■ পর্যটন বিচিত্রা প্রতিবেদন
মণিপুরিরা এই দেশের অন্যতম বিশ্বনন্দিত সংস্কৃতির ধারক। তাদের মধ্যে এক বিশাল সংখ্যক লোক হচ্ছে সনাতন ধর্মের অনুসারী। সনাতন ধর্মাবলম্বী মণিপুরিদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ‘মহারাসলীলা’। প্রতিবছর কার্তিক মাসের শেষ বা অগ্রহায়ণের শুরুতে রাসপূর্ণিমা তিথিতে মনিপুরি সম্প্রদায় এই উৎসব পালন করে।
মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তর্তী দুই উপজেলা কমলগঞ্জ আর আদমপুরে পালিত হয় এই উৎসব। পূর্ণিমার দিন সকালে পাপমোচন ও পূণ্য লাভের আশায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দলে দলে পূজা-অৰ্চনা পাঠ ও পুণ্যস্নান করেন।
রাসমেলা মণিপুরিদের প্রধান উৎসব। এটি রাসলীলা নামেও পরিচিত। এই মেলার ইতিহাস ও দীর্ঘকালের। সুন্দরবনের দুবলারচর ও কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকতেও এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। চলতি মাসের ৮ তারিখ কমলগঞ্জ ও আদমপুরে এবারের মহারাসলীলা উৎসব শুরু হয়। কমলগঞ্জের মাধবপুরের জোড়ামণ্ডপে রাসলীলা উৎসবের আয়োজন করেন মহারাসলীলা সেবা সংঘের বিষ্ণু- প্রিয়া মণিপুরিরা। আর আদমপুরের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মণ্ডপে রাসলীলা উৎসবের আয়োজক মৈ- তৈ সম্প্রদায়ের রাস উৎসব উদযাপন কমিটি। মাধবপুর জোড়ামণ্ডপের ১৮০তম ও তেতইগাঁও সানাঠাকুর মণ্ডপ প্রাঙ্গণের ৩৭তম রাস উৎসব এটি। মহারাসলীলা উপলক্ষে নভেম্বরের শুরু থেকেই এই দুটি মণ্ডপে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সাজানোর কাজ শুরু হয়।
সাদা কাগজের নকশায় নিপুণ কারুকাজে সজ্জিত করা হয় মণ্ডপগুলো। ৮ নভেম্বর বেলা ১১টা থেকে তুমুল হৈ চৈ, আনন্দ-উল্লাসে ঢাক-ঢোল, খোল- করতাল, শঙ্খ ধ্বনির আর বাতাসা বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে রাখাল নৃত্য (গোষ্টলীলা) শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। খোলা মাঠে কলাগাছ ও সাদা কাগজ দিয়ে ঘেরা সামিয়ানা টানানো প্যান্ডেলে নৃত্য চলাকালীন ভক্তরা মণ্ডপে বাতাসা ছিঠিয়ে বাতাসা বৃষ্টি করেন। সেই বাতাসা আবার ভক্তরা কুড়িয়ে নেন। মণ্ডপে মণিপুরি শিশু নৃত্যশিল্পীদের নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠে এই আনন্দে। রাতে অনুষ্ঠিত হয় রাস উৎসব। এ উপলক্ষে রাতে লাখো মানুষের মিলনতীর্থে পরিণত হয় মাধবপুর জোড়ামণ্ডপ আর আদমপুরের সানাঠাকুর মণ্ডপ এলাকা।
এ বছর অসংখ্য বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে মণ্ডপ দুটিতে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরসহ নানা পেশার মানুষের পদচারণায় সকাল থেকে মুখরিত হয়ে উঠে মণিপরি পল্লীর এ দুটি এলাকা। উৎসবকে কেন্দ্র করে দুটি স্থানেই বসে বিশাল মেলা। মেলায় নানা ধরনের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। মাধবপুর ও আদমপুরে রাসমেলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, মহারাসলীলা মূল উপস্থাপনা শুরু হয়েছে বেলা ১১টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য’ দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালকবেলাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গোধূলি পর্যন্ত চলে রাখাল নৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হয় মধুর রসের নৃত্য বা শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। রাসনৃত্য ভোর পর্যন্ত চলে। রাসনৃত্যে গোপিনীদের সাথে কৃষ্ণের মধুর- লীলার কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তুলেন শিল্পীরা। রাসলীলার ইতিহাস প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো। জানা যায় ১৭৬৯ সালে মণিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্ৰ স্বপ্নাদেশে রাসলীলার এই নৃত্য-গীতের প্রবর্তন করেছিলেন। মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র বেষ্ণব ধর্মের আচরণীয় শ্রীমদ্ভগবতের রাস পঞ্চাধ্যায় পঠন সেবায় ব্রতী হন বটে কিন্তু ভগবৎকৃত রাসলীলা, গোপী, সখী ও মঞ্জুরীসহ বিরাজমান দৃশ্য চাক্ষুষ দর্শনে অপারগ হয়ে নিজে শ্রীগোবিন্দ জিউর চরণে প্রাণপাত শয়নে গেলেন। তন্দ্রাবস্থায় তিনি দেখতে পান, শ্রীকৃষ্ণ শীর- াধা ও গোপীসহ দিব্য রাসলীলা করছেন। এরপর মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র কয়েকজন কুমারী মেয়ে দিয়ে স্বপ্নের মতো রাসলীলা করালেন। এতে নিজ কন্যা কুমারী বিশ্বাবতীকে শ্রীরাধা এবং মন্দিরের শ্রীগোবিন্দকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাসলীলা করেন।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি কমলগঞ্জ যাওয়া যায় ট্রেনে। সিলেটগামী পারাবত ও জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস কমলগঞ্জ (ভানুগাছ) স্টেশনে থামে। এছাড়া অন্যান্য ট্রেনে শ্রীমঙ্গল এসেও সেখান থেকে সহজেই কমলগঞ্জ আসা যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ও উপবন এক্সপ্রেস।
এছাড়া ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহণ, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি পরিবহণের এসি/নন এসি বাস যায় শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জ যাওয়া যায় বাস কিংবা অটোরিকশায়। একইভাবে যাওয়া যাবে আদমপুরেও ।
কোথায় থাকবেন
কমলগঞ্জে থাকার তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। কাছাকাছি থাকার জন্য ব্যবস্থা হল লাউয়াছড়া বনের পাশে বেসরকারি বাংলো। এছাড়া কমলগঞ্জের কাছাকাছি থাকার জন্য রিসোর্ট আছে।