবাস করি জয়পুরহাট সার্কিট হাউসে। এদিন অতিক্রম করি ১৮০ কিলোমিটার।
দিন ৩: জয়পুরহাট-বগুড়া-সিরাজগঞ্জ
জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসকের সুরুচির প্রশংসা না করে পারছি না। সার্কিট হাউসের বাইরের ওয়ালে জয়পুরহাটের কী কী দর্শনীয় স্থান আছে তার চমৎকার সব ছবি দিয়ে রেখেছেন। ওখানকার কেয়ারটেকার ভাইকে আমাদের পরদিন সকালের গন্তব্য বলে জিজ্ঞেস করলাম পথে দর্শনীয় কোন কোন স্থান পড়বে। কিন্তু পথ বাড়বে না। উনি বললেন- হিন্দা শাহি মসজিদ। আমরা সেখানে গেলাম। পরে ফুলদীঘি বাজারে চা খেয়ে আগাবো- এমন সময় পুরো আকাশ কালো করে মেঘ। আমরা পা না বাড়িয়ে ওখানেই সকালের নাস্তা করে সময় বাঁচানর সিদ্ধান্ত নিই। প্রায় দেড়ঘণ্টা বৃষ্টি তখন নাস্তার দোকানের এক ভাই পাশের স্যান্ডেলের দোকানের মালিককে তার বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন, তার দোকান খোলানোর ব্যবস্থা করেন আর আমি একটা স্যান্ডেল কিনে হালকা বৃষ্টির মধ্যে রওনা দেবার সিদ্ধান্ত নিই। বগুড়া এসে আজিজ বলে যে, রাস্তার যে অবস্থা তাতে মহাসড়ক বাদ দিয়ে চলেন শেরপুর থেকে যেটা সিরাজগঞ্জ গেছে ওটা ধরি। এই রাস্তাটাও চমৎকার কোলাহলমুক্ত। আমি আগেই শাকিল ভাইয়ের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জে সাইকেলের বক্স কার্টন কুরিয়ার করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার প্যাডেল খোলার জন্য ৮ মিমি এল কি সাথে আনি নাই, হার্ডওয়ারের অনেকগুলো দোকানে খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। মহান আল্লাহ সব সময়ই সাহায্যের জন্য কাউকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এবারের রাইডে সিরাজগঞ্জেও কোনো ব্যতিক্রম নাই। রানার রায়হান ভাই আর সিরাজগঞ্জ সাইক্লিস্টের তারেক সুন্দরবন কুরিয়ারের সামনে উপস্থিত, তারা আগে থেকেই আজিজের পরিচিত। আমি তারেককে সাথে নিয়ে ওদের পরিচিত মেকারের কাছে যেয়ে প্যাডেল খোলাই আর নরমাল একটা দূরন্ত প্যাডেল কিনে সেটা লাগাই পরে পথে ১৪-১৫ ডালি কিনে সাথে রাখি। আজিজ আবার আমার সাথে ফিরবে না, ও ফিরবে মির্জাপুর হয়ে। এবার সুন্দরবন কুরিয়ারের সামনে ওদের বলি সাইকেল বক্সের আমি ওস্তাদ আপনারা যেতে পারেন কোনো সমস্যা নেই। হা হা হা, ওরা চলে যাবার পর দেখি যে সামনের চাকার কুইক রিলিজ ঘোরে কিন্তু খোলে না। আমি টেনশনে ঘামতে ঘামতে অস্থির। পরে মোটরসাইকেলের দোকানে সাইকেল নিয়ে এক গতি করি কুইক রিলিজের। পরে সাইকেল বক্স করে র্যাবের গাড়িতে র্যাব-১২ কমান্ডিং অফিসার মারুফ ভাইয়ের আতিথ্য নিয়ে দেশ ট্রাভেলসের গাড়িতে ঢাকা ফেরা।আক্ষেপ:
১. কুসুম্বা মসজিদ
২. সোনা মসজিদ
৩. পাহাড়পুর
৪. মহাস্থানগড়
অসাধারণ স্মৃতিময় এক রাইড আমার জন্য। তিনদিনে ৪৫০ কিলোর পাশাপাশি সেপ্টেম্বরে আলহামদুলিল্লাহ ১৬০০ কিলোমিটার চালানোর এক দুর্দান্ত মাইলফলক স্পর্শ করলাম। সাথে ৬৪ জেলার ৫৯ জেলায় সাইকেলের প্যাডেল পড়ল, আলহামদুলিল্লাহ।
আমানুর রহমান