লেখকঃ মার্জিয়া লিপি – (লেখক, গবেষক ও পরিবেশবিদ)
হেমন্তের সকাল। দৈনিক পত্রিকার শিরোনামে জানতে পারি, পদ্মা নদীতে সন্ধান মিলেছে হারানো স্থাপনার। সেবার অফিসের কাজে যেতে হয়েছিল পদ্মা নদী আর রেশমের শহর রাজশাহীতে। উপশহর থেকে পদ্মা নদীতে হারানো স্থাপনার সন্ধানে বের হই সেই কাক ডাকা ভোরে। যদিও গন্তব্য আরও অনেক দূরে, পাবনার মোকসেদপুর। কয়েক মাস আগে পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে মনে উঁকি দেয় আগ্রহ আর কৌতূহল। বিশাল পদ্মাতে ডুবে থাকা স্থাপনা- পুরাকীর্তির ছাদে দাঁড়িয়ে জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরছে। প্রমত্তা পদ্মায় হাঁটুপানি। বিস্ময়কর! ভাবছিলাম, হয়তো এখানেও থেকে যেতে পারে ওয়ারী বটেশ্বরের মতো কোনো বিলুপ্ত জনপদ, নগরী অথবা ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে পুরাকীর্তিটি পানিতে ডুবে আছে। অসম্ভব কিছুই না- ইতালির ঐতিহাসিক নগরীর অর্ধেকাংশ এরকম দুর্যোগে ডুবে গেছে সমুদ্রের পানিতে।
শহর থেকে একটু গাঁয়ের দিকে গেলেই টের পাওয়া যায় হেমন্তের সঞ্চার। ঋতুসন্ধির এই কালে একদিকে জ্বলে রাতের আকাশ প্রদীপ, অপরদিকে দিনের ঝলমলে রোদ। মেঘের চালচিত্রে প্রকৃতির সবুজ আভা ছড়িয়ে থাকে বিকেলের মাঠে মাঠে। অমৃতময় সন্ধ্যা কখনো কখনো ঢাকা পড়ে হালকা কুয়াশায়। হেমন্তে আকাশ থাকে নীল। নীল আকাশজুড়ে থাকে মেঘের আনাগোনা। পরিবেশ থাকে শীতের শৈত্য আর গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। তাই এ সময়ে ভ্রমণে সুখ পাওয়া যায়। পাকশীতে সন্ধ্যারাতে ঘাসে ঢাকা ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসা একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর জোনাকির আলো এক রকমের মায়া ধরিয়ে দেয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে হেমন্ত স্বতন্ত্র ঋতু নয়- শরতেরই অংশ। তারপরেও কার্তিক, অগ্রহায়ণের আকাশ তারায় তারায় ভরে যায়। তারা চেনার উপযুক্ত কালের নাম এই হেমন্ত। একসাথে আকাশের যত বেশি অংশ দেখা যায় ততই তারা চেনার সুবিধা। হেমন্তের আকাশে সন্ধ্যায় জেগে ওঠে নক্ষত্রমাল। এ সময় তারা চেনা থাকলে আকাশ দেখতে মন্দ লাগে না।
পূর্ণিমা রাতের পদ্মা অন্যরকম। মনে আলাদা অনুভূতি সঞ্চারিত হয়। এক টুকরো মেঘ এসে জ্যোৎস্না ঢেকে দিলে জোড়াসেতুকে তখন আবছা আঁধার ঢেকে ফেলে। তাতে কল্পনায় বিচিত্র রূপ ফুটে ওঠে। যদিও সেই রূপ দেখার লোকের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। তারপরও পেপার মিলের পাম্পিং স্টেশনের কাছে গোল চত্বরে অনেককেই বসে থাকতে দেখা যায়। নির্জনতায় কয়েকটি প্রহর কাটিয়ে যায় পর্যটকরা। রূপসী পাকশী যেন একেক ঋতুতে একেক রকম রূপটান মেখে বসে থাকা রমণী। পদ্মার নিস্তরঙ্গ মেজাজ অনুভব করা যায় হেমন্ত ও শীতকালে। এ সময় পানিতে টান ধরা রেখা দেখা যায়, পানির রাগ থাকে না। বর্ষায় নদীর মাঝে প্রবল স্রোতে নাভি সৃষ্টি হয়- যা দেখে ভয় লাগে। হেমন্তের হাওয়ায় বিকেলে পদ্মার বুকে নৌকা ভ্রমণ মানেই পাকশী। জোড়াসেতুর ভেতর দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যেতে হয়। ছুটির দিনে এখানে অবকাশ যাপন মন্দ লাগে না।
আজকের দিনে অনেকের সাথেই পদ্মা নদীর পরিচয় বা সাক্ষাত হয়। ট্রেনযাত্রী হয়ে হার্ডিঞ্জ সেতু পেরিয়ে বা লালন শাহ্ সেতু থেকে যানবাহনে চেপে যেতে যেতে এক ঝলক নদী ও সেতু দেখা হয়ে যায়। অবশ্য ভাড়াটে নৌকায় বসে উজানে বা ভাটিতে ভেসে যাওয়ার সময় পদ্মার পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুই তীর প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা। নদীতে আগের মতো আর রকমারি নৌকার চলাচল নেই। লঞ্চ বা ফেরিও চলে না। অথচ এক সময় অসংখ্য নৌযান নদীর বুক চিড়ে চলাচল করতো। ২০০৪ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত ফেরিও চলেছে। লালন শাহ্ সেতু চালুর পর এখন আর নদীর বুকে ব্যস্ততা নেই। কেবল গোটা কতক ডিঙি নিয়ে জেলেরা মাছ শিকারে ভাসে। যদি আকাশের দিকে দৃষ্টি তোলা যায়, তাহলে খানিক দার্শনিক ভাব আসে বিস্ময়কর সৌন্দর্যের চমকে। দিগন্তের ফিকে নীলে থোকা থোকা মেঘ ভেসে যায়। হেমন্তের দিনের বেলায় আকাশে তেমন রঙিন মেঘের সমাগম ঘটে না। হেমন্তের আকাশ যেন সূবর্ণবৎ জোড়াসেতুকে গাঢ় আলিঙ্গনের জন্য মেঘাবরণ ছায়ার আঁচল ছড়িয়ে দেয়। নিসর্গের মেঘমাত্রিক সৌন্দর্য ইতিহাস, অভিজ্ঞতা মিলে পাকশী অনুভবযোগ্য স্থান।
সূর্য উঠার পর পরই একরাশ উত্তেজনা ও অ্যাডভেঞ্চারের কল্পনা নিয়ে পদ্মা নদীর উপশহর থেকে একটা ছোট সাদা গাড়িতে চেপে বসি। যাত্রাপথের সবকিছুই কল্পনার রঙে একের পর এক জাল বুনে যাচ্ছে- গাছ, লতা-পাতা দৃষ্টিসীমার সবকিছু দিয়ে। শহরের কোলাহলকে পাশ কাটিয়ে কাজলা, মতিহারের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরকে বাঁ দিকে রেখে এগিয়ে চলি; ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে। চলতি পথ ধরেই রেশম উন্নয়ন বোর্ড। সিল্কের জন্য বিশেষ খ্যাত এই বিভাগীয় শহর। চোখজুড়ে আছে সোনালী রেশম পোকা থেকে সুতা বের করা হয়। শুককীট হতে মথ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে রেশম পোকার জীবন চক্র। নির্দিষ্ট বয়সে রেশম গুটি পানিতে সিদ্ধ করে সুতা বের করা হয়। রেশম পোকার জীবন যেন ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।’ লালা নিঃসৃত কষ বা সোনালী রেশমী সুতার কারণে বিসর্জিত হয় রেশম পোকার জীবন।
কালো পিচের রাস্তাা দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। দর্শনীয় নতুন কিছু দেখতেই গাড়িচালক মান্নান ভাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিই ‘এ কথা ও কথার’ আদি অন্ত। ঢাকা নগরীর ব্যস্ততা এখানে কোথাও নেই। সময়ের সাথে গতি ছন্দ রেখেই চলছে। নেই কোনো যানজট, হৈচৈ যাতে ছন্দপতন হয় ভাবনার। ভাবছিলাম মনে মনে, এখানে জীবন অনেক সহজ, সতেজ আর নিয়ন্ত্রিত। ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর হঠাৎই দৃষ্টি চলে যায়, লাল টেরাকোঠার পুরনো স্থাপনার দিকে। একেবারে হাইওয়ের পাশেই বাঘা মসজিদ কমপ্লেক্স। রাস্তার উপর কিছু দোকান পাট, চায়ের স্টল, দর্শনার্থীর জটলা। গন্তব্য যদিও আরও দূরে, যেতে হবে সেই মোকসেদপুর। কিন্তু একবার চোখে পড়ার পর মনে হলো, এখনই দেখে নিই। যদি ফেরার পথে সূর্যের আলো না থাকে, তাহলে প্রায় পাঁচশত বছরের পুরনো স্থাপনার অনেক কিছুই থেকে অদেখা, অধরা থাকবে। রীতিমতো আশ্চর্য রকম সৌর্ন্দয। এখনো অনেক বেশি আনকোরা, টেরাকোঠা স্থাপনাটি। বাঘা মসজিদ কমপ্লেক্স ধরে সামনে, পাশে, চারপাশে দেখছি অবাক করা মগ্নমুগ্ধ দৃষ্টিতে।
এক সময় নাকি বাঘায় গভীর বন জঙ্গলে বাঘের দেখা মিলতো। বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে ২৪ কি.মি দক্ষিণ পূর্বে বাঘা ওয়াকফ্ এস্টেটের সদর দপ্তর। উপমহাদেশের অনেক জায়গার মতোই সভ্যতার পত্তন হয় এখানে নদীর ধারে। বাংলার সুলতান গৌড়ের শাসন আমলে ১৫২৩ খ্রিষ্ট্রাব্দে নসরত শাহ বাঘা মসজিদ নির্মাণ করেন। ছোট স্বতন্ত্র লাল ইটে নকশা করায় আরবি ক্যালিওগ্রাফের শিলালিপির টেরাকোটা এই মসজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
বাঘা মসজিদকে ঘিরে রয়েছে নানা রকম কিংবদন্তি। শোনা যায়, নির্মাণকাজের এক পর্যায়ে সন্ধ্যায় গম্বুজের কাজ অসমাপ্ত রেখে রাজমিস্ত্রিরা চলে যান। কিন্তু পরদিন সকালে দেখা যায় গম্বুজটি পূর্ণ সমাপ্ত অবস্থায়। হযরত শাহদৌল্লাহ ও ৫ জন আত্মীয়ের মাজার মসজিদের সাথেই। আরেক পাশে রয়েছে বিশাল সাগরের মতো দীঘি। কিংবদন্তি রয়েছে- অনেক বছর আগে দীঘিতে রক্ষিত বিশাল হাড়ি ও বাসনপত্রে রান্না ও খাওয়ার পর্ব চলতো ওরসের মেলায়। ওরস শেষে হাড়ি ও বাসনপত্র দীঘিতে ফেরত দিয়ে দিতে হতো। এ রকমই রেওয়াজ ছিল। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর। কিন্তু কলিকালে- এখন আর এমনটি হচ্ছে না।
লোক মুখে শোনা কথা, হয়তো কারো বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে এমনটি হয়েছে, দীঘিতে ফেরত দেওয়া হয়নি হাড়ি ও বাসনকোসন। ওরসের সময় ছাড়াও প্রায়ই মানত হিসেবে দূর দূরান্ত থেকে টাকা, ছাগল, মোমবাতি, আগরবাতিসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে আসেন ভক্তবৃন্দ। এরকম কয়েকজনের দেখাও মিললো বাঘা মসজিদ প্রান্তরে। মহাসড়কের পাশে ৪৮৭ বছরের পুরনো বাঘা মসজিদ কমপ্লেক্স যা বর্তমানে প্রতœতাত্ত্বিক বিভাগের সংরক্ষণে রয়েছে।
মসজিদের স্থাপত্যরীতির সাথে মিল রেখে নির্মিত হয়েছে তোরণ যার পাশে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাঘার বিশাল দীঘি। বসে থাকা স্থানীয় কয়েকেজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, অল্প দূরে পদ্মা নদীতে ডুবে থাকা পুরাকীর্তির কথা। খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে চায়ের দোকানে বসে থাকা দুই তিনজন স্থানীয় ভাষায় বলছিলেন- ‘আফা, আফনে কোন পত্রিকার লোক?’ তারা ধরেই নিয়েছে আবারও পানিতে ডুবে থাকা পুরাকীর্তি পত্রিকায় খবর হতে যাচ্ছে। হাতে সময় কম থাকায় আড্ডাটা খুব একটা জমে ওঠেনি। বলতে বলতেই কল্পনার জালে হারানো ইতিহাস বার বারই যেন আটকাচ্ছিল। একেবারে বাংলাদেশের অন্যান্য পাড়াগাঁয়ের ভূ-দৃশ্য, সবুজ, শ্যামল, নিরব, স্নিগ্ধ। আশপাশের জমিতে হাল দিচ্ছে ব্যস্ত কৃষাণ, কোথাও ধান কাটার পর খালি জমি পড়ে আছে, পাশে কিছু ফেলে যাওয়া ধানের বিছালিসহ। একপাশে ক্ষেতে আল ধরে সারি সারি কলাগাছ। পথের পাশেই একটা গরুর পিঠে কালো ফিঙ্গে বসে আছে, লেজ দিয়ে বার বার ফিঙ্গেটিকে তাড়ানোর দৃশ্য। কোথাও ফসল বোনার জন্য সমান দূরত্বে উঁচু করে মাটির ঢেউয়ের পর ঢেউ। সবুজ ঘাসের উপর হলুদ প্রজাপতির চঞ্চল ডানায় ভর করে উড়ে উড়ে বেরাচ্ছে। মাটির পথ ধরে কিছু দূরে ছোট চাতালে ধবধবে সাদা কয়েকটি বক ডানা মেলে উড়ছে কীসের সন্ধানে কে জানে? তবে এক সময় প্রমত্তা পদ্মায় এসে যখন পৌঁছালাম তখন দৃষ্টিসীমায় পুরাকীর্তির কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না। একপাশে নদীর চর, ধানক্ষেত, নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলে। কল্পনায় মিলিয়ে দেখছিলাম- মাঝনদীতে জেলে পুরাকীর্তির ছাদে দাঁড়িয়ে জাল মেলে মাছ ধরছে। জেলেরাও জানালেন এমনটিই করছিলেন তারা চৈত্র বৈশাখ মাসে যখন নদীর পানি কম ছিল। মাছ ধরা ছাড়াও তখন শ্যাওলা ধরা ছাদের পাশে দাঁড়িয়ে হাত স্পর্শ করছিলেন পুরাকীর্তিটির দরজা জানালায়।