লেখক : হাসান আদিল (সাংবাদিক)
নাজিরাবাজার থেকে হেঁটে আসার ফলে তারা কোনোক্রমে লঞ্চ ঘাট ত্যাগের কিছু আগে সদরঘাট এসে পৌঁছাতে পেরেছেন। অর্থাৎ আমাদের নিঝুম দ্বীপ অভিযান হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ লঞ্চে থাকতে হবে সেটি আমরা জানতাম । সেজন্য পাউরুটি, কলা, বিস্কিট, চানাচুর ও পানি সঙ্গে নিয়ে নিলাম। এরপর যখন লঞ্চে উঠলাম তখন ভিড় দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। কোথাও বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে আমরা ছাদে চলে গেলাম । সেখানে গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। আমরা যাওয়ার আগেই তাবু টানিয়ে ইতোমধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ বানিয়ে রেখেছেন বেশ কয়েকজন । তারা রেলিংয়ে টানিয়েছেন হ্যামক । এক কথায় ছাদ দখল! আমরা এক পাশে বেডশিট বিছিয়ে নিলাম । কাঁথাও নিয়েছি সঙ্গে। রাতে লাগবে ভেবে । এরমধ্যে লঞ্চের হুইসেল বেজে উঠল, ধীরে ধীরে তা ছুটতে শুরু করল গন্তব্যের দিকে। ঘড়িতে বাজে তখন ছয়টা ১৫ বা ২০ মিনিট । লঞ্চের ছাদে বসেই শুক্রবার ও শনিবার প্রথমে নিঝুম দ্বীপ পরে মনপুরা ঘুরে ঢাকা ফেরার পরিকল্পনা করলাম ।
বেশ কয়েকটি ঘাটে থামল লঞ্চ। মালামাল ও মানুষ নামাল । সূর্য পুবাকাশে উঁকি দিল মনপুরা পৌঁছানোর পর। এক পাশে মনপুরা দ্বীপ অন্যপাশে মেঘনা নদী আর মাঝ বরাবর তার মোহনীয় রূপে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে সবাই । কেউ এ সময়কে ফ্রেমে বন্দি করতে ব্যস্ত আবার কেউ উপভোগ করেন মুহূর্ত প্রাণ খুলে । কী অপরূপ! কিন্তু একটু পরই ছন্দপতন। হাতিয়ার তমরদ্দি ঘাটে পৌঁছানোর কিছু আগে আমাদের লঞ্চ আটকে গেল ডুবোচরে। সামনে এগোনোর কোনো সুযোগ নেই ফের জোয়ার না আসার আগ পর্যন্ত । এদিকে আমাদের অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো বেশ কিছু ছোট বড় ট্রলার, তর সইছিল না । ফলে মাঝারি সাইজের একটি ট্রলারে আমরা উঠলাম । হাতিয়ার তমরদ্দি ঘাটে এসে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় সকাল ৯টা বেজে গেছে।
ঘাটের পাশেই রয়েছে বাজার । একটু ভেতরে গিয়ে রেস্তোরাঁয় নাস্তা সেরে আবার ট্রলারে চেপে বসলাম। এটি মালবাহী । তাই বড় বড় বাঁশ থেকে শুরু করে এমন কোনো জিনিস বাকি নেই যা নেওয়া হয়নি । সে ট্রলার ছাড়তে ছাড়তে বাজল প্রায় সাড়ে ১০টা। ট্রলার ছাড়তেই একটি বড় ঢেউ আছড়ে পড়ল । দোল খেলো পুরো ট্রলার । আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল উত্তেজনা। যদিও মাঝি মুহূর্তেই সামলে নিলেন । ট্রলার ভাসালেন মাঝ নদীতে। এখান থেকে যে দিকেই চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। মাঝেমধ্যে চরের দেখা মিলছিল । যেখানে রয়েছে মহিষের আনাগোনা ।
এভাবে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে মেঘনার বুক চিরে আমরা পৌঁছে যাই নিঝুম দ্বীপ খেয়াঘাটে । তখন প্রায় ১টা বেজে গেছে। এখান থেকে এবার যেতে হবে নামার বাজার । যেখানে মূলত পর্যটকদের থাকার ও খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা বাইকে আর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চেপে বাজারে চলে গেলাম । রিসোর্ট বুকিং দিয়ে বের হলাম দুপুরের খাবারের সন্ধানে। বাজারে বেশ কয়েকটি ভালো মানের খাবারের দোকান রয়েছে। সেখানে নানা ধরনের ভর্তা, সবজি, ইলিশ, কোরাল, নদীর তাজা মাছ, দেশি মুরগি ও হাঁসের মাংস পাওয়া যায়।
আমরা সব ধরনের ভর্তা ও তাজা মাছ দিয়ে খাবার শেষ করে চলে গেলাম নামার বাজার সমুদ্র সৈকতে। ভাটা হওয়ার কারণে সৈকতের আয়তন বেড়ে হয়েছে কয়েকগুণ। পানি অনেক দূরে চলে গেছে। ভাবলাম এক দৌড়ে পৌঁছে যাই পানির কাছে। কিন্তু কাদাপথ মাড়িয়ে কীভাবে যাব? পা দিতেই দেবে যায়। তবু অর্ধেকটা পথ একা গেলাম । নিস্তেজ সূর্যের রক্তিম আভা পানিতে পড়ে ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আমি বিমোহিত দর্শক যেন আটকে গেছি কাদামাটিতে। সামনে এগোতে পারছিলাম না ভয়ে আবার পেছনেও ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। যেই ফিরতে যাব তখন হঠাৎ একজন বলে উঠল, ভাই চলে যাচ্ছেন? আপনাকে দেখেই তো এলাম! আমি কেঁপে উঠলাম। দিনে আবার ভূতে পেল না তো আমাকে! পরে ওনার অনুরোধে পানির কাছে গেলাম। ওনার সঙ্গে আরও দুই জন এলো । মোট হলাম চারজন । বিস্তৃত এলাকাজুড়ে আমরা এ চারজন । মাঝেমধ্যে কিছু পাখি আমাদের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। মৃদুমন্দ ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমাদের পায়ে । পশ্চিমাকাশে সূর্য ডুবি ডুবি করছে। কী এক নৈসর্গিক দৃশ্য। এ দৃশ্য দেখার জন্যই মানুষ দূর দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন। আর আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে তা দেখা যাচ্ছে আরও আকর্ষণীয়ভাবে। এমন দৃশ্য ফেলে ফেরার কথা ভাবার মতো বেরসিক কি কেউ আছে? মনে হয় না। কিন্তু না ফিরে উপায় নেই! সন্ধ্যা নেমে গেছে।
সৈকতটা অতিমাত্রায় নিরিবিলি। একাকীত্ব উপভোগ করার সব রসদই এখানে মজুদ আছে। একপাশে খেজুর বাগান অন্যপাশটা খালি । যদিও খেজুর বাগানে এক দুইটার বেশি গাছ দেখিনি। সন্ধ্যা নামতেই আমরা রুমে এলাম । ফ্রেশ হয়ে বেডশটি নিয়ে গেলাম সৈকতে চাঁদনি রাত উপভোগ করার জন্য । আমরা যেহেতু তাঁবুর ব্যবস্থা করিনি সেক্ষেত্রে বেডশিট বিছিয়ে সৈকতে সময় পার করার চিন্তা করলাম । অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আরকি । একটা সময় চাঁদের আলোয় পুরো সৈকত এমনভাবে আলোকিত হয়ে যায় যে, আমরা একে অপরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। মধ্যরাত পর্যন্ত আমরা সমুদ্রের গর্জন, পাখির কলতান শুনলাম এবং মাঝেমধ্যে বেসুরো গলায় গাইলাম গান । এভাবে ঘড়ির কাটায় কখন তিনটা বেজে গেল বুঝতেই পারলাম না। সৈকতের ঘোর যদি আমরা কাটাতে না পারি তাহলে সকালে আমাদের হরিণ দেখার কী হবে! তাই দ্রুত ফিরে এলাম রিসোর্টে। ঘুমিয়ে পড়লাম সকাল ৫টায় এলার্ম দিয়ে।
সকাল সাড়ে ৫টার দিকে আমরা ৫ জন প্ৰস্তুত হলাম। আমাদের লক্ষ্য নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যানের ভেতরে যাব এবং যেভাবেই হোক হরিণ দেখবই । বেশ উদ্যম নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। আলো ভালোভাবে ফোটেনি এখনও । শীত শীত অনুভূতি । শুরুতেই দেখা পেলাম একটা হরিণের। ঘাস খাচ্ছিল হেলেদুলে। আমাদের দেখে নড়ার কোনো প্রয়োজন অনুভব পর্যন্ত করল না । শিহরণ জাগল মনে । ভাবতে লাগলাম সামনে হয়তো এভাবেই খালের পাড়ে, মেঠোপথে আমরা হরিণের পাল দেখতে পাব। পরে জানলাম এটি এখানেই থাকে, পালিত এরপর আমরা উদ্যানের পথ ধরে এগিয়ে গেলাম।
পর পর দুটি খালে দুটি গাছের সাঁকো পার হয়ে ঢুকে পড়লাম কেওড়া বনে হরিণ দেখার আশায় । এখানে কেওড়া গাছের পাশাপাশি নানা ধরনের বৃক্ষের সমাহার। এরমধ্যে একটার পুরো শরীর কাঁটাযুক্ত। একদিকে কাদামাটি, তার ওপর কেওড়ার শ্বাসমূল মাথা বের করে রেখেছে। ভোরের পাখির ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এরমধ্যে কাঁটাযুক্ত গাছটি আমাদের হাঁটার গতি একেবারে কমিয়ে দিয়েছে। যার কারণে কিছুদূর যেতেই আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। যদিও হাঁটা থামালাম না। ঘন বন, গা ছমছম করা পরিবেশ এবং হরিণ দেখার প্রবল আগ্রহ আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হাতে সময় যে অল্প! একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমরা হরিণ না দেখেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। রিসোর্টে ফেরার পথে দেখলাম জেলেরা মাছ ধরে ফিরেছেন সাগর থেকে। বক্স ভর্তি সব বড় বড় ইলিশ, দামও বেশ চড়া। পথে মিলল একটা ঝুঁকিপূর্ণ ওয়াচ টাওয়ার। সেখান থেকে দ্বীপ এক নজর দেখে আমরা দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম ফেরার জন্য। গন্তব্য হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাট । কারণ আমরা ফিরব বাসে। মাঝে মনপুরা বাদ পড়ে গেল সময়ের অভাবে । রিসোর্টের পাশে ছোট একটি খাল। সেখান থেকেই ছাড়বে ট্রলার । এ খাল গিয়ে মিশেছে মেঘনায়। ঝটপট তৈরি হয়ে ট্রলারে উঠলাম। এ ট্রলারও মালবাহী, তবে আগেরটার চেয়ে বড়। আমাদের নিয়ে ট্রলার রওনা হলো সাড়ে দশটার দিকে। ডানে কেওড়া বন আর বামে জনপদ ফেলে আমরা ছুটছি বিশাল মেঘনার দিকে। কিছুটা পথ এগোতেই নিঝুম দ্বীপ ঝাপসা হয়ে এলো, আমরা এলাম মেঘনার বুকে । যেদিকে চোখ যায় উত্তাল ঢেউ। এমন ঢেউ যে, যা যে কারও বুকে কাঁপন ধরাতে যথেষ্ট। এ ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে আমরা পৌঁছালাম তমরদ্দি ঘাটে ১২টা ৪০ মিনিটে। সেখানে ছোট একটি বিরতির পর আমরা ছুটলাম চেয়ারম্যান ঘাটের উদ্দেশ্যে । এ পথে মেঘনা আরও বিশাল, আরও মায়াবী- এক কথায় ভয়ংকর সুন্দর । তার সৌন্দর্যের স্তুতি গাইতে গাইতেই বিকেল তিনটার দিকে আমরা চেয়ারম্যান ঘাটে নামলাম। নিঝুম দ্বীপ, কেওড়া বন, নিসঃঙ্গ সৈকত, খেজুর বাগান বা মেঘনা- সবই এখন অতীত। স্মৃতির ডায়েরিতে জমা পড়ে গেল তাদের মায়াবী রূপ। অবিস্মরণীয় সব মুহূর্ত এবং গা ছমছমে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা নগরে ফিরলাম মধ্যরাতে।
যাওয়ার উপায় ও খরচ
সদরঘাট থেকে লঞ্চে তমরদ্দি ঘাটের ভাড়া ৫০০ টাকা। সেখান থেকে ট্রলারে নিঝুম দ্বীপ ২০০ টাকা । সেখান থেকে ৭০ টাকা জনপ্রতি বাইকে নামার বাজার । এটি সবচেয়ে সহজ রুট। আপনি যদি দ্রুত যেতে চানা হাতিয়া থেকে তাহলে লঞ্চ থেকে নেমে সিএনজি বা বাইকে মোক্তারিয়া ঘাটে যেতে হবে। ভাড়া সেক্ষেত্রে ১৫০ বা ২০০ এর বেশি হবে না জনপ্রতি। এরপর নদী পার হয়ে নিঝুম দ্বীপ ঘাট । সেখান থেকে বাইক বা সিএনজিতে নামার বাজার। যদি ঢাকা থেকে বাসে চেয়ারম্যান ঘাট হয়ে যেতে চান সেক্ষেত্রে বাস ভাড়া ৫০০ টাকা । চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ট্রলার ভাড়া নামার বাজার পর্যন্ত ৪০০- ৫০০ টাকা। ফেরার সময় নামার বাজার ঘাট বা নিঝুম দ্বীপ ঘাট হয়ে ফিরতে পারবেন তমরদ্দি ঘাট বা চেয়ারম্যান ঘাটে অথবা মোক্তারিয়া ঘাট হয়েও হাতিয়া আসা যাবে। ঢাকার উদ্দেশে হাতিয়া থেকে ১২.৩০ মিনিটে একটি লঞ্চ ছেড়ে আসে ৷
থাকার ব্যবস্থা ও খাবার
নামার বাজারেই বেশ কিছু আবাসিক হোটেল আছে। এগুলোর ভাড়া ১ থেকে ২ হাজারের মধ্যে ৷ বাজারে বেশ কিছু ভালো মানের হোটেলও রয়েছে যেখানে আপনি নদীর মাছ দিয়ে কম খরচে খাবার সেরে নিতে পারবে।