লেখকঃ মারজিয়া লিপি – গবেষক ও পরিবেশবিদ
ভ্রমণ ম্যাগাজিনে একটা লেখা পড়ে ভুটানের পুরনো রাজধানী পুনাখাতে স্বপ্নভ্রমণ শুরু করেছিলাম অনেক বছর আগেই। ২০০৩ সালে দার্জিলিং থেকে নকশালবাড়ি হয়ে জয়গাঁ নামক স্থানটিতে একরাত কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। জয়গাঁর ফটকটি পেরিয়ে সেবার ভুটানের ফুন্টসলিংয়ের কিছু দূরে গিয়েছিলাম কুমিরের ফার্মটিতে। পেশায় বন ও পরিবেশবিষয়ক কর্মকর্তা হওয়ার কারণে নিসর্গ প্রকৃতির পাশাপাশি বন আর বণ্যপ্রাণী নিয়ে আগ্রহ আমার স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। সেবার ভিসার পারমিশন না থাকায় থিম্পু, পারো, পুনাখা ছিল অধরা। জয়গাঁ থেকে শুধুমাত্র ফুন্টসলিং আর জলদাপাড়া রাইনোল্যান্ড দেখেই ফিরে এসেছিলাম দেশে। কিন্তু এবার সিদ্ধান্ত নিলাম একই পথে ভারতীয় ট্রানজিট ভিসা নিয়ে ভুটান ঘুরে আসবো।
ভ্রমণ নিয়ে কথা হয়, কাশ্মীর ভ্রমণের সময় পরিচিত কলকাতার ট্রাভেল নেস্টের সুভাসদার সঙ্গে। দেশভাগের পূর্বে সুভাসদার পরিবারের আবাস ছিল আমাদের ময়মনসিংহে। ভুটান ভ্রমণের জন্য একজন দুইজন করে সদস্য সংখ্যা বেড়ে অবশেষে দাঁড়ালো ১৫ জনে। সহকর্মী ১১ জন আর দীপনের ৪ সদস্যের পরিবার।
ভারতীয় ট্রানজিট ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও রিটার্ন টিকিটসহ ভিসা সেন্টারে আবেদনের প্রেক্ষিতে পাসপোর্ট ফেরত পেলাম কাক্সিক্ষত ভিসাসহ। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে পরিকল্পনা মতোই ছিল, শুধুমাত্র সূর্যের ভিসা নিয়ে বিপত্তি। ফরম ফিলাপের সময় ভুলে জন্ম তারিখে একটি শূন্য কম থাকায় নির্ধারিত তারিখে ভিসা পাওয়া অনিশ্চিত। অবশেষে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে সার্ভারে তথ্য সংশোধন করা হলো। এভাবেই কাক্সিক্ষত ভিসা হাতে আসে যাত্রার আগের দিন রাত ৮টার পর।
২০১৬ সালে ৬ অক্টোবরে ঢাকা থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয় সকাল ৮টায় নভোএয়ারে। প্রথমে সৈয়দপুর পরে মাইক্রোবাসে বাংলাবান্ধায়। ভারতীয় ট্রানজিট ভিসায় সেখান থেকে চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দর হয়ে জয়গাঁয় হোটেলে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা। ভারত সীমানায় জয়গাঁ ফটকের অপর পাশেই ভুটানের ফুন্টসলিং।
ফুন্টসলিং ভুটানের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। থিম্পু ভুটানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ফুন্টসলিং থেকে ভুটানের রাজধানী থিম্পুর রাস্তা অসম্ভব রকমের সুন্দর। উঁচুনিচু পাহাড়, ঘন সবুজ বন, ঝর্ণা, কোথাও বা মেঘের লুকোচুরি। সব মিলে বেশ স্বপ্নময় যাত্রা।
ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভুটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে, যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’। দেশটি ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত। তিব্বত, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ এবং আসাম দিয়ে পরিবেষ্টিত ভুটান। রাজধানী হলেও থিম্পু বেশ শান্ত স্নিগ্ধ। রাজধানীর যে কোলাহল থাকে তা একেবারেই অনুপস্থিত। আমাদের জন্য নির্ধারিত দুইটি গাড়ির একটিতে রয়েছে সুভাসদার রান্নার আয়োজন। পথ চলতে চলতে যাত্রাপথে ভারতীয় মজাদার খাবার আমাদের ভ্রমণকে করেছে নির্ভার। সেই সঙ্গে আনন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকগুণ।
চারপাশের প্রকৃতির বৈচিত্র্য যেন এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ রাখতে দিচ্ছে না। সবুজ প্রকৃতি মাঝে মধ্যেই ঢেকে যায় সাদা ধোঁয়া ছড়ানো কুয়াশায়। এরকম মনোগ্রাহী দৃশ্যের দেখা পেলেই গাড়ি থেকে নেমে ফটোসেশন চলে। এর মধ্যে হঠাৎ বিপত্তি! আমাদের লাল রঙের জিপটির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পর অন্য একটি গাড়ি জয়গাঁ থেকে এসে আমাদের উদ্ধার করে। এতে নির্ধারিত সময় থেকে ঘণ্টা দুয়েক দেরি হয়ে যায়। রাজধানী থিম্পুতে পৌঁছাই রাত ৮টায়। আমাদের জন্য বুকিং দেয়া হোটেল ‘তাকসান’ বেশ ঝকঝকে। ডিনার শেষে টানা আড্ডায় অনেক সময় পেরিয়ে যায়। এক সময় ঘুমের আয়োজনে ফিরে আসি যার যার রুমে। প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে আবিষ্কার করি হোটেলের পাশে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি সুন্দর নদীটিকে। রাজবল্লভী আর আলুর দমে নাশতা শেষে সবাই বের হয়ে যাই শহরের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিভ্রমণের জন্য। মিউজিয়াম, বড় বৌদ্ধা আর মনাস্ট্রি ঘুরে হোটেলে ফিরে আসি দুপুরের পর। একটু দেরিই হয়ে গেল মধ্যাহ্ন ভোজের। বিকালে হোটেলের খুব কাছেই একটি শপিংমলে ছোট দলে ভাগ হয়ে কেনাকাটা করতে বের হই। মুখোশ, বৌদ্ধ মূর্তি, ভুটানের সুভ্যেনির আর দুই রকমের মরিচের সস নিয়ে ফিরে আসি সন্ধ্যার পর পরই। পরিকল্পনা ছিল পরদিন খুব সকালে নাশতা শেষে বের হয়ে যাবো পুনাখার উদ্দেশে। হোটেল চেকআউট করার সময় বুঝতে পারলাম আমাদের রুমের চাবি নিখোঁজ। সম্ভাব্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হোটেলের রিসিপশনে মাস্টার কি-ও ছিল না। ফলে সবাই দুশ্চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে চাবি খুঁজতে থাকে। অভিযুক্ত সূর্য এর মধ্যেই হোটেলের পাশের সুপারশপ থেকে চাবি উদ্ধার করে ফিরে আসে হন্তদন্ত হয়ে। এ সব বিপত্তিতে কিছুটা সময় কেটে যাওয়ায় আমরা যাত্রা শুরু করি বেলা ১১টায়।
শিল্পীর আঁকা পোর্টেট। প্রকৃতির এ রকম অপার সৌন্দর্যে সবাই বিমোহিত। পথে অনেক জায়গায় থেমে থেমে মন ভরে অনেক অনেক ছবি তোলা হয়। সঙ্গে ছিল আমাদের সহকর্মী নওরোজ ভাই। একটি অতিরিক্ত ব্যাগ বহন করে এনেছেন দেশ থেকে। নানা রকম আর বৈশিষ্ট্যের ক্যামেরার যন্ত্রপাতি। লেন্স পরিবর্তন করছেন ক্ষণেক্ষণে। কখনো আমাদেরকে ফ্রেমে ধরে রাখছেন ক্লোজআপ ভঙ্গিতে। কখনো বা দূরের প্রকৃতিকে তুলে রাখছেন লং-শটে। বিনা বাক্য ব্যয়ে আমাদের আবদার মেনে নিচ্ছিলেন নওরোজ ভাই হাসিমুখে। ক্যামেরায় তুলে রাখছেন আমাদের নানা রঙের রঙিন স্মৃতিময় মুহূর্তকে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সবুজ ধানের চত্বর। সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসে চারপাশ। সন্ধ্যার প্রায় আগে আগে পৌঁছে যাই আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেলটিতে। বিস্মিত সবাই হোটেলের পেছনের ব্যালকনির নিচে বহমান নদী ও নদীর ওপর ব্রিজটিকে দেখে। বেশ কিছু অভিজাত রিসোর্ট রয়েছে আশপাশেই। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে চারপাশ যেন স্বপ্নময় সৌন্দর্যের মোড়কে জড়িয়ে রয়েছে। ডিনারের পর হোটেলের পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা নদীর পাড়ে বালিতে বসে বিরতিহীন আড্ডা আর হেড়ে গলায় গানের শব্দে চারপাশে রাতের নীরবতা যেন ভেঙে পড়ছে। বিরতিহীন সুরে বেসুরে গানের প্রতিযোগিতা চলছে।
পরদিন ভুটান রাজার বাড়িতে বেড়াতে যাই। যদিও আমন্ত্রিত হয়ে না, টিকিট কিনে। মাচু-পিচু নদীর সংযোগস্থল। পাশেই ত্রিভুজের অনেকটা জায়গা জুড়ে অবস্থিত রাজবাড়িটি। ডিজহং ব্রিজ থেকে নদীতে রাখা রাফটিংয়ের নীল রঙের নৌকাগুলো আমাদের দৃষ্টিসীমানায়। জাদুঘর, উপাসনাঘর আর দাপ্তরিক কার্যালয় রয়েছে পুনাখা ডিজহংয়ে। হোটেলে ফিরে এসে মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে যাত্রা করি পারোর উদ্দেশে। একপাশে নদী আর অন্যপাশে সবুজ রঙের পাহাড়ের গা-ঘেঁষে রাস্তায় আমাদের যাত্রা। পথে সন্ধ্যায় শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে পারো নদীর পাশে পৌঁছে যাই আমাদের হোটেলটিতে।
ছবির মতো সুন্দর পুনাখার সবকিছুই যেন সাজানো গোছানো। যাত্রাপথে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চমৎকার জায়গাগুলো হলো- দোচু-লা-পাস, পুনাখা ডিজহং, আর্চারি গ্রাউন্ড ইত্যাদি। এসব দেখে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি- সবাই আমরা আনন্দে ভাসছিলাম। সাদা রঙের স্মৃতিসৌধ দোচু-লা-পাসের উল্টোপাশের রেস্টুরেন্টটি ছিল একটি ভিউ পয়েন্ট। সে রেস্টুরেন্টে বসেই আমরা কফি আর হালকা নাশতা করি। কাঁচের জানালা দিয়ে দূরের সবুজ পাহাড়ের ওপর নীল আকাশ যেন কোনো আঁকা ছবির দৃশ্য।
আমাদের উদ্দেশ্য পরদিন টাইগার নেস্ট অভিযান। তাকসান মনাস্ট্রি বা টাইগার্স নেস্ট ভুটানের প্রধান ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির। পারো ভ্যালিতে সুউচ্চ পাথুরে পাহাড়ের ঝুলন্ত খাঁজে এক অভূতপূর্ব নির্মাণশৈলীর নিদর্শন এই মনাস্ট্রি। কথিত আছে, অষ্টম খিষ্টাব্দে বৌদ্ধ গুরু পদ্মসম্ভা (যিনি ভুটানের প্রথম বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক) বাঘের পিঠে চড়ে এখানে আসেন এবং এর গুহায় তিন বছর তিন মাস তিন সপ্তাহ তিন দিন তিন ঘণ্টা তপস্যা করেন। পরে ১৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে তার সম্মানার্থে এটি তৈরি করেন গিয়ালসে তেনজিং রাগবে। টাইগার্স নেস্ট ট্র্যাকিং কষ্টসাধ্য, সময় লাগে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। কিন্তু মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা। ভ্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকায় ফেরত আসার আগের দিন সকাল ৭টায় একটি গাড়ি নিয়ে রওনা হই গন্তব্যের উদ্দেশে। ১৭ জনের মধ্যে ৯ জন রওনা হই ট্র্যাকিংয়ের জন্য। মেয়ে ভোর ও রক্সি প্রথমবারের মতো ট্র্যাকিংয়ে যাচ্ছে। তাই তাদের প্রস্তুতি ও উত্তেজনা বেশ উপভোগ করার মতো। হোটেলে রয়ে যায় দীপন ছোট্ট দ্রাবিড় আর দীপাঞ্জনকে নিয়ে এবং পিউ আপা আর দীপ্ত ভাই রায়ানকে নিয়ে। কামরুল ভাই অভিযানে সঙ্গী হলেন না। আগের রাতেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন তিনি ট্র্যাকিংয়ে আগ্রহী নন। আরও জানান, তার স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের সাবিনা ভাবির তো প্রশ্নই উঠে না এসব পাহাড়ি পথে সারাদিন হাঁটার। সকাল ১০টায় আয়েশ করে ঘুম থেকে উঠে শুনতে পেলেন সকাল ৭টায় তার স্ত্রী ও কন্যা রওনা করেছেন ট্র্যাকিং দলের সঙ্গে টাইগার্স নেস্ট অভিযানে!
পারো শহর থেকে টাইগার নেস্টেও ট্যাক্সি স্ট্যান্ড/পার্কিংয়ে যেতে সময় লাগবে প্রায় ৩০-৪৫ মিনিটের মতো। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড/পার্কিং প্লেস থেকে টাইগার নেস্টে পায়ে ট্র্যাকিং ছাড়াও ঘুরে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। বেজক্যাম্প পর্যন্ত ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া যায়। খরচ পড়বে জনপ্রতি ৬০০ রুপি/ভুটানিজ গুলট্রাম।
শুরুতে সাবিনা ভাবির পরিকল্পনা ছিল মেয়ে আদিবাকে এগিয়ে দিতে যাবেন। কিন্তু আমাদের সবার পাল্লায় পড়ে টিকিট কিনে রওনা হন। প্রথম দুই কিলোমিটার ঘোড়ায় চড়ে যান পার্কিং প্লেস থেকে টাইগার নেস্টের বেজক্যাম্প পর্যন্ত। আর বাকি পথটুকু আমাদের উৎসাহেই সামনে এগুতে থাকেন। পরিকল্পনা ছিল শুরুতে কোনো শেডে আমাদের জন্য তিনি অপেক্ষায় থাকবেন। ফিরতি পথে আমরা তাকে নিয়ে ফিরবো। একটু একটু করে আমাদের সঙ্গে তিনি পাহাড়ি পথে চলতে শুরু করেন। ৯ সদস্যের টাইগার নেস্ট অভিযাত্রীর মধ্যে আমি, সূর্য এবং সাবিনা ভাবির অবস্থান সবার পেছনে। হাঁটুতে ব্যথা থাকায় তিনি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা এড়িয়ে চলেন। অথচ কোনো এক অদৃশ্য টানে ১৩০০ সিঁড়ি আর আট ঘণ্টার আসা যাওয়ার পথ অতিক্রম করে ১৭০০ ফুট উচ্চতায় টাইগার্স নেস্টে পৌঁছে যান। ভাবির ভাবনার অতীত, এই সাফল্যে দলের আমরা সবাই যারপরনাই আনন্দিত। সাবিনা ভাবির টাইগার্স নেস্ট বিজয় যেন আমাদের কাছে তেনজিং হিলারীর এভারেস্ট বিজয়ের মতো। তিনি বলছিলেন, কষ্ট হয়েছে আসতে, কিন্তু অনুভূতি সেই রকম, তিনি নিজেই বিস্মিত। না আসলে কখনো তিনি বুঝতে পারতেন না। বার বার বলছিলেন, ‘এ অনুভূতি বোঝানো যাবে না।’ তিনি মন্দিরের চাতালে বসে নফল নামাজের মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করেন। মায়ের সাফল্যে আদিবাও অসম্ভব খুশি। শুধু সবার আফসোস হয়েছিল আমাদের প্রিয় কামরুল ভাইয়ের জন্য। স্ত্রী-কন্যার সাফল্যেও সাক্ষী হতে পারলেন না বলে। ঝুলন্ত তাকসান মনাস্ট্রি ও সাবিনা ভাবির আত্মবিশ্বাস দেখে সত্যিই সবাই বিস্মিত। প্রায় ৩৫০ বছর পূর্বে ১৭০০ ফুট উচ্চতায় পাথরের তৈরি ঝুলন্ত টাইগার্স নেস্ট থেকে নিচের অতিক্রান্ত পথ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম- কীভাবে এত ওপরে এই পাথরের মন্দির তৈরি করা সম্ভব হলো। মনে মনে এক রকমের ভয়েরও উদ্রেক হয়েছিল এটা ভেবে- কারুকার্যময় ঝুলন্ত মনাস্ট্রিটি যে কোনো সময় পাহাড়ের গা থেকে খুলে যেতে পারে। চারপাশের প্রকৃতিকেও বিমুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম। অবশেষে মনাস্ট্রির প্রসাদ (দুধ মেশানো) খই খেয়ে ফটোসেশন শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালাম। সত্যিই শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতির মধ্যে এই ঝুলন্ত তাকসান মনাস্ট্রি অন্যরকমের বিস্ময় উদ্রেক করে। এক ধরনের টানও কাজ করে খুব ভেতরে। কেবলই মনে হয় আবার আসতে হবে ‘ভূ-উত্থান’- ভুটানের নির্জন নিস্তব্ধ এই প্রকৃতির মাঝে নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্য।
ভ্রমণের প্রস্তুতি: সড়ক পথে ভুটান যেতে হলে আপনাকে প্রথমেই ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে- ভিসার মেয়াদ কিন্তু ১৪ দিন। অর্থাৎ ভুটান যাওয়ার কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ দিন আগে আপনাকে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের বেজমেন্ট ফ্লোরে ভারতীয় ভিসা সেন্টারে আবেদন করতে হবে।
ভিসা জমা দিতে যা লাগবে-
* অনলাইনে ফরম পূরণ করে তার প্রিন্ট কপি। ভিসা ফরম পূরণের সময় ভিসা টাইপ ট্রানজিট ও পোর্ট দেবেন বাই রোড চ্যাংড়াবান্ধা/জয়গাঁ।
* সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডযুক্ত দুই ইঞ্চি বাই দুই ইঞ্চি ছবি ফরমের সঙ্গে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিতে হবে।
* ন্যাশনাল আইডি বা জন্মসনদের ফটোকপি।
* বর্তমান ঠিকানার সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ বা গ্যাস বিলের শেষ ৬ মাসের কপি।
* চাকরিজীবীদের এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট), ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স ও শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ডের ফটোকপি।
* ডলার এন্ড্রোসমেন্টের (২০০ ডলার) কপি অথবা ব্যাংক স্টেটমেন্টের (১৫ হাজার টাকা থাকতে হবে) কপি।
* বর্তমানে ভুটানে হোটেল রিজার্ভেশনের কাগজও দেখতে চায় ভারতীয় হাইকমিশন। তাই ভুটানে যে হোটেল বুকিং দিয়েছেন, তার কাগজও জমা দিতে হবে।
* পাসপোর্ট ও পাসপোর্টের ফটোকপি (পাসপোর্টের মেয়াদ সর্বনিম্ন ছয় মাস থাকতে হবে)। আগে ইন্ডিয়ান ভিসা থাকলে সেটারও ফটোকপি লাগবে। পুরাতন পাসপোর্ট থাকলে সেটাও জমা দিতে হবে।
* বাসের টিকিটের ফটোকপিও জমা দিতে হবে অরজিনাল কপির সঙ্গে। এজন্য ভ্রমণ তারিখ ও হাইকমিশনে ভিসার আবেদন জমা দেয়ার তারিখের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ দিন গ্যাপ রাখবেন। কারণ, আবেদন জমা দেয়ার ৮ থেকে ১০ দিন পর ভিসা দেয়া হয়।
কীভাবে যাবেন: ট্রানজিট ভিসা নিয়ে সোজা চলে যাবেন বুড়িমারী বর্ডারে। ঢাকা থেকে শ্যামলী, এসআর, মানিক আর নাবিলসহ বেশ কয়েকটি বাস ছাড়ে। রাত ৮ টার মধ্যে এসব বাস ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়। পরদিন সকালে অর্থাৎ ভোরে পৌঁছে যাবেন বুড়িমারী। মনে রাখবেন, বাংলাদেশের এপাশের নাম বুড়িমারী আর ভারতের ওপাশের নাম চ্যাংড়াবান্ধা। আর বর্ডার খোলা হয় বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টায়। বাংলাদেশের ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে চ্যাংড়াবান্ধা যেতে হবে। সেখানেও রয়েছে বেশকিছু ফর্মালিটি।
চ্যাংড়াবান্ধা থেকে আপনাকে যেতে হবে জয়গাঁ বর্ডার। চাইলে ট্যাক্সি অথবা বাসে যেতে পারেন। জয়গাঁ থেকে ভারতীয় ইমিগ্রেশন পয়েন্টে যেতে হবে। সেখানে ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে হেঁটেই ঢুকতে হবে ভুটান। এটাই ভুটানের প্রবেশ পথ। জয়গাঁয়ের ওপারেই ফুন্টসলিং। এখানেই আপনাকে অন অ্যারাইভাল ভিসা দেবে ভুটান।