পাহাড়ের মধ্যে সাজানো সারি সারি ধুপীগাছ। শীতের প্রকোপ কিছুটা কমলেই ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চ থেকে চারপাশ রাঙিয়ে ফুটতে থাকে নানা রকমের রডোডেনড্রন।
সিম্বা রডোডেনড্রন অভয়ারণ্য উত্তর সিকিমে। প্রত্যেক গ্রীষ্ম ও বসন্তে অভয়ারণ্যে রডোডেনড্রন ফোটে। চারপাশে তখন রঙের ছড়াছড়ি। পর্যটন মানচিত্রে লাচুং ও ইয়াঙথাম ‘ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার’ হিসেবেও খ্যাত। সিকিমের রডোডেনড্রন বিশ্ববিখ্যাত যা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে ‘গুরাস’। বিশ্বের রডোডেনড্রন মানচিত্রে সিকিম অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে আর এশিয়া মহাদেশে প্রথম।
একমাত্র সিকিমেই রয়েছে শুধুমাত্র আলাদা রডোডেনড্রন অভয়ারণ্য। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পাওয়া আটত্রিশ প্রজাতির রডোডেনড্রনের মধ্যে উনিশটি রয়েছে সিকিমে। মার্চ থেকে মে মাস অবধি সিকিমে রডোডেনড্রনের মরশুম। আন্তর্জাতিক রডোডেনড্রন ফেস্টিভাল উদযাপিত হয় সিকিমে। পর্যটন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়।
লাচুং শব্দের অর্থ ‘গমনোপযোগী ছোট পর্বত অঞ্চল’। এক সময় তিব্বতের অংশ ছিল লাচুং। একই সাথে বিখ্যাত প্রাচীন মনাস্ট্রি যেখানে লামা বসবাস করে। ১৯৫০ সালে অধিকৃত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিব্বত ও সিকিমের বাণিজ্য পরিচালনার কেন্দ্র ছিল লাচুং। পরবর্তী তা বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি ভারত সরকার লাচুং টুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ায় এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। এই অঞ্চলের প্রতিটি পর্বতচূড়া বরফে ঢাকা থাকে সব সময়। শীতকালে পুরো শহরটাই বরফে ঢেকে যায়। ব্রিটিশ পর্যটক জোসেফ ডালটন হুকার লাচুং সম্পর্কে তার বিখ্যাত দি হিমালয়ান জার্নালে লিখেছিলেন, “Most picturesque village of Sikkim”। ছবির মতো সৌন্দর্যে ঘেরা এই গ্রামটি। গ্যাংটক থেকে পুরো পথেই পাহাড়ি নদীকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায়। কখনো শান্ত, কখনো ভয়ঙ্কর, স্বচ্ছ-নীল পানির পাথুরে নদীটিকে ভুলে যাওয়া
ফুদং, রঙরাঙ, মানগান পেরিয়ে আমরা তখন চারদিক থেকে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা চুংথাং শহরে। মানগান থেকে অনেক বেশি ঠান্ডা। অনেক বেলা পর্যন্ত এখানে খুব ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। সূর্যের আলো ওপর থেকে পড়ে। তখন এই অলস থমকে থাকা ঠান্ডা, কুয়াশা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। উত্তর সিকিমের দুটো উপত্যকা ও দুটো নদীর সংযোগস্থলে চুংথাং। লেচাংচু নদী ও লাচেনচু নদী মিলে এর নাম হয় তিস্তা।
দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে চীন বর্ডারের কাছে লাচুংয়ে পৌঁছাই দিনের আলো নিভে যাওয়ার কিছু আগে- অপরাহ্নে। পৃথিবীর সমস্ত সবুজ রং বুঝি এখানে এসে জড়ো হয়েছে। দেখে মনে হয়, কেউ যেন আপন খেয়ালে ক্যানভাসে এঁকে দিয়ে গেছে এই সবুজ চাদরে ঢাকা উপত্যকাটি। চারদিকে সবুজ কর্নিফার ঘেরা পাহাড়। মাঝে মধ্যে ছোট-ছোট কাঠের বাড়ি এদিক ওদিক ছড়ানো। বহু দূরে অনেক উঁচুতে সাদা তুষারে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া। দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে গায়ে। চিকচিক করে উঠছে। শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ের কোলে কোলে।
সুউচ্চ পাহাড়ে অবস্থিত লাচুংয়ের মাঝ দিয়ে প্রবহমান বরফ গলা নদী। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে দূরন্ত বেগে ধেয়ে চলে অপরূপ – লাচেন আর লাচুং নদী। লাচুংয়ে ফ্রোজেন ভ্যালি নামে একটি রিসোর্টে আমরা ছিলাম। নামটি যথার্থই। ফ্রোজেন ভ্যালি হোটেলটি পাহাড় কেটে তৈরি করা। রুম থেকে বেরিয়ে বেলকনির সামনে আসতেই দেখা হয়ে যায় মেঘ আর তুষার মোড়ানো নাম না জানা পাহাড়ের সাথে। কী অপরূপ দৃশ্য! রাতেই এক পষলা বৃষ্টি হয়। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট, পাহাড় চূড়ায় শুভ্র তুষার মেঘের দল। অজ¯্র তারার মেলা আকাশে। চারপাশে বরফে ঢাকা পাহাড় চাঁদের রূপালী আলোতে যেন অপার্থিব রুপে সামনে দাঁড়ায়। সূর্যের আলোতে ঝকঝকে বরফ দেখি বিভিন্ন শৈল শহর থেকে। নীলচে রূপালী আলোতে সাদা বরফ ঢাকা হিমালয় পর্বতমালার মোহনীয় অপরূপ রূপ যেন প্রথম প্রেমের মতোই রূপকথার কোনো দৃশ্য।

ফ্রোজেন ভ্যালিতে রুম হিটার জে¦লে কোনো রকম রাত কাটিয়ে সকালে নাস্তা সেরেই জিপ নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য এবার ইয়ামথাং ভ্যালি হয়ে জিরোপয়েন্টের উদ্দেশে। কুয়াশার কারণে যাত্রা কিছুটা বিলম্ব হয়। দুই পাশের সবুজের উপরে সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়, নাম-না জানা ঝরনা আর হিমবাহ পেরিয়ে সকাল ১০টার আগেই পৌঁছে যাই সিম্বা রডোডেনড্রন অভয়ারণ্যে। পথে বন্য ঘোড়া আর চমরিগাই। চলতে চলতে পর্বতের রং পাল্টে যাচ্ছে। পাইন, ধুপী ও নাম না জানা ফুলের বিচিত্রতায় চারপাশ কল্পলোকের বলেই ভুল হয়। সারিবদ্ধভাবে সাজানো হিমালয় পর্বতমালা ঘেরা ইয়ুমথং উপত্যকা। যেখানে গাছের সারি শেষ আর হিমালয়ের হাইল্যান্ড শুরু। উপত্যকাজুড়ে বন্য হলুদ এবং বেগুনি প্রিমুলাস, বিভিন্ন রডোডেনড্রন। সাদা বরফের কারণে রাস্তা ঢেকে আছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বড় একটি বেস ক্যাম্প রয়েছে এখানে। প্রচÐ তুষারপাতের কারণে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ইয়ুমথাং টুরিস্টদের জন্য বন্ধ থাকে। উপত্যকাজুড়ে হিমালয়ের তীব্র ঠাÐা বাতাস। জমে যাওয়ার অবস্থা। সিম্বা অভয়ারণ্যের প্রবেশ পথে গাড়ি রেখে ভেতরে বরফের রাজ্যে হারিয়ে যাই। পা ঢেকে দিই রাবারের গামবুটে। বাচ্চাদের আনন্দ ছিল সীমাহীন। যেন স্বপ্নরাজ্যে চলে এসেছে। ধবধবে সাদা রবফের বল ছুঁড়ে দিচ্ছে একজন আরেকজনের গায়ে। হঠাৎই খেলতে খেলতে লাল জ্যাকেট গায়ে সাদা বরফের ওপর শুয়ে থেকে তারা নীল আকাশ দেখে বিমুগ্ধ নয়নে।
দুপুরের পরই আমরা লাচুং থেকে রওনা হই গ্যাংটকের উদ্দেেেশ। চড়াই-উতরাই ভেঙে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। পথের দুধারে যে কত ধরনের রঙিন পাহাড়ি ফুল তা গুনে শেষ করা যায় না। গোলাপি রঙের রোডোডেন্ড্রন সমস্ত পথে ফুটে ছিল আমাদের সঙ্গী হয়ে। নাম ‘এজিলিয়াস’। একটা তীব্র গন্ধ। গুচ্ছ-গুচ্ছ ছেয়ে রেখেছে গাছগুলোতে। ফ্রোজেন ভ্যালিতে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে দেখি লাচুং গ্রামটাকে। দুচোখ ভরে দেখে নিই চারপাশের নিসর্গ।
এখন একপাশে উঁচু খাড়া পাহাড়। নীচে সাদা পাথুরে খাদ। আর খাদের ওপাশে সাদা বরফের পাহাড়। অনেক অনেক ওপর থেকে দেখা বয়ে আসা নদী যেন সরু থেকে আরও সরু দেখায়। হঠাৎ মনে হলো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেন অন্য আরেক পৃথিবীতে এসে পড়েছি। হাওয়ার শব্দটুকু ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সমস্ত লোকচক্ষুর আড়ালে প্রকৃতি যে এত উদারভাবে এত সৌন্দর্য ছড়িয়ে রাখতে পারে; তা সত্যি অবিশ্বাস্য!

প্রকৃতির সবটুকু বিশালত্ব নিয়ে পাহাড়গুলো আকাশ ছুঁয়ে আছে। এত বিশালত্বের প্রাচুর্যেও তার নেই কোনো অহংকার, অস্তিত্ব জানান দেয়ার গর্জন। অসম্ভব নীরবতায় পাহাড় আমাদের শেখায় ধৈর্য, শান্তি আর ভালোবাসার স্বপ্ন; যা আকাশকে স্পর্শ করতে চাইবে কিন্তু শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের অহেতুক আয়োজনে বিভোর হবে না।
নদীর অপর পাড়ে সুউচ্চ পাহাড় থেকে বড় বড় গাছের সারি নেমে যায় নদীর পাদদেশে। এ দৃশ্য আসলে অন্য রকম। সেখানে এক ঘণ্টার মতো যাত্রাবিরতি শেষে আমরা ছয় ঘণ্টার মতো ভ্রমণ করে রাতে গ্যাংটক পৌঁছাই। লাচুং থেকে ফিরে আসি কিন্তু সঙ্গে বহন করি রোমাঞ্চকর অনুভূতি- সিম্বা রডোডেনড্রন অভয়ারণ্যজুড়ে রঙের মেলা। গ্যাংকট ফিরতে ফিরতে নিজেকে নিজেই বলি- কমপক্ষে আরও একবার আসতে হবে রডোডেনড্রন আর জিপসি ফোটার মরসুমে ‘ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার’- এ।
লেখক: মার্জিয়া লিপি
Thank you for the awesome content, it’s always appreciated