পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
পাবনা-ভাঙ্গুড়া মহাসড়কে চাটমোহর শহরের ভাদুরহাট মোড় থেকে ১ কিলোমিটার দূরে সুলতানী মোঘল আমলের নিদর্শন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্যের ৪৩৯ বছরের মসজিদটি। চাটমোহরের তিন গম্বুজ শাহী মসজিদের শিলালিপিতে এর নির্মাতা ও নির্মাণকাল সম্বন্ধে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। ওই শিলাফলকের ফার্সি লিপি থেকে জানা যায়, বিশাল এই মসজিদ, বিখ্যাত সুলতান সৈয়দ বংশীয় প্রধান সৈয়দ আবুল ফতে মুহাম্মদ মাসুম খাঁনের সময় নির্মিত হয়।
কাকশাল গোত্রের সন্তান খান মুহাম্মদ তুকি খান ৯৮৯ হিজরি অর্থাৎ ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন। শিলালিপি পাঠ, অনুযায়ী অনুমান করা যায়, মাসুম খাঁন নিজেকে সুলতানরূপে ঘোষণা করেন। তিনি নিজে এই উপাধি গ্রহণ করেন। কিছুকালের জন্য পাবনা অঞ্চলে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন এবং চাটমোহরে রাজধানী স্থাপন করেন। এছাড়া ক্ষুদ্র আকৃতির যে শিলালিপি মসজিদের সামনে অবস্থিত ইঁদারার ভেতরের দেয়ালে স্থাপন করা ছিল, যা বর্তমানে মসজিদের প্রধান প্রবেশ খিলানে রাখা রয়েছে। মূল শিলালিপিটি রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
মসজিদটিতে তিনটি দরজা বিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথের তিনটি দরজার মধ্যে প্রধান প্রবেশপথে উঁচু দরজার ওপরে কালো পাথরের মাঝে খোদায় করা ‘কালেমা শাহাদাৎ’ লেখা রয়েছে। মূল প্রবেশ পথটি ছাড়া অন্য প্রবেশপথ দুটি একই ধরনের। মসজিদটিতে তিনটি প্রবেশপথের সঙ্গে মিল রেখে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে মোট তিনটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাব থেকে দুই পাশের মিহরাবে রয়েছে বড় সুরঙ্গের মতো অপূর্ব নিদর্শন। ভূমি-নকশালঙ্কারে স্থাপত্য। অনুমান করা যায়, সুলতানী-মুঘল স্থাপত্যের রীতিতে মসজিদটি নির্মিত।
মসজিদের দেয়াল প্রায় ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি চওড়া। মিম্বারের পাশে কষ্টি পাথরের মত কালো রংঙের পাথরটি সৌন্দর্যের আরেকটি অংশ। মসজিদের বাইরে জাফরান রংঙের ‘জাফরী ইট’ ব্যবহৃত হয়েছে। ইটগুলো চিকন এবং লম্বাটে। বর্তমানের মোটা ইটের মত না। দূর থেকে মসজিদটি বিশাল মনে হলেও ভেতরে মাত্র দুই কাতার লোক নামাজে দাঁড়াতে পারে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় হয় এই মসজিদে এছাড়া মসজিদের বাইরে দুটি ঈদের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
ইতিহাসে জানা যায়, মাসুম খাঁন ছিলেন সম্রাট আকবরের অনুজ মির্জা মুহম্মদ হাকিমের দুধ ভাই। মাসুম খাঁ ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের কাকশাল গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। সম্রাট আকবর বাংলা ও বিহারে বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হলেও মাসুম খাঁন কোনোদিনই আকবরের আনুগত্য স্বীকার করেননি। পরে তিনি চাটমোহরে কিছু সময়ের জন্য একটি রাজ্য গড়ে তোলেন।
সম্রাট আকবর তার শাসনামলে দ্বীন-ই-ইলাহি নামে নতুন ধর্ম ঘোষণা করলে কাকশাল গোত্র এবং বাংলার মুসলমান ভুঁইয়ারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ২০ বছর বয়সী যুবক মাসুম খাঁন ‘কালা পাহাড়’ নামে সেনাপতিকে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বীকৃতি স্বরূপ পাঁচ হাজার সৈন্যের সেনাপতি পদে দায়িত্ব পান। ১৫৭৯ সালে মাসুম খাঁন বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বার ভূঁইয়াদের সঙ্গে যোগ দেন।
তিনি বারো ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁনের সঙ্গে যোগ দিয়ে আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১০০৭ হিজরি অথাৎ ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ৪৪ বছর বয়সে সম্রাটের ফৌজি বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন মাসুম খাঁন। সম্রাট আকবরের অধীনতা অস্বীকার করে চাটমোহরে স্বাধীন ক্ষমতা পরিচালনার সময় ৯৮৯ হিজরি অর্থাৎ ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে শাহী মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে কেউ মসজিদটি দেখতে আসতে চাইলে ঢাকা-ঈশ্বরদী রেলরুটের চাটমোহর স্টেশনে নেমে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে অটোরিকশা বা ভ্যানে চড়ে সহজে যেতে পারবেন। ঢাকা কমলাপুর থেকে সকালে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসে চড়ে চাটমোহরে পৌঁছাবেন দুপুরে, সময় লাগবে মাত্র সাড়ে ৪ ঘণ্টা। চাটমোহরে ভালো মানের খাবার হোটেল রয়েছে। দুপুর থেকে ঘুরে বিকেলে পদ্মা এক্সপ্রেসে চড়ে আবার ঢাকা ফিরে যেতে পারবেন। এছাড়া রাত্রীযাপন করতে চাইলেও চাটমোহর-পাবনা ঈশ্বরদীতে রয়েছে আধুনিক সব হোটেল-মোটেল।