বাংলাদেশের রেলপথের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনি সমৃদ্ধ। এই ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম হলো ‘জগতি রেলওয়ে স্টেশন’। এটি কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত এবং দেশের অন্যতম প্রাচীন রেলওয়ে স্টেশনগুলোর একটি। আজ থেকে প্রায় ১৬৩ বছর আগে এই স্টেশনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা আজও আমাদের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ঐতিহ্যবাহী অংশ হিসেবে টিকে রয়েছে।
জগতি রেলওয়ে স্টেশনের যাত্রা শুরু হয় ১৮৬২ সালে, যখন ব্রিটিশ ভারতবর্ষে রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পূর্ব ভারত রেলওয়ের অধীনে নির্মিত প্রথম রেললাইনটি কলকাতা থেকে রানাঘাট হয়ে দর্শনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর এই রেললাইনটি দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। এ সময় জগতি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল জংশন ও টার্মিনাল পয়েন্ট।
এটি ছিল সে সময়ের অন্যতম আধুনিক স্টেশন। এখান থেকেই দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় পণ্য ও যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। ১৯ শতকের শেষের দিকে এবং ২০ শতকের শুরুতে এই স্টেশনের মাধ্যমে কৃষিপণ্য, বিশেষ করে চিনি, পাট, ধান ও গম পরিবহন হতো।
স্থাপত্যশৈলী ও অবকাঠামো
জগতি স্টেশন ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে। লাল ইটের তৈরি ভবনটি ছিল একতলা বিশিষ্ট এবং সামনের দিকে বিশাল প্ল্যাটফর্ম ও টিকিট কাউন্টার ছিল। স্টেশনের ছাদ ছিল উঁচু, যাতে গরমকালে বাতাস চলাচল করতে পারে।
মূল স্টেশন ভবনের পাশেই ছিল একটি বড় ওয়েটিং রুম, যার কাঠের জানালা ও রেলিং আজও সেই পুরাতন আমলের ছোঁয়া বহন করে। প্ল্যাটফর্মটি ছিল লম্বা ও প্রশস্ত, যাতে একই সাথে একাধিক কোচ বিশিষ্ট ট্রেন থামতে পারে। এছাড়া, এখানে ছিল ওভারহেড ওয়াটার ট্যাংক, যা বাষ্প ইঞ্জিনে পানি সরবরাহে ব্যবহৃত হতো। একটি সিগন্যাল কেবিন ও কয়লা স্টোরেজের ব্যবস্থাও ছিল এই স্টেশনে।
জগতি রেলওয়ে স্টেশন একসময় কুষ্টিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র ছিল। এখান থেকে পণ্য পরিবহন করে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হতো, বিশেষ করে পাট ও ধানের চালান। অনেক ব্যবসায়ী ও কৃষক তাদের পণ্য পরিবহনের জন্য এই স্টেশন ব্যবহার করতেন।
এ ছাড়া, জগতি হয়ে যাত্রী পরিবহন চলতো রাজশাহী, পাবনা, যশোর, খুলনা ও ঢাকার দিকে। এর ফলে এখানকার মানুষদের যোগাযোগের সুযোগ বৃদ্ধি পায় এবং শিক্ষা, ব্যবসা ও চাকরির জন্য বাইরে যাওয়ার পথ সুগম হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামে জগতি রেলস্টেশন
ব্রিটিশ শাসনামলে জগতি স্টেশন ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুও। দেশপ্রেমিকরা এই স্টেশন ব্যবহার করে গোপনে পত্রিকা, হ্যান্ডবিল ও রাজনৈতিক বার্তা আদান-প্রদান করতেন। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এ স্টেশন পুলিশ ও ইংরেজ বাহিনীর নজরদারির জায়গা ছিল। অর্থাৎ, শুধুমাত্র যোগাযোগ নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হিসেবেও জগতি রেলওয়ে স্টেশনের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
এরপর ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর জগতি রেলওয়ে স্টেশনের গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়, কারণ তখন ভারতের সঙ্গে রেলপথ সংযোগ বিঘ্নিত হয়। তবে এরপরও এটি কুষ্টিয়া অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হিসেবে টিকে থাকে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, এই স্টেশনটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নজরদারির আওতায়। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে বেশ কয়েকবার অভিযান চালান। শোনা যায়, একবার একটি রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে পাকবাহিনী ট্রেন ব্যবহার করতে না পারে।
তবে স্বাধীনতা লাভের পর প্রথমদিকে স্টেশনটি চালু থাকলেও ধীরে ধীরে এর কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসে। মূলত যাত্রীসংখ্যা কমে যাওয়া, বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থার প্রসার এবং রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার কারণে জগতি রেলওয়ে স্টেশন একসময় প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে এই স্টেশন দিয়ে ট্রেন চলাচল খুবই সীমিত। প্ল্যাটফর্মে নেই আগের মতো ভিড় বা কর্মচাঞ্চল্য। স্টেশন ভবনটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে, অনেক জায়গায় ভেঙে পড়েছে ছাদ, জানালার কাঁচ নেই, কাঠের দরজা ও রেলিং পচে গেছে।
তবে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এই ভবনটি হেরিটেজ রেল মিউজিয়াম হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে এখানে দর্শনার্থী আকৃষ্ট করা যেতে পারে। এটি পর্যটন ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা গেলে স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন
সড়কপথ: ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া সদর বাসে। গাবতলী, কল্যাণপুর বা সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে কুষ্টিয়া অভিমুখী এসি/নন-এসি বাস পাওয়া যায়। কুষ্টিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে জগতি রেলস্টেশন প্রায় ৮-১০ কিমি দূরে। এজন্য অটোরিকশা / সিএনজি বা মোটরসাইকেলে যাওয়া যায়।
রেলপথ: বর্তমানে সরাসরি জগতি রেলস্টেশন পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস চালু নেই। তবে কিছু অংশ ট্রেনে যেতে পারেন। এজন্য ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী জংশন পর্যন্ত ট্রেনে। এরপর ঈশ্বরদী থেকে কুষ্টিয়া।
যেহেতু জগতি রেললাইনটি বর্তমানে সীমিত ট্রেন চলাচলের আওতায় রয়েছে, তাই পুরো পথ ট্রেনে যাওয়ার সুযোগ এখন সীমিত। সড়কপথই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
জগতি রেলস্টেশন ছাড়াও কুষ্টিয়ায় দেখতে পারেন লালন শাহের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি, টেগর লজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী মোহিনী মিল, গোপীনাথ জিউর মন্দির, কুমারখালীর বস্ত্র শিল্পসহ আরো অনেক কিছু।