বাংলাদেশ লেখা প্ল্যাকার্ডের নিচেই মিলল আনুষঙ্গিক কাগজপত্র। সবকিছু নিয়ে বসলাম পেছনের সারিতে। পিনপতন নিরবতার মধ্যেই চলছিল আলোচনা। দেরিতে আসায় আলোচকের নামটা জানতে পারিনি। তবে পরিবেশ, প্রযুক্তি ও কর্মক্ষেত্রে তার প্রয়োগ নিয়ে চমৎকার বলছিলেন। এবং এই তিনটি বিষয়ের আন্তঃসংযোগগুলোও দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। এরপর চা-বিরতি। শুধু চা বলাটা মনে হয় ভুল হবে। কারণ চায়ের সঙ্গে টা’র আয়োজনটাও জম্পেশ। সবাই ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে তুমুল গল্পে মেতে উঠল। অথচ আমি কাউকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অগত্যা তথ্যকেন্দ্রের সহযোগিতা চাইলাম। ওরা খুঁজে বের করল জাপান থেকে আসা লুকাস লিমকে। প্রথম পরিচয়েই মনে হলো লুকাস দারুণ প্রাণবন্ত। বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশের বেশি নয়। অনেক বেশি এনার্জেটিক এবং হাসিখুশি। বাকি সেশনগুলো লুকাসের সঙ্গেই বসলাম। কয়েকটি দেশের মন্ত্রীবর্গও এসেছেন এই কর্মশালায়। একেবারে দুপুর গড়িয়ে দুপুরের খাবার শেষ হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিশরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিচয় হলো। লুকাস হলেন এই যোগাযোগের মূল অনুঘটক।
বিকালে মধ্যেই আসর ভাঙল। আমরা পাঁচজন জড়ো হলাম এক কোণায়। তারপর বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। লুকাস আমাদের অঘোষিত দলপতি বনে গেল। কারণ এখানে সে আরেকবার এসেছিল, সেই সুবাদে পথঘাট ভালোই চেনে। ওয়াশিংটন ডিসি এসে হোয়াইট হাউস দেখব না তাতো হয় না! সুতরাং সবকিছুর আগে হোয়াইট হাউস। আমরা যখন গিয়েছি তখন ভিজিটিং আওয়ার চলছিল। মানে সীমানা প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা যাবে। এই সুযোগটা সবাই কাজে লাগালো। গ্রুপ ছবি, একক ছবি আবার বিখ্যাত সাদা বাড়িটির ছবি; রাশি রাশি ছবি তুলল সবাই। ছবি তোলা শেষ হলে আমরা একটা ছোট্ট পার্কের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। বেশ সাজানো গোছানো পার্ক। ম্যাগনোলিয়ার অনেকগুলো গাছ, বেশ বড়সড়। আমাদের দেশে ম্যাগনোলিয়ার এত বড়ো গাছ দেখা যায় না। তবে ভিন্ন প্রজাতিও হতে পারে। গাছে কোনো ফুল নেই, শুধু কতগুলো শুকনো ফল ঝুলে আছে।
লুকাসকে বললাম আমার একটা সিমকার্ড কিনতে হবে। কোথাও যোগাযোগ করতে পারছি না। আজকাল মোবাইল ফোন ছাড়া অন্ধের পথচলার মতো অবস্থা। লুকাস বলল এ আর এমন কি, চলো কিনে দিচ্ছি। আমরা গেলাম ‘ঞ’ মোবাইলের একটি বিক্রয় কেন্দ্রে। আইডি হিসেবে আমার পাসপোর্ট দেখিয়ে এক বছর মেয়াদী একটি সিমকার্ড কেনা হলো। পরে বুঝেছি অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর! লুকাস স্বল্পজ্ঞানে আমাকে যে সিমকার্ডটি কিনে দিয়েছিল তা ছিল শাখের করাত। ফোন আসলেও বিল কাটে, গেলেও কাটে! কেউ ফোন করে যদি লম্বা কথা শুরু করে তাহলে আর রক্ষা নেই। অথচ কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারি না এই দানবীয় সিমকার্ডের কথা। সব কিছু নিরবেই হজম করতে হলো! যাহোক, আমরা আরও কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে স্টারবাকসের একটি কফি সোপে ঢুকলাম। আমেরিকার বিখ্যাত ব্র্যান্ড স্টারবাকস কফি। আমাদের প্রচুর এনার্জি দরকার। হিসাব মতো বাংলাদেশে তখন রাত। অন্যান্য এশীয়দেরও প্রায় একই রকম সময়। আমাদের সবাইকে ঘুম তাড়া করে ফিরছে। চারপাশে কফির তীব্র পোড়াঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। কফি কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাদের চাঙ্গা করে দিল।
সন্ধ্যার দিকে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমাকে যেতে হবে অনেক দূর। প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট্ট শহর সেন হোজেতে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্ট চলে গেলাম। ওয়াশিংটন ডিসির অভ্যন্তরীণ বহির্গমনে গিয়ে প্রথম স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির ধাক্কাটা খেলাম। যার যার বোর্ডিং পাস স্বয়ংক্রিয় মেশিন থেকে নিজেকেই করে নিতে হয়। আগে কখনো কাজটি করিনি। কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। সহযোগিতার জন্য আশপাশে কাউকে খুঁজে পেলাম না। শুধু আমিই নয়, এমন সমস্যায় অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও পড়েছেন। একটা আলাদা লাইনে দাঁড়াতে হলো আমাদের। একজন একজন করে ডেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। কিছুক্ষণ পর আমার ডাক পড়ল। আমার টিকিট দেখে বলল, তোমার টিকিট কনফার্ম করা নেই। ওদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম ই-টিকিট কনফার্ম করাই থাকে। একটু ভালোভাবে ঘেঁটেঘুটে দেখ। এত কথা শোনার সময় ওদের নেই। বলল তুমি যদি এখন যেতে চাও তাহলে তোমাকে অতিরিক্ত ৭০ ডলার পে করতে হবে। আর না হয় কালকে যেতে হবে। আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম। আগামীকাল একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমি সেখানে যাচ্ছি। আজ না গিয়ে কাল যাওয়া না যাওয়া সমান কথা। মনে মনে ঢাকাস্থ ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সকে অভিসম্পাত দিয়ে পেমেন্টের জন্য কার্ডটা বাড়িয়ে দিলাম। কারণ অভ্যন্তরীণ কানেক্টিং ফ্লাইটটা ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের সঙ্গেই করা ছিল। এত দীর্ঘ একটি ফ্লাইট কোনো খাবারদাবার ছাড়াই। অভ্যন্তরীণ সব ফ্লাইটে ক্যাটারিং সার্ভিস নেই বললেই চলে। কিছু খেলে কিনে খেতে হবে। ওয়াশিংটন থেকে সেন হোজে যেতে ঢাকা থেকে সরাসরি কোনো ফ্লাইট পাওয়া গেল না। কলোরাডো রাজ্যের ডেনভার শহরে ছোট্ট একটা ট্রানজিট নিতে হবে।
ডেনভার থেকে যে এয়ারবাসে উঠলাম সেটি একেবারেই ছোটো। আকাশ পথের প্রায় সারারাত নির্ঘুম কাটল। সেন হোজে পৌঁছাতে প্রায় ভোর হয়ে গেল। ব্যাগেজপত্র বুঝে নিয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ে সরাসরি হোটেলে চলে গেলাম। হোটেল আগেই বুকিং করা ছিল। সেন হোজে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের বিখ্যাত একটি শহর। রাজ্যের ভৌগলিক অবস্থানটা একেবারে প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে। ক্যালিফোর্নিয়া এমনিতেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। এখানে দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো হচ্ছে লস এঞ্জেলস, ব্রেভারলি হিলস, ব্রিসবেন, ক্যানিয়ন লেক, ম্যানহাটন বিচ, ক্যালিফোর্নিয়া সিটি, শান্তা বারবারা, ওয়েস্ট মিনিস্টার ইত্যাদি।
হোটেলে বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ নেই। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। আদনান আরেফিন এলেন ঠিক আটটায়। তিনিই আমাকে অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবেন। এটা আসলে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব একটি অনুষ্ঠান। আমার সেখানে তেমন কোনো ভূমিকা নেই। স্থানীয় কয়েকজন বন্ধু-সুহৃদের আমন্ত্রণেই এখানে আসা। আদনান বললেন- এখানে নাস্তা করার কোনো দরকার নেই। তা ছাড়া খেয়ে মজাও পাবেন না খুব একটা। চলুন পাশেই ইন্ডিয়ান একটা রেস্টুরেন্ট আছে। গাড়ি ছুটে চলছে। খুব ছিমছাম পরিপাটি শহর। গাছের পাতাগুলো বিচিত্র রঙ ধারণ করেছে। যেন একেকটি বিশাল পুষ্পস্তবক। সেন হোজের আবহাওয়া বেশ ভালো। সকালেই মন ভালো করার মতো ঝলমলে রোদ উঠেছে। এই শহরটি তথ্য প্রযুক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক খ্যাতনামা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এখানেই। খেয়াল করে দেখলাম ভারতীয়রা সংখ্যায় একটু বেশি। এখানকার আইটি সেক্টরে ওদের প্রাধান্য লক্ষ্য করার মতো। সেটা অবশ্যই কর্মগুণে।
ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় সভায় উপস্থিতি স্বল্প। সবাই যার যার কাজের ক্ষেত্রে সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কথা বললেন। আলোচনায় প্রাধান্য পেল আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা এবং উত্তরণের উপায়। এখানে এ ধরনের আয়োজন প্রায়শই হয়ে থাকে। দুপুরের মধ্যে আলোচনা শেষ হলো। আগেই আমাদের জন্য একটা লিমুজিন ভাড়া করা ছিল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বিকালে আরেকটি সেমিনার। তার আগেই আমরা গেলাম স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। এত কাছে এসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরম ক্যাম্পাসটি না দেখার কোনো মানে হয় না। সত্যিই মনোমুগ্ধকর। ভবনগুলো সব একই রঙের। বিশাল সবুজ ঘাসের মাঠ, গাছগুলো বেশ পরিকল্পিতভাবে লাগানো। মাঠের শেষ প্রান্তে বিকালের বিষণ্ন রোদ পড়েছে। বেশ নিরিবিলি ক্যাম্পাস। সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আরও কিছুক্ষণ ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সময় খুবই নির্মম।
রাতে ডিনার পার্টিতে নিমন্ত্রণ। অতি প্রাচীন একটি বাড়িতে আয়োজন। বিশাল বিশাল ঘরদোর। পুরোনো আমলের আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। ঘরের এককোণে গানের আয়োজন। মাঝে মাঝে কেউ কেউ কৌতুকও বলছে। সবকিছু মিলিয়ে বেশ সরগরম অনুষ্ঠান। পাশের কক্ষে খাবার সাজানো আছে। যার যার পছন্দ মতো খাবার তুলে নিয়ে খাচ্ছে। আমার দুচোখে রাজ্যের ঘুম নামতে চাইছে। বলতে গেলে আমেরিকার এই কয়েকটি রাত-দিন নির্ঘুমই কেটে যাচ্ছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেশ রাত করে হোটেলে ফিরলাম। আগামীকাল সকালে আবার নিউইয়র্ক যাত্রা। সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে। খুব ভোরে হোটেলের ইলেকট্রিক এলার্মের তীব্র চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু করিডোরে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। একটু পর আপনা আপনিই থেমে গেল শব্দ।
সময় স্বল্পতার কারণে এখানকার ঘনিষ্ঠ কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো না। এখানে সবাই ব্যস্ত। কাউকে ফোন করতেও সঙ্কোচ হয়। কারণ আমেরিকায় কাজের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। কেউ সারারাত কাজ করে দিনে ঘুমায়। কেউ দুপুরে কাজে গিয়ে অনেক রাতে ফিরে। আবার কেউ কেউ ভোর রাতে বেরিয়ে যায়। তাহলে কোন সময় ফোন করলে কাকে পাওয়া যাবে সেটা বোঝা মুশকিল। তবে কারো আন্তরিকতার কমতি নেই। এটাই বাস্তবতা! আমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্মম হয়ে উঠল সময়। দ্রুত ফিরতে হবে নিউইয়র্ক। এতটা দূরে এসেও অনেক সৌন্দর্য উপভোগ না করার অতৃপ্তি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সান্ত¡না এটাই যে একবার যখন এসেছি তখন আরেকবার আসার সুযোগটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট হওয়ায় একঘণ্টা আগে এয়ারপোর্ট গেলাম। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জানতে পারলাম ফ্লাইট দেরিতে ছাড়বে, তবে কতটা দেরিতে সেটা স্পষ্ট নয়। এই সুযোগে সকালের নাস্তাটা সেরে ফেলা যায়। একেবারে রানওয়ের পাশঘেঁষা একটি ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। কফি আর ব্রেড নিলাম। বেশ আয়েশ করে খেলাম। তারপর রানওয়ের দৃশ্য দেখে খানিকটা সময় কাটল। তবে খুবই বিরক্তিকর সময়। ল্যাপটপটাও চার্জের অভাবে বিকল হয়ে আছে। সেন হোজে থেকে ফ্লাইট ছাড়ল এক ঘণ্টা দেরিতে। এবার আমেরিকান এয়ারলাইন্স। ট্রানজিট লস এঞ্জেলসে। ঝড়ের গতিতে কাক্সিক্ষত টার্মিনালে এসে দেখি আমার ফ্লাইট নিউইয়র্কের পথে এক ঘণ্টার দূরতে! গেটম্যান নির্বিকার। হায় কপাল! উপরে উঠে এয়ারলাইন্সের কাউন্টার খুঁজে বের করলাম। কাউন্টারের নারীকে টিকিটটা প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম দোষটা কি তোমাদের না আমার? সেন হোজে থেকে ফ্লাইট ছাড়ল এক ঘণ্টা দেরিতে, তার খেসারত দিতে হবে আমাকে? কর্তব্যরত নারী সরি, প্লিজ ইত্যাদি বলে বেশ দুঃখিত হবার ভঙ্গি করল। তারপর বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার টিকিটটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। যেন এই জীবনে বস্তুটা সে প্রথম দেখেছে। এটাই পেশাদরিত্ব। প্রায় প্রতিদিনই সম্ভবত এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ওদের। আমাকে নিশ্চুপ দেখে মহিলা এবার মুখ খুললেন। হাসি হাসি মুখে বললেন, আমি দুঃখিত। তোমার নেক্সট ফ্লাইট আট ঘণ্টা পর। তোমাকে আমরা বেশ কয়েকটা খাবার কুপন দিয়ে দিচ্ছি, আমাদের নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে খেতে পারবে বলে আমাকে কয়েকটা খাবার কুপন ধরিয়ে দিল। এখন আর সত্যি সত্যি কিছু করার নেই। মনে মনে বললাম তা না হয় মানলাম, তোমরা খাবারের ব্যবস্থা করেছ কিন্তু দুর্বিসহ ৮ ঘণ্টার কি হবে!
কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এলাম। সুবিশাল এয়ারপোর্টের এ মাথা ও মাথা একবার হাঁটলাম। চার্জিং পয়েন্ট খুঁজে বের করে ল্যাপটপটা চার্জ দিয়ে খুলে বসলাম। অন্তত দুএক ঘণ্টা ভালোই কাটবে।
নিউইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে মালপত্র বুঝে নিয়ে বের হতে হতে সকাল প্রায় নয়টা বাজল। হিসাব করে দেখলাম একেবারে পাক্কা চব্বিশ ঘণ্টার জার্নি। আমেরিকার ভেতরেই এত দীর্ঘ জার্নি। একেবারে পশ্চিম থেকে পুবপ্রান্তে। প্রশান্ত মহাসাগরের পাড় থেকে আটলান্টিকের পাড়ে। রোমান মামা আমার জন্য এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। তখন আমেরিকায় সামারের শেষ মুহূর্ত। ঠান্ডা মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে। দ্রুত গিয়ে গাড়িতে বসলাম। মামা ফল খেতে দিলেন। দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণের খবরটা তিনিও জানতেন।
গাড়ি ছুটছে ব্রুকলিনের দিকে। মামা থাকেন ব্রুকলিনের ওশান পার্কওয়েতে। পথের দুপাশেই পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো। ধীরে ধীরে পাতার রং বদলে যাচ্ছে। বাসায় ঢোকার পথে একটা দেওদার গাছ চোখে পড়ল। কঠিন তুষারপাতেও ওরা সজীব। আমাদের হিজল যেমন ঝড়-জলেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। বাসায় পৌঁছাবার পর আপাতত স্বস্তি। আগেই জেনেছি এই বাসাটা ব্যাচেলরদের স্বর্গরাজ্য। পুরো অ্যাপার্টমেন্টে সব ব্যাচেলরদের আড্ডাখানা। সে কারণেই এখানে উঠেছি। কোনো খবরদারি নেই। স্বাধীনতা অফুরান। রোমান আত্মীয়তার সূত্রে আমার মামা হওয়ায় রোমানের সব বন্ধু রাতারাতি আমার মামা হয়ে গেল, আবার আমিও তাদের মামা। সবাই বলল শাওয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুমানো যাবে না। তাহলে প্রতিদিনই দিনের বেলা ঘুম আসবে। এ দিকে আবার শ্যামল মামার (রোমানের বন্ধু) বিয়ে। বর-কনে একই অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা। সুতরাং চারপাশে উৎসব উৎসব আমেজ। আসতে না আসতেই বিয়ের দাওয়াত। মন্দ না!
বিকাল থেকেই ঘোরাঘুরি শুরু। বাংলাদেশ থেকে কেউ নিউইয়র্ক বেড়াতে গেলে তার জন্য দর্শনীয় স্থানের যে তালিকা নির্ধারণ করা হয় তার মধ্যে অবশ্যই টাইম স্কয়ার এবং স্ট্যাচু অব লিবার্টি থাকবে। বাংলাদেশে যেমন গ্রাম থেকে কেউ ঢাকায় বেড়াতে গেলে চিড়িয়াখানা এবং জাদুঘর অবশ্যই দর্শনীয় হয়ে ওঠে, ঠিক সেরকম। নিউইয়র্কে আমার ক্ষেত্রেও এর বত্যয় ঘটল না। আনোয়ার মামা আর আমির হোসেন মামা যথারীতি নিয়ে গেলেন টাইম স্কয়ারে। এই জায়গাটি রাতেই বেশি সুন্দর। সবকিছু অবশ্য রঙিন আলোকসজ্জার কারসাজি। বড় বড় সব বিলবোর্ড। উঁচু দালানগুলোর গায়ে চলছে লেজার লাইট শো। হাজার হাজার পর্যটকের ভিড়। এখান থেকেই আম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের উঁচু চূড়াটা দেখা যাচ্ছিল। তার আগেই গ্রাউন্ড জিরো দেখেছি। নতুন ভবন হয়েছে সেখানে। বাসায় ফেরার পথে আনোয়ার মামা ব্রুকলিন ব্রিজ এবং ম্যানহাটন ব্রিজ সম্পর্কে ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমার কাছে সবকিছুই লাগছিল গোলকধাঁধার মতো। প্রথম প্রথম এমন হওয়াটাই নাকি স্বাভাবিক। পরে অবশ্য পাশাপাশি এই দুটি ব্রিজের অবস্থান ও পার্থক্য সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়েছে।
পরের দিন সেই স্ট্যাচু অব লিবার্টি। এবার সঙ্গী রোমান মামা। ফেরির ঘাট অবধি খানিকটা পাতাল রেল, বাকিটা হেঁটে হেঁটে দেখতে দেখতে। টিকিট কেটে ফেরিতে ওঠার আগে সিকিউরিটি চেক হলো। মনে হলো যেন প্লেনে উঠতে যাচ্ছি। শেষ গ্রীষ্মের রৌদ্রজ্জ্বল দিন। ঠান্ডা নেই বললেই চলে। আমাদের মাথার ওপর কয়েকটা সি-গাল উড়ছে। ফেরির গতিবেগের সঙ্গে ক্রমেই স্ট্যাচু অব লিবার্টি দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অদূরে ভেরাইজনা ব্রিজ। আর হাতের কাছেই হাডসন নদী। গন্তব্যে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। স্ট্যাচু অব লিবার্টি স্থাপন করা হয়েছে ছোট্ট একটা দ্বীপে, নাম লিবার্টি। দ্বীপের এককোণে মূর্তিটি আর বাকিটা পর্যটকদের ঘোরাঘুরির জন্য উন্মুক্ত। মাঝারি আকৃতির গাছপালায় সুসজ্জিত। এক সময় ভেতরের সিঁড়ি পথ দিয়ে মূর্তির ঠিক মাথার কাছে চলে যাওয়া যেত। এখন নিষিদ্ধ। আমরা চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ছবি তুললাম অসংখ্য। এই বিশাল মূর্তিটি ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমেরিকাকে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়।
ফিরে যাবার জন্য আবার ফেরিতে উঠলাম। মাঝপথে একটি সুবিশাল নরওয়েজিয়ান জাহাজ আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। ঠিক জাহাজ নয়, যেন ছোটখাটো একটি গ্রাম ভেসে যাচ্ছে। ওপাড়ে এসে নদীর তীর ধরে হাঁটতে লাগলাম। এই নদীপথও নিউইয়র্কের রাস্তার মতো ব্যস্ত। ছুটে যাচ্ছে অসংখ্য নৌযান। চমৎকার আবহাওয়া। কোনো কোলাহল কিংবা ব্যস্ততা নেই। ধীরে ধীরে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল ব্রুকলিন এবং ম্যানহাটন ব্রিজ। আমরা কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে বসলাম। শীতল বাতাস এসে ঝাপটা দিচ্ছে চোখে মুখে।
মোকারম হোসেন:
লেখক: উদ্ভিদ, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।