লেখকঃ ড. মো. আতাউর রহমান – উপপরিচালক কাম কিপার, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর
‘দেশের অর্থ দেশেই রাখুন, গ্রামীণ প্রত্নপর্যটন বিকাশে এগিয়ে আসুন’। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার এই বাংলাদেশের আমাদের বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রত্ননির্দশন সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জালের মতো, অথচ এর প্রচার বড়ই অভাব লক্ষ্যণীয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তীকালে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল তথা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালে বাংলাদেশে একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
এখন পর্যন্ত সারা দেশে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক ৫২৫টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষিত হয়ে থাকলেও জামালপুর জেলায় কোনো একটিও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষিত পুরাকীর্তি তালিকাভুক্ত হয়নি, যা দুঃখজনকও বটে। আর সেসব অভাব ঘোচানোর উদ্দেশ্যে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সামনে উপস্থাপন করার লক্ষ্যেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। এটি প্রকাশিত হলে একদিকে যেমন প্রত্নপর্যটনের বিকাশ ঘটবে অপরদিকে সরকারের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া স্থানীয় শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ভৌগোলিকভাবে জামালপুর জেলা বাংলাদেশের মধ্যাংশের অঞ্চল। ময়মনসিংহ বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। বিশেষ করে কৃষি পণ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। এ জেলায় গারো, বংশী, হাজং, হদি, কুরমি ও মাল প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
জামালপুর জেলার ঐতিহাসিক কয়েকটি প্রত্নপর্যটন স্থান হলো-
হযরত শাহ জামালের (রহ.) মাজার
জামালপুর জেলা সদরের ব্রহ্মপুত্র নদী তীরে চাপাতলি ঘাটের কাছে বিখ্যাত সাধক পুরুষ শাহ জামালের (রহ.) মাজার শরীফ অবস্থিত। সমাধিক্ষেত্র ছাড়াও পুরোনো একটি সুন্দর মসজিদ আছে। এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয়।
স্থানীয় জনশ্রুতিতে জানা যায়, ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে হযরত শাহ জামাল (রহ.) ধর্ম প্রচারের জন্য অত্র অঞ্চলে আগমন করেন। এই সুফি দরবেশ সুদূর মধ্যপ্রাচ্যর ইয়েমেন থেকে এসে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদীতীরে আস্তানা স্থাপন করেন। হযরত শাহ জামাল একজন পীর কামেল লোক ছিলেন। তার আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও অলৌকিক ক্ষমতার কথা দিল্লির মুঘল দরবার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ওই সময় বাদশা আকবর হযরত শাহ জামালের খানকার ব্যয়ভার বহন করতে ইচ্ছা পোষণ করে এবং সিংহজানির অধীনে কয়েকটি পরগনা পীরপাল দানের সনদ পাঠায়। এই লোভনীয় প্রস্তাব সুফি দরবেশ হযরত শাহ জামাল অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে তার নামেই অত্রাঞ্চলের নামকরণ জামালপুর হয়।
এখানে প্রতিবছর ভক্তবৃন্দ সমবেত হয়ে ওরশ মাহফিল পালন করেন। বর্তমানে আধুনিক নির্মাণ শৈলীতে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত জিয়ারত ও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে মান্নতে শিন্নি দিতে আসে।
প্রত্নপর্যটক তথা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য খুবই আকর্ষণীয় স্থান এই হযরত শাহ জামালের মাজারটি। এটি আরও ইতিহাস সমৃদ্ধ করে সংরক্ষণ ও সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারলে একদিকে দেশের সর্ববৃহৎ মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে একটি আকর্ষণীয় প্রত্নতীর্থ হবে এবং সেই সাথে স্থা নীয় শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
চিকাজানী একগম্বুজ জামে মসজিদ
জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানী ইউনিয়নের ঐতিহাসিক চিকাজানী একগম্বুজ জামে মসজিদটি গায়েবি মসজিদ নামে পরিচিত। আগে এখানে অন্ধকার ভুতুড়ে ছিল। এখন এটি উজ্জ্বল আলোকিত। এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইশতিয়াক হোসেন দিদারের নেতৃত্বে এলাকাবাসী এটিকে উন্নত রূপ দিয়েছেন বলে জানা যায়। এলাকটি খুব সুন্দর। মসজিদটি নির্মাণের সন তারিখ না পাওয়া গেলেও এর নির্মাণশেলী ও অবকাঠামোগত বিচার বিশ্লেষণে সুলতানি আমলের মুসলিম শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন হিসেবে সহজেই অনুমান করা যায়।
এটি শুধু জামালপুর নয়, গোটা ময়মনসিংহ বিভাগের প্রত্নপর্যটনের অন্যতম আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারে নিঃসন্দেহে।
মেলানদহের ঐতিহাসিক তিনগম্বুজ মসজিদ
মেলান্দহ উপজেলার ঐতিহাসিক দুরমুট গ্রামে তিনগম্বুজ জামে মসজিদটি অবস্থিত। এই মসজিদটি প্রায় ১৫০ বছরের প্রাচীন। মসজিদটি বাংলা ১২৭৬ সালে নির্মাণ করেন জামালপুর জেলার বিশিষ্ট দানবীর মাদারগঞ্জের তালুকদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা হাজি ফাজেল মাহমুদ তালুকদার। মসজিদটি নির্মাণের পর ১৩০৪ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই বছরেই আবার তা সংস্কার করা হয়। এতে ব্যয় হয় ৮ হাজার রৌপ্যমুদ্রা।
মসজিদটি নির্মাণশৈলী ছিল ইসলামি স্থাপত্যকলা ফুটে উঠেছে। তিন গম্বুজের পাশাপাশি মসজিদের চার কোণে চারটি সুদৃশ্য মিনার রয়েছে। সেই সময়কার চুন সুরকির গাঁথুনির জন্য ময়মনসিংহের আকুয়া থেকে সুদক্ষ রাজমিস্ত্রি নিয়ে আসা হয়েছিল। গম্বুজের কারুকাজ করার জন্য চীন থেকে সিরামিক টুকরো নিয়ে আসা হয়। গম্বুজের চূড়ায় বসানো হয় পিতলের কলসি।
মসজিদের কার্নিশগুলিতে বর্ণিল স্থাপত্যকলার চিহ্ন রয়েছে। মসজিদের দরজায় রয়েছে বর্ণিল চিত্রকলা। আরবি হরফে লেখা। জানালায় রয়েছে কারুকাজময় নকশা। কয়েকবার সংস্কারের ফলে আগের সৌন্দর্য অনেকাংশে ঢাকা পড়েছে।
হাজি ফাজেল মাহমুদ ১৯১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করলে মসজিদের পাশে তাকে সমাধিত করা হয়। তার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা এই মসজিদটি কয়েকবার সংস্কার করেন।
এই ঐতিহাসিক মসজিদটি বর্তমানে বয়সের ভারে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ছাদ ও কলাম ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে এটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বর্তমানে একটু বৃষ্টি হলেই ছাদ চুয়ে পানি পড়ে। এই প্রাচীন মসজিদটি প্রতœতাত্ত্বিক বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছেন তালুকদার পরিবারসহ এলাকাবাসী।
ঐতিহাসিক হযরত শাহ কামালের মাজার
হযরত শাহ কামালের (র.) মাজার জামালপুর জেলার এক ঐতিহাসিক প্রাচীন ধর্মীয় নিদর্শন। এটি মেলান্দহ উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ তীরে ঐতিহাসিক দুরমুট গ্রামে অবস্থিত। ময়মনসিংহ জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলা সম্পর্কিত ইতিহাস ও লোক সংস্কৃতির বিভিন্ন বই-পুস্তক থেকে জানা যায় যে, হযরত শাহ কামাল (র.) ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে আরবের ইয়েমেন থেকে এই অঞ্চলের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ও পাহাড় বেষ্টিত মনোরম পরিবেশে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তীরে তপোবন স্থাপন করে নিরন্তর ধ্যানমগ্ন থাকেন। আস্তে আস্তে তার অলৌকিক ক্ষমতা ও অধ্যাত্মিক গুণাবলীর কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া স্থানীয় জনশ্রুতি ও লোকসাহিত্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, তার আধ্যাত্মিকতায় মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় হিন্দু রাজা বারইয়ের কন্যা হযরত শাহ কামালের (র.) সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এখন সেখানে বারইকান্দি গ্রাম ও বারোই বিবির মাজার বিদ্যমান। তখন থেকেই অত্র অঞ্চলের রাজা-জমিদার এবং পরবর্তীতে মোগল সম্রাটগণ তাদের সম্মানে বেশ কিছু এলাকা লাখেরাজ করে দেয়।
পরবর্তী সময়ে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোকগমন করেন। অতঃপর সেখানে ভক্তদের দ্বারা মসজিদ, মাজার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেখানে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে হযরত শাহ কামালের (রহ.) স্মরণে বিরাট ইসলামি জলসার বা আলোচনার আয়োজন করা হয়ে থাকে; যেখানে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত আশেকানগণ জমায়েত হয়ে থাকেন। এটি ধর্মীয় প্রতœপর্যটন হিসেবে অনন্য নিদর্শন।
ঐতিহ্যবাহী বড় মসজিদ
জেলা সদর জামালপুর শহরের মাঝখানে ঐতিহাসিক এই বড় মসজিদটি অবস্থিত। সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে ইংরেজ আমলে কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এটি নির্মাণ করেন। ওই সময় জামালপুরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি সেনানিবাস ছিল; সেখানে রুটি সরবরাহকারী ছিলেন ‘মহাম্মদ নন্দ’ রুটিওয়ালা, তিনিই পাকা মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই মসজিদটি পাকা মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। তিনি মসজিদটি রং, সুন্দর ও স্বচ্ছলভাবে পরিচালনার জন্য বেশ কিছু সম্পত্তিও দান করে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। মসজিদের শিলালিপি থাকলেও ১৩০৪ সনের ভূমিকম্পের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা হারিয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে এখানে বড় আকারের আধুনিক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। যেটা স্থানীয় ব্যবসায়ী ধর্মপ্রাণ মুসলমান নান্নু মিয়ার উদ্যোগে ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় চুনসুরকির তিনগম্বুজ বিশিষ্ট একটি বড় আকারের মসজিদ নির্মিত হয়। সেই থেকে এই ঐতিহাসিক মসজিদটির নামকরণ হয়ে যায় বড় মসজিদ। পরবর্তী সময়ে মসজিদ কমিটি মুসল্লিদের স্থান সংকুলানের অভাবে বছর দশেক আগে পুরোনো মসজিদটি ভেঙে তিনতলা বিশিষ্ট নতুন মসজিদ তৈরি করেছে। তবুও ঐতিহাসিক বড় মসজিদটি দেখতে ও নামাজ আদায় করতে হাজারো মুসলিম পর্যটকদের ভিড় দেখা যায়।
ঐতিহ্যবাহী দয়াময় মন্দির
জামালপুর জেলা শহরের জিরো পয়েন্টে অবস্থিত দয়াময়ী মন্দির। ঐতিহ্যবাহী এই মন্দির সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছু দালিলিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে স্থানীয়ভাবে যে গল্প বা মুখে মুখে ইতিহাস প্রচলিত আছে তা হলো, ‘১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে জামালপুর জেলা শহরের জিরো পয়েন্টে প্রায় ৬৫ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত হয় ঐতিহ্যবাহী দয়াময়ী মন্দির। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে শ্রীকৃষ্ণ রায় চৌধুরী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি প্রায় ৩২১ বছরের পুরোনো মন্দির।
এই মন্দিরে প্রতিদিনই বিভিন্ন পূজা অর্চনার আয়োজন করা হয়ে থাকে এবং প্রতিবছর অষ্টমী মেলায় আগত হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে মানত করে থাকেন। এই মন্দিরে আলাদাভাবে শিব, নাটমন্দির, কালি এবং মনসা দেবীর মন্দির স্থাপনা করা হয়েছে। এই মন্দিরে রয়েছে শতবর্ষ পুরোনো কারুকার্য খচিত বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম। এই শিল্পকর্ম এবং মন্দিরের অপার সৌন্দর্য দেখতে হাজার হাজার পর্যটক প্রতিবছর এই মন্দিরে আসেন। এই পর্যটকদের জন্য এই ঐতিহাসিক মন্দিরটি সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
প্রত্নপর্যটক তথা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য খুবই আকর্ষণীয় স্থান এই দয়াময়ী মন্দির। এটি আরও ইতিহাস সমৃদ্ধ করে সংরক্ষণ ও সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারলে একদিকে দেশের বৃহৎ সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে একটি আকর্ষণীয় প্রত্নতীর্থ হবে এবং সেই সাথে সাথে স্থানীয় শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
ঐতিহাসিক খ্রিস্টান সমাধি
জামালপুর শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে, সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে প্রবেশমুখের উত্তর পাশে ঐতিহাসিক খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রটির অবস্থান। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, পলাশীর যুদ্ধে বাঙালি জাতি পরাজিত হয়ে তৎকালীন বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে অনেকেই এই ভাটির দেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয় এবং সময় সুযোগ বুঝে তারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে (১৭৬০-১৮০০ খ্রি. পর্যন্ত) বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন করতে থাকে; ফকির বিদ্রোহ তাদের অন্যতম।
এ সকল বিদ্রোহ দমনের জন্য এই অঞ্চলের তৎকালীন সিংহজানী তথা বর্তমানের জামালপুর শহরের পশ্চিম প্রান্তে ঝিনাই ও ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গমস্থলে ঐতিহাসিক রশিদপুরে ইংরেজরা ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সেনানিবাস গড়ে তুলে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে যে সকল সৈনিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে এবং যুদ্ধে নিহত হয়, তাদেরকে এখানে খ্রিস্টান কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। জামালপুরের মানুষ এই এলাকাটি কে কম্পপুর বলে ডেকে থাকে; যেহেতু একসময় এখানে ইংরেজ সৈন্যদের ক্যাম্প ছিল তাই।
এই অঞ্চলে ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অবসান হলে জামালপুর সেনাবাহিনী রংপুরে স্থানান্তর করা হয়। অনেকগুলো সমাধি ধ্বংস হয়ে গেলেও এখানে বেশ কয়েকটি বড় বড় পুরোনো ইটের তৈরি সমাধি এখনও আছে এবং তাতে এপিটাফ রয়েছে, সেগুলোর পাঠোদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। তারপরেও এটি দেখার জন্য দেশ-বিদেশের পর্যটকদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং এই খ্রিস্টান কবরস্থান সঠিক সংরক্ষণ এবং সংস্কারের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারলে একদিকে প্রত্নপর্যটনের বিকাশ হবে অপরদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে এবং সেই সাথে স্থানীয় শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আমার বিশ্বাস।
ঐতিহাসিক গান্ধী আশ্রম
জামালপুর শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে, সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে প্রবেশমুখের উত্তর পাশে ঐতিহাসিক খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রটির অবস্থান। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে জামালপুর শহরের পশ্চিম প্রান্তে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তীরে ১৯৩৪ সালে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক গান্ধী আশ্রম। তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিংবদন্তি কৃষক নেতা নাসির উদ্দিন সরকার। তার সুযোগ্য জ্যেষ্ঠা কন্যা রাজিয়া খাতুন ছিলেন আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।
আশ্রমের কার্যক্রমের ছিল চরকায় সুতা কেটে খালি কাপড় বোনা থেকে স্বাস্থ্য সেবাসহ স্বদেশের হিতব্রতে বিবিধ কর্মসূচি পালন করা। পাকিস্তান আমলে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর প্রতিষ্ঠানটির অবহেলায় ধ্বংসের মুখে পতিত হলেও ২০০৭ সাল থেকে আবার এর কার্যক্রম শুরু হয় এবং এখন এই অঞ্চলে মহাত্মা গান্ধীর আশ্রম একটি অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পর্যটকদের সাড়া জাগিয়েছে। সুতরাং জামালপুর জেলার তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের পর্যটন বিকাশে মহাত্মা গান্ধীর আশ্রম হতে পারে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।
ঐতিহাসিক দালানি জামে মসজিদ
জামালপুর জেলা শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে উত্তর-পশ্চিমে সীমান্তবর্তী বকশীগঞ্জ উপজেলার নিলক্ষীয়া জোরদারবাড়ির ঐতিহাসিক দালানি জামে মসজিদটির অবস্থান।
নিলক্ষীয়ার ঐতিহ্যবাহী দালানি জামে মসজিদটি জামালপুর জেলার প্রায় ৩০ কি.মি উত্তরে, গারো পাহাড়ের সবুজ বেষ্টনীর অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা বকশীগঞ্জ উপজেলাধীন ৬ কি.মি দক্ষিণ দিকে অবস্থিত নিলক্ষীয়ার সাবেক অবিভক্ত বাংলার এম এলসি মরহুম আজিজুর রহমান নান্না মিয়ার পিতা মরহুম মঈন উদ্দিন শেখের অন্যতম কীর্তি নিলক্ষীয়া জোতদার বাড়ির দালানি জামে মসজিদ বা বড় মসজিদ নামেও পরিচিত।
শেখের একক প্রচেষ্টায় ও অক্লান্ত পরিশ্রমে আঠারো শতকের শেষের দিকে নির্মিত এই মসজিদ আমাদের তৎকালীন স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব ও ঐতিহ্যবাহী নির্দশন। এই মসজিদখানা স্থানীয় মুসল্লিদের এবং জোতদারবাড়ির কর্মরত কর্মচারীদের নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে নির্মিত হয়েছিল। সম্পূর্ণ দেশীয় উপাদানের এবং স্থানীয় দক্ষ রাজমিস্ত্রি দ্বারা দীর্ঘ ছয় বছরে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন করে নির্মাণ করা হয় এই দালানি মসজিদটি। এই মসজিদ আমাদের সেই গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথাই যেন বারবার মনে করিয় দেয়।
আঠারো শতকের নির্মিত প্রাচীর বেষ্টিত এই মসজিদের দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট এবং প্রস্থ ৩০ ফুট। মসজিদটিতে বড় তিনটি এবং ছোট কয়েকটি গম্বুজ অপূর্ব শোভা বর্ধন করে রেখেছে। এর দরজার সংখা আটটি। প্রাচীর বেষ্টনীর ঠিক মধ্য বরাবর রয়েছে চোখ ধাঁধানো মনোমুগ্ধকর ফটক। মুসল্লিরা এই ফটক দিয়েই মসজিদে প্রবেশ করে। মসজিদখানার ভেতেরে ও বাইরে নির্মাণ কলাকৌশল অপূর্ব। এই কারুকার্যময় মসজিদটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মরহুম মঈন উদ্দিন সাহেব কিছু ভূমি ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে- কালের আবর্তে নিলাক্ষীয়ার ঐতিহ্যবাহী এবং জন অধ্যুষিত এলাকা যেন আরও ঘন হয়ে উঠলো, মুসল্লির সংখা পর্যায়ক্রমে বেড়েই চললো, সবার প্রাণের মসজিদে আর জায়গা সংকুলান হয় না; ফলে এলাকার সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতায় মসজিদ কমিটি তৃতীয় তলা পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। অপূর্ব কারুকাজ খচিত এবং গম্বুজগুলো ভেঙে ফেলা হয়। নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার পর ছবি তোলে গম্বুজ এবং কারুকাজ ঠিক রাখা হয়।
মহারাজা প্রদ্যুতকুমার ঠাকুরের কাছারি ভবন
জামালপুর জেলা শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে ৩০ কি.মি উত্তর-পশ্চিমে সীমান্তবর্তী বকশীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক মহারাজা প্রদ্যুতকুমার ঠাকুরের কাছারি ভবন ও অন্যান্য স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের অবস্থান।
বকশীগঞ্জের পূর্ব নাম ছিল রাজেন্দ্রগঞ্জ। ইংরেজ আমলে পাতিলাদহ পরগনা রাজেন্দ্রগঞ্জ মহারাজা প্রদ্যুতকুমার ঠাকুরের জমিদারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্ভবত ১৭ শতকের মধ্যভাগে পাতিলাদহ পরগনার রাজেন্দ্রগঞ্জে মহারাজা খাজনা আদায়ের জন্য এই কাছারি ভবন নির্মাণ করেন। এই পাতিলাদহ পরগনা পূর্ব ময়মনসিংহ থেকে রংপুর জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তখন রংপুর জেলা কালেক্টরে রাজস্ব প্রদান করা হতো। বকশীগঞ্জের এই কাছারি ভবন সম্পর্কে নানান রকমের জনশ্রুতি রয়েছে। এক সময় এখানে হাতিঘোড়া বাঁধা থাকতো। শোনা যায়, কাছারি বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ জুতা পায়ে, ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে যেতে পারতো না।
এখানকার কাছারি ভবনটি ঢাকার লালবাগ কেল্লার আদলে নির্মিত। সময়ের কঠিন বাস্তবতায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও আজ এগুলো ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। তবুও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতি চিহ্নগুলোকে সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করে পর্যটকদের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারলে একদিকে যেমন এই অঞ্চলের প্রত্নপর্যটন বিকাশ হবে অপরদিকে একই সাথে স্থানীয় শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
অন্যান্য দর্শণীয় স্থান
ফুলকোচা ও মহিরামকুলে অবস্থিত জমিদারদের কাচারি (বিলুপ্তপ্রায়) ও দীঘি (মেলান্দহ উপজেলা), তারতাপাড়া গ্রামের বিলুপ্তপ্রায় নীলকুঠি (মাদারগঞ্জ উপজেলা), নরপাড়া দুর্গ (সরিষাবাড়ী উপজেলা), রাধানাথ জিউর মন্দির, নান্দিনার শোলাকুড়ি পাহাড়, শ্রীপুরের রানীপুকুর দীঘি, চন্দ্রার হরিশচন্দ্রের দীঘি (জামালপুর সদর উপজেলা), প্রদ্যুতকুমার ঠাকুরের কুঠিবাড়ি (ইসলামপুর উপজেলা), গারো পাহাড় (বকশীগঞ্জ উপজেলা) ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। এগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা করে পর্যটকদের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারলে স্থানীয় প্রত্নপর্যটন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।