লেখক: ড. মো. আতাউর রহমান (উপ-পরিচালক কাম কিপার, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর)
একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। তাই জাতীয় স্বার্থে হলেও জরুরি ভিত্তিতে এ সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তথা বিলুপ্তপ্রায় জাতিসত্তাগুলোকে রক্ষা করা খুবই জরুরি।
আর এই জাতিসত্তাগুলোকে যথাযথভাবে রক্ষা ও সঠিকভাবে তাদের পরিচিতি ও জীবনব্যবস্থা উপস্থাপন করতে পারলে একদিকে যেমন দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি তুলে ধরা সহজ হবে, অন্যদিকে এর মাধ্যমে পর্যটন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংরক্ষিত নিদর্শনাদির সংক্ষিপ্ত পরিচিতির আগে চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এই প্রবন্ধে তুলে ধরা হলো।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর (Ethnological Museum) চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদে অবস্থিত। এটি দেশের একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনপ্রণালী এবং পারষ্পরিক বোঝাপড়া ও অনুভূতি লালনের জন্য এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের উপজাতি গোষ্ঠীর ইতিহাস সমন্বিত উপকরণের প্রদর্শন করা হয়েছে।
এশিয়া মহাদেশের দুইটি জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের মধ্য চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর অন্যতম, অন্যটি রয়েছে জাপানে। এটি গবেষণাকাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ২০২২ সালের হিসাবে, জাদুঘর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন দেশি-বিদেশি গবেষকসহ ৩০০-৫০০ জন দর্শনার্থী এই জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার বাদামতলী মোড়সংলগ্ন ১.২৫ একর জায়গার ওপর ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকে, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে জাদুঘরটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি সর্বসাধারণের জন্য জাদুঘরটি উন্মুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে জাদুঘরে আরও দুইটি কক্ষ অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়রি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী জাদুঘরটির উদ্বোধন করেন।
একতলা বিশিষ্ট দক্ষিণমুখী জাদুঘরটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। এখানে রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় হলঘরসহ পাঁচটি গ্যালারি এবং ১১টি বড় পরিসরের কক্ষ। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি গ্যালারিতে তিনটি করে কক্ষ নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও শুধুমাত্র পশ্চিমের দুইটি গ্যালারিতে দুইটি করে কক্ষ নির্মিত হয়েছে। ফলে বর্তমানে জাদুঘরে মোট প্রদর্শনী কক্ষের সংখ্যা ১১টি।
গ্যালারি-১
এই গ্যালারিতে প্রবেশের পূর্বে জাদুঘরের প্রবেশকক্ষ বা স্বাগতকক্ষ রয়েছে; এটির বামপাশের হ্যাংগিং ওয়ালে রয়েছে মানবজাতির মূল চারটি ধারার প্রোট্রেট (নিগ্রোয়েড, মঙ্গোলয়েড, ককেশাস ও অস্টোলয়েড)। সেই সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে।
প্রবেশকক্ষের ঠিক ডানদিকে হ্যাংগিং ওয়ালে রয়েছে পৃথিবীর তথা বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাসের অবস্থান সম্বলিত মানচিত্র; এটি প্লাস্টার অব প্যারিসে তৈরি করা। প্রবেশকক্ষের দুইটি নিদর্শনই দুর্লভ প্রকৃতির।
এই গ্যালারির মূল রুমের প্রথমেই রয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসিম উদ্দিন, নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, একেএম ফজলুল হক, ভাসানী প্রমুখের ছবিসহ বাংলাদেশের মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রের রেপ্লিকা। দ্বিতীয় কক্ষে রয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের নৃগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থা সম্পর্কিত বিভিন্ন মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের নিদর্শনের রেপ্লিকা।
উল্লেখ্য, এই ঐতিহাসিক নৃতাত্ত্বিক জাদুঘরটি প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান আমলে নির্মিত হওয়ায় পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কিত নিদর্শন সম্বলিত রেপ্লিকা এখানে প্রদর্শিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশ সরকারের উদার নৈতিকতার কারণে তা আন্তর্জাতিক গ্যালারি হিসেবে ওই নিদর্শনগুলো এখনও প্রদর্শিত হয়ে আসছে।
এই আন্তর্জাতিক গ্যালারিতে পাকিস্তান আমলে সংরক্ষিত নিদর্শনাদি ছাড়াও ভারত, রাশিয়া ও জার্মানির প্রাচীরের অনেকগুলো নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে।
গ্যালারি-২
প্রকৃতপক্ষে এই গ্যালারির প্রথম কক্ষ থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থা সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের নিদর্শনের রেপ্লিকা প্রদর্শিত হচ্ছে। এই কক্ষে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থা সম্পর্কিত নিদর্শন সম্বলিত বিভিন্ন ধরনের রেপ্লিকা প্রদর্শন করা হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো, হাজং, কোচ, হদি, দালুই, মান্দাই; উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীর সাঁওতাল, মুন্ডা, রাজবংশী; দিনাজপুরের সাঁওতাল, পুলিয়া, ওঁরাও এবং রাজবংশী ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শনের রেপ্লিকা ও ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গ্যালারির দ্বিতীয় কক্ষে বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল তথা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মনিপুরী সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শনের রেপ্লিকা ও ছবি প্রদর্শন করা হয়। বিশেষ করে সিলেটের মনিপুরী নৃত্য পরিবেশনের পোশাকের ধরন ও মৌলভীবাজারের মুসলিম মনিপুরী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাসের ছবিগুলো দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও বিস্মিত করে।
এক কথায় এই কক্ষে রয়েছে সিলেটের মনিপুরী, খাসিয়া, বোনা, পাত্র ও পাঙ্গণ ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শনের রেপ্লিকা ও ছবি।
গ্যালারি-৩
এখানে বান্দরবান অঞ্চলের মুরুং, চাক, বম, খ্যাং ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থা সম্পর্কিত নিদর্শন উপস্থাপন করা হয়েছে। এই গ্যালারির দ্বিতীয় কক্ষে রয়েছে বান্দরবান অঞ্চলের ত্রিপুরা, খুমি, বম, চাক; রাঙামাটি অঞ্চলের পাঙ্খোয়া, তংচঙ্গা, খ্যাং; নেত্রকোনা অঞ্চলের হাজং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শনের রেপ্লিকা ও ছবি। এ সব জাতির ঐতিহ্যবাহী পোশাক, মৎস্য ও পশুপাখি শিকারের বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, জুম চাষের ওপর ডিওরোমা, পার্বত্য দুর্গমগিরি পথে চলাচলের একমাত্র বাহন হিসেবে একখ- জোড়বিহীন কাঠের তৈরি নৌকা ইত্যাদি নিদর্শন এই গ্যালারির ৭ ও ৮ নাম্বার কক্ষে রয়েছে।
গ্যালারি-৪
এখানে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জাতিতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমা ও মারমা জাতির গৌরবময় জীবনব্যবস্থা সম্পর্কিত নিদর্শন। এর মধ্যে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাকমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কাছ থেকে সংগৃহীত পিতলের তৈরি অনেক ছোট-বড় মহামতি গৌতম বুদ্ধের মূর্তির রেপ্লিকা, চাকমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ, শিকার ধরার বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র। এছাড়া চাষের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের আদি যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন ধরনের শিকারি প্রাণির মমি। এই গ্যালারির ৮নং কক্ষে রয়েছে বান্দরবান অঞ্চলের চাকমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ব্যতিক্রমী এক কাঠের তৈরি বিস্ময়কর নৌকা। প্রথম কক্ষে বান্দরবান অঞ্চলের মারমা, লুসাই এবং কক্সবাজারের মহেশখালীর রাখাইন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শনের রেপ্লিকা ও ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় কক্ষে রাঙামাটির তংচঙ্গা, বান্দরবান অঞ্চলের মারমা; তৃতীয় কক্ষে রাঙামাটির চাকমা, বান্দরবান অঞ্চলের মারমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শনের রেপ্লিকা ও ছবি প্রদর্শন করা হয়।
কেন্দ্রীয় গ্যালারি
১১ কক্ষের ঐতিহাসিক এই জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের মাঝখানে একটি বিশাল আকৃতির বর্গাকার হলঘর রয়েছে। এটির ছাদের উচ্চতা ২৫ ফুট। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের অলংকার। এক কথায় এই কক্ষে রয়েছে সিলেটের মনিপুরী, খাসিয়া, বোনা, পাত্র ও পাঙ্গণ ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবন ও বিভিন্ন উৎসবে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের অলংকার।
সংক্ষিপ্ত পরিসরে এতগুলো জাতির গৌরবময় ইতিহাস ও তাদের জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তারপরও এই প্রবন্ধে বাংলাদেশ, এশিয়া তথা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বা পরিচিতি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
এই প্রবন্ধে বাংলাদেশ ছাড়াও আরও পাঁচ থেকে ছয়টি দেশের নৃগোষ্ঠীর জীবনব্যবস্থা উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে; যাতে জাতিতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কাজে নৃতাত্ত্বিক বা নৃবিজ্ঞানীদের সুবিধা হয়। এই জাদুঘরটিতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংগৃহীত সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলোকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা গেলে একদিকে যেমন সংস্কৃতিবান্ধব সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (ঝউএ) বাস্তবায়ন সহজতর হবে এবং রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।