ইমরান উজ-জামান:
পিঞ্জুর ছেড়ে সোনার পাখি একদিন উড়িয়া যাইবে
গহীনও কাননে একদিন জন্মের মতো লুকাইবে।
ফিরবে যেদিন হায়াতের ডুরী
আমার শুয়া পাখিটা সেদিন যাইবো উড়িরে
ডাকলে আর চাইবো না ফিরি তার ভাবে সে চলিবে।।
————-
সাঙ্গ হবে ভব তামাশা
দুনিয়ার সব ভালোবাসারে
সেদিন বাউল কবি মজনু পাশা চির নিদ্রায় ঘুমাইবে।।
পাখি উড়িয়া যাইবে”
মাইকে চলছে বাউল মজনু পাশার গান। গানের সাথে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সারি সারি উঁচু-নিচু খাসিয়া পাহাড় এবং বাংলাদেশের বারেক টিলার সবুজ বনায়ন ও মাটিয়া পাহাড় চিত্তহরক ও মনোহারি। লাউড়ের গড়ের কাছেই পূণ্যতীর্থ ধাম সংলগ্ন যাদুকাটা নদী। ওপাড়ে শাহ আরেফিনের কবর আর এই পাড়ে শাহ আরেফিনের বাসা এবং ইবাদতের স্থানে গড়ে ওঠা মসজিদ। কাজেই দুই পাশ্র্বই ভক্তদের জন্য পবিত্র। চলছে শাহ আরেফিনের মেলা। একে মেলা না বলে মেলার আড়ং বলা যায়। এক পাশে বসে পসরা-সামগ্রীর বিকিকিনি। অন্য পাশে পীর ফকিরের মজলিশ ও গীত-কণ্ঠে মম করে। সাথে গরু, খাসি, মুরগি জবাই, রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া চলে সমান তালে। আগের দিনে বিডিআর-বিএসএফের সমঝোতায় ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া হতো একদিনের জন্য। মেলা চলে ৩ দিন।
বর্ষীয়ানদের মুখে শোনা, এই মেলার বয়স ১০০ বছরেরও বেশি। এই দুই মেলাকে ঘিরে এখানে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আসে লাখ লাখ মানুষ।
যাদুকাটা নদীতীরে লাউড়, নবগ্রাম, শ্রী শ্রী অদ্বৈত প্রভুর মন্দির ও পূণ্যতীর্থ ধাম। এছাড়া আছে বোত্তাশাহর মাজার, কিয়ত দূরেই আছে প্রমাণ আকারের দৃষ্টিকাড়া শিমুল বাগান। ঘন জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাবে আদিবাসীদের কাঁচা ঘরবাড়ি। নয়নাভিরাম চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে টিলার ওপর কাটিয়ে দেয়া যায় দু দ-কাল।
চৈত্র মাসে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে নদী তার পুণ্য স্রোতে প্রমত্ত হয়ে উঠে। ঐতিহাসিকভাবেই সেই তিথিতে পুণ্যস্নানের আয়োজন হয়। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় পূণ্যস্নানের আয়োজন হয়। কেবল নদী নয়, এই সময়ে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদ, মৌলভীবাজারের মাধবকু- জলপ্রপাত, মাদারীপুরের ওড়াকান্দি আশ্রমের পুকুর, শ্রীমঙ্গলের নির্ম্মাই শিব বাড়ির সংরক্ষিত পুকুরসহ নানা স্থানে হয় পুণ্যস্নান এবং বারুনি মেলা। বারুনি স্নান বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় হয়ে থাকে। তবে সেটা অবশ্যই চৈত্র মাসে। চৈত্র মাসের বিভিন্ন তিথিতে ভাগ করে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী পদ্মা, মেঘনা, ব্রক্ষপুত্র, গঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীতে স্নান করেন। এ উপলক্ষে সেই সমস্ত জায়গায় মেলা বসে। কাজেই মেলা সমূহকে বারুনির মেলা বলা হয়।
উত্তরাঞ্চলের কিংবদন্তি পুকুর সিন্দুরমতি। এটি শুধু একটি সুবিশাল পুকুর নয়, হাজার বছর ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থক্ষেত্র। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার উত্তর-পশ্চিম শেষ সীমানায় প্রত্যন্ত গ্রামে সিন্দুরমতি দীঘি। কথিত আছে, জনৈক হিন্দু জমিদার নারায়ণ চক্রবর্তী খরাজনিত কারণে একটি পুকুর খনন করেন। কিন্তু পুকুরে পানি না উঠায় স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী তার দুই মেয়ের সিন্দুর ও মতিকে পুকুরের মাঝখানে নামিয়ে পূজার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জমিদার পূজার উপাচার সঠিকভাবে ব্যবস্থা করতে না পারায় তা সংগ্রহের জন্য যান। এই ফাঁকে পুকুর পানিতে ভরে যায়। সকলেই পাড়ে উঠলেও সিন্দুর ও মতি অথৈ পানিতে তলিয়ে যায়। পরে জমিদার স্বপ্নে দেখেন তার দুই মেয়ে দেবত্বপ্রাপ্ত হয়ে অমরত্ব লাভ করেছে। সেই থেকে কালক্রমে ওই স্থানের নাম হয় সিন্দুরমতি।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা স্নানকে পরজনমে পুণ্যবান হওয়ার মাধ্যম বলে বিশ্বাস করে। প্রতিবছর চৈত্র মাসের নবমী তিথিতে পুকুরটিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ পূজা অর্চনা করে থাকে এবং বিরাট মেলা হয়।
সীতাকুণ্ডের দর্শনীয় এবং মনোহরি জায়গা চন্দ্রনাথ পাহাড়। এখানে পাহাড়ের চূড়ায় আছে শিবমন্দির, যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে মহা পূজনীয়। জনশ্রুতি আছে, নেপালের এক রাজা স্বপনে পৃথিবীর পাঁচ স্থানে শিবমন্দির স্থাপনের আদেশ পান। সেই মতো রাজা নেপালের পশুপতিনাথ, কাশিতে বিশ্বনাথ, পাকিস্তানে ভুতনাথ, মহেশখালীর আদিনাথ এবং সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির নির্মাণ করেন।
প্রাচীন আমলে এখানে মহামুনি ভার্গব বাস করতেন, অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার বনবাসের সময় এই স্থানে এসেছিলেন। মহামুণি ভার্গব রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র আগমন করবেন জেনে তাদের গোসলের জন্য তিনটি কু- সৃষ্টি করেন। রামচন্দ্রের সাথে তার স্ত্রী সীতাও এখানে এসেছিলেন। রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতা এই কুণ্ডে গোসল করেছিলেন এবং সেই থেকে নাম হয়ে যায় সীতাকুণ্ড। সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়সংলগ্ন বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের শিবর্তুদশীতে আয়োজন করে শিবর্তুদর্শী মেলা। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য সাধু এবং নারী-পুরুষ যোগদান করেন মেলায়।
লেংটা বাবা সোলেমান শাহ একটা লাল গামছা ছাড়া জীবনে দেহে কোনো কাপড় পরেননি। যার কারণে তাকে লেংটা বাবা বলেন ভক্তকুল। ভক্তরা নিজেরাও লাল গামছা গলায় পড়েন, কেউ কেউ পরনের বসনও লাল গামছা ধারণ করেন। চৈত্র মাসের সতেরো তারিখে সোলেমান শাহর জন্মদিন উপলক্ষে তার জন্মস্থান বেলতলিতে মেলা বসে।
দেশের সারাদেশ থেকে ভক্তকুল এসে আসন পাতেন; চলে মেলা-ভজন-গাজন আর গান। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান চলে, ‘আইছি লেংটা, যামু লেংটা, মাঝখানে ক্যান গন্ডগোল…!’ নাচের তালে তালে ‘দোহাই বাবা, লেংটা বাবা…!’
দিনাজপুরের বিরামপুরে ভৈরব রাজা প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যপূর্ণ চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। বিরামপুরের মির্জাপুরে রাজা ভৈরব চন্দ্রের জামলেশ্বর কাচারি বাড়িতে বসে মেলা। প্রজাদের খাজনা আদায়ে প্রজাদের শ্রান্তি দিতে ৫০ ফুট উঁচু টিলার ওপর ১১১ সনে শিব মন্দির নির্মাণ শেষে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পূজার প্রচলন করেন। প্রজাদের আগমনে পূজার দিন মেলায় রূপান্তরিত হয়, পরে মেলার স্থায়িত্ব হয় সপ্তাহব্যাপী।
চৈত্রের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে অর্থ্যাৎ সাতদিন আগে থেকে শুরু হয় নীল পূজার পার্বণ। নীলপূজা বা নীলষষ্ঠী সনাতন বঙ্গীয় লোকোৎসব। নীল-নীলাবতী নামে শিব-দুর্গার বিবাহ উৎসব এটি। ঘেরস্থ গৃহিণীরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় নীরোগ সুস্থ জীবন কামনা করে নীলষষ্ঠী ব্রত পালন করে। নানা আয়োজনে অতিবাহিত হয়ে চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকাল ভাইয়েরা বোনের বাড়ি যায়, ছাতু খায়।
‘শত্রুর মুখে দিয়া ছাই
ছাতু উড়াইয়া ঘরে যাই।’
চৈত্রের শেষ দিনে বাংলার নিজস্ব উৎসব ভাই ছাতু। এরপর লাল কাপড় অথবা পাগড়ি বাঁধা মাথায়, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ত্রিশূল, সঙ্গে ঢাক-ঢোল, করতাল ও কাসর বাদ্য বাহারি সাজে শিব-পার্বতী ও হনু (পাগল সাধু) নীলকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে ছুটবে দলপতি বালা। হিন্দু বাড়ির উঠানে আল্পনা দিয়ে কেউ বা উঠান লেপন করে তাতে বসায় নীলকে। এরপর শুরু নীল নাচ ও শিবের গাজন।
দুপুরের পর শুরু হয় গাছ ঘুড়ানি বা চড়ক পূজা। বরিশাল, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, কালিয়াকৈর উল্লেখ্য করার মতো চড়ক হয়। বৈশাখের প্রথম দিন হয় হালখাতা, কোথাও কোথাও বৈশাখের দ্বিতীয়-তৃতীয় দিনও হালখাতা হয়। বৈশাবি ও পাঁচন উৎসব এবং বৈশাবি হয় পার্বত্য এলাকায়।
মেলার ইতিহাসে বৈশাখী মেলার আছে বিশেষ স্থান। বাংলা সনে বৈশাখ মাস হিসেবে যুক্ত হওয়ার আগে থেকেই, শস্য তোলার মাস হিসেবে এই সময়ে মেলা-পার্বণ উদযাপিত হতো। তার মানে ১৫৫৬ সালে মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর তার সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজির সহযোগিতায় যে বাংলা সন প্রবর্তন করেন, তার আগে থেকেই মেলা প্রচলিত ছিল তো বটেই। মেলার প্রচলন ধরে নেয়া হয় আরও প্রাচীন থেকে প্রাচীন সময়ে।
বৈশাখ আমের শাখের মাস, বৈশাখ স্নান কৃত্যের মাস, বৈশাখ ব্রতচারের মাস, বৈশাখ মধু মাস, বৈশাখ মেলা-পার্বণের মাস। ব্রত পার্বণের কথাই যদি ধরা হয়, এই মাসে পালিত হয় পুণ্যিপুকুর ব্রত, অশ্বথ পাতার ব্রত, গোকুল ব্রত, হরিষ মঙ্গল ব্রত, পৃথিবী পার্বণের ব্রত, দশপুতুল ব্রত, শিবপুজা ব্রত, জল-সংক্রান্তি ব্রত, অক্ষয় তৃতীয়া ব্রত, বৈশাখ চম্পক ব্রতসহ আছে অনেক ব্রত।
বাংলা একাডেমির থেকে প্রকাশিত ‘ধানশালিকের দেশ’ ২৫ বর্ষ ২য় সংখ্যা এপ্রিল-জুন ১৯৯৭ এর মেলা সংখ্যা’র তথ্য মতে, বাংলাদেশে বৈশাখ মাসে আয়োজিত মেলার সংখ্যা ২৪৫। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশন ‘বাংলাদেশের মেলা’ সংখ্যা ১৯৮১ সালের করা ২য় সংস্করণ বইতে বৈশাখ মাসের মেলা ২৭০। বাংলা নববর্ষ, বর্ষবরণ, নববর্ষ, বৈশাখী মেলা, হালখাতা মেলা যে নামেই বলা হোক না কেন, এসবই বৈশাখী মেলা হিসেবে আয়োজিত হয়।
এছাড়া চৈত্রের শেষ দিন সংক্রান্তি উপলক্ষে বসা মেলা সমূহ যেহেতু বৈশাখ পর্যন্ত চলে, কাজেই সংক্রান্তি এবং চড়ক পূজার মেলাকেও বৈশাখের মেলা হিসেবেই যুক্ত করতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশনের হিসাবে চৈত্রে মেলার সংখ্যা ৩৩৭টি। এছাড়া মহানামব্রত, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, শাহ কামাল (র.) এর ওরশ রত্নকর গোস্বামী উৎসব, হযরত খাজা আব্দুল গফুর চিশতীর ওরস, আশ্বিনী গোস্বামী উৎসব, কালার মাজার ওরশ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, শীতলা পার্বণ, জিওর উৎসব, আশ্রম উৎসব, বুড়ি পার্বণ, বিপন চন্দ্র ঠাকুর উৎসবসহ আরও কিছু লোক মেলা এই বৈশাখে আয়োজিত হয়। ধারণা করা যায়, শুধু বৈশাখ মাসেই বাংলাদেশে প্রায় হাজারের অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও পরিব্রাজক