হেমন্ত রাইডার্সের বৈশিষ্ট্য হলো এরা যেমন সাপ্তাহিক ফ্রাইডে লং রাইডে ঢাকা থেকে বিভিন্ন দিকে যায়, আবার প্রতিমাসে একটা লং রাইডের আয়োজন করে যেটা বাংলাদেশের কোনো অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ রুট পরিক্রমণ করে। যেমন- শ্রীমঙ্গলের রেমা-কালেঙ্গা, টেকনাফ থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে কক্সবাজার, রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই লেকের তীর ধরে বান্দরবান, সুন্দরবন, মনপুরা, নিঝুপ দ্বীপ, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শিমলু বাগান ইত্যাদি।
৩৪-৩৬ জন সাইক্লিস্টের একটা দল ঢাকা থেকে ভাড়া করা বাসে বা লঞ্চে করে নির্দিষ্ট রুটের একপ্রান্তে পৌঁছায় আবার ট্যুর শেষ করে রুটের অন্য প্রান্ত থেকে বাসে বা লঞ্চে করে ঢাকায় ফেরে। সাইকেল গুলো বাক্সবন্দি করে বাসের ছাদে অথবা লঞ্চে করে নেয়া হয়। রাত্রিযাপন কখনো হোটেলে কখনো তাঁবুতে করতে হয়। ২/৩ দিনের ট্যুরে স্থানভেদে খরচ হয় ২০০০-৩০০০ টাকা।
আমি খুলনাতে থাকলেও মাঝে মাঝে ওদের এই অ্যাডভেঞ্চারে যোগ দিই। আগে খুলনা থেকে নিজের সাইকেল নিয়ে যেতাম। এখন ছোটভাই আমানের একাধিক উন্নতমানের সাইকেল থাকায় খুলনা থেকে আর সাইকেল নিতে হয় না, ঢাকা থেকে ওর একটা সাইকেল নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। এবার যখন শুনলাম মার্চ-২০২৩ লং রাইডের রুট বকশীগঞ্জ-লাউচাপড়া-গজনী-মধুটিলা-পানিহাটা-দুর্গাপুর-বিরিশিরি-নীলাদ্রি হৃদ-টেকেরঘাট-বারেকের টিলা-শিমলু বাগান- সুনামগঞ্জ; তখন এতে যোগ দেবার লোভ আর সামলাতে পারিনি। রুটের অধিকাংশ পথই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত ধরে।
মার্চের ২ তারিখ রাতে ঢাকার পলাশী থেকে সাইকেল বাক্সবন্দি করে বাসে উঠালাম জামালপুরের বকশীগঞ্জের উদ্দেশে। ফজর নামাজের সময় বকশীগঞ্জে পৌঁছালাম। ওই অসময়েও আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন বকশীগঞ্জ সাইক্লিস্ট গ্রুপের ৬/৭ জন সদস্য। সাইক্লিস্টদের জন্য অন্য সাইক্লিস্টের সহমর্মিতা এমনই। ভোরের আলো ফুটলে বাসের ছাদ থেকে সাইকেলের বাক্স নামিয়ে যে যার সাইকেল সংযোজন করে ফেললাম আধা ঘণ্টার মধ্যে। সাইকেল বাক্সগুলোকে বাসে ঢুকিয়ে দেয়া হলো যাতে ফেরার সময় আবার ব্যবহার করা যায়।
সাইকেলের বাক্স ছাড়াও বাসের মধ্যে তাবু ছিল যেগুলো পৌঁছে যাবে নীলাদ্রি লেকের পাড়ে যেখানে আমরা তাঁবুতে রাত কাটাবো। নাস্তা করে যাত্রা শুরু করলাম সকাল সাড়ে সাতটার দিকে। প্রথম গন্তব্য লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র। লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে থাকা লাউচাপড়ার পাহাড়, অরণ্য, লেক ও আদিবাসীদের স্বতন্ত্র জীবনধারা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। আমরা এখানে ঘণ্টাখানেক কাটালাম।
এরপর ছোট-বড় টিলার ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে পৌঁছালাম পরবর্তী গন্তব্য গজনী অবকাশ কেন্দ্রে। এটি শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। এটি প্রায় ৯০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। গজনী অবকাশ কেন্দ্রে আছে সবজু গাছপালার সারি, লতাপাতার বিন্যাস, ছোট-বড় টিলা, উপজাতীয়দের ঘরবাড়ি ইত্যাদি। কৃত্রিম লেকের শান্ত জলে নৌবিহারের জন্য রয়েছে সীমান্ত প্যাডেল বোট ও ময়ূরপঙ্খী নৌকা। এছাড়া আছে ৬৪ ফুট উঁচু সাইট ভিউ টাওয়ার, ঝুলন্ত সেতু, ক্যাবল কার ও জিপ লাইনিং রাইড। যেহেতু একদিনে অনেকগুলো গন্তব্যে যেতে হবে তাই এখানেও ঘণ্টাখানেকের বেশি থাকা সম্ভব হলো না।
সাইকেলের মখু ঘুরলো এবার মধুটিলা ইকোপার্কের দিকে। মধুটিলা ইকোপার্ক বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত অন্যতম একটি পরিবেশ উদ্যান। এই পার্কের আয়তন ৩৮৩ একর। এখানে আছে সাইট ভিউ টাওয়ার, লেক, প্যাডেল বোট, স্টার বি জ, মিনি চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, রেস্ট হাউসসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এছাড়া আছে ঔষধি ও সৌন্দর্যবর্ধক প্রজাতির গাছ, মৌসুমি ফুলসহ বিভিন্ন রঙের গোলাপের বাগান। পার্কটিতে জীববৈচিত্র্য ও প্রাণীর সমাহারও চোখে পড়ার মতো। এটি ছিল জুমার দিন। তাই হ্যামোক টাঙিয়ে এখানে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে পার্কের সামনের রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়ে সেখানকার মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করলাম। পরের গন্তব্য বিজয়পুর লেক।
কখনও শালবনের ভেতর দিয়ে মাটির রাস্তা, কখনও ছোট নদীর ওপর থাকা বাশের সাঁকো, কখনও পিচঢালা পথ, কখও এবড়ো থেবড়ো ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে যখন বিজয়পুরে পৌঁছালাম তখন রাত হয়ে গিয়েছে। তাই সবাই মিলে ঠিক করলাম যে এখানে পরের দিন সকালে আসব। এটা পেরিয়ে তাই চলে গেলাম আমাদের সেদিনের রাতে থাকার স্থান নেত্রকোনার বিরিশিরি YMCA গেস্ট হাউস। সারাদিনে অসমতল পথে ১১০ কি.মি সাইকেল চালানোর পরিশ্রম তো ছিলই, গেস্ট হাউসের রান্নাটাও হয়েছিল অসাধারণ, তাই খাবার পর বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিতে না দিতেই চলে গেলাম গভীর ঘুমে। পরের দিন ফজরের নামাজ পড়েই গেলাম দুর্গাপুর চীনামাটির পাহাড় ও বিজয়পুর লেক দেখতে। গোলাপি, হলদু, বেগুনি , খয়েরি, নীলাভ বিভিন্ন রংয়ের মাটির পাহাড় চোখ জুড়িয়ে দেয়। এছাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে রয়েছে সবুজ ও নীল পানির লেক। সকাল ১০টার দিকে যাত্রা করলাম পরের গন্তব্য সুনামগঞ্জের নিলাদ্রি লেকের দিকে।
নিলাদ্রি লেক যাবার পথে একটা নদীতে গোসল করে দুপুরের খাবার খেলাম একটা ছোট দোকানে। বিকালের দিকে পেলাম টাঙ্গুয়ার হাওড়। হাওড়টি এখন শুকনো হলেও তাতে ফলে থাকা শষ্যরাজি চমৎকার দশ্যৃপট তৈরি করেছে। নিলাদ্রি লেকে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এদিন প্রায় ৭০ কি.মি চালিয়েছি। চন্দ্রালোকিত রাতে মেঘালয় প্রদেশের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে নিলাদ্রি লেকের সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত লেকের পাড়েই কাটিয়ে দিলাম।
নীলাদ্রি লেক সুনামগঞ্জের একটি অন্যতম পর্যটন স্থান। এটি মূলত চুনাপাথরের খনির পরিত্যক্ত লেক। এর অবস্থান সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী টেকেরঘাট গ্রামে। নীলাদ্রি লেকের প্রকৃত নাম শহীদ সিরাজ লেক। তবে পর্যটকদের কাছে এটি নীলাদ্রি লেক নামে বেশি পরিচিত। আর স্থানীয়দের কাছে এর নাম টেকেরঘাট পাথর কোয়ারি। ঘন নীল পানির এই লেকের একপাশে মেঘালয়ের পাহাড়, তার চারপাশে ছড়ানো ছিটানো পাথর। অনেকে একে বাংলার কাশ্মীর নামে অভিহিত করে থাকেন। এখানে রাত কাটালাম তাঁবুতে।
পরের দিনের গন্তব্য যাদকুাটা নদীর পাড়ে বারেকের টিলা ও তাহিরপুরের শিমলু বাগান। বেশ উঁচু বারেকের টিলায় সাইকেল ঠেলে উঠতে বেশ পরিশ্রমই করতে হলো। কিন্তু সেখান থেকে যাদকুাটা নদীর দশ্যৃ দেখে সব কষ্ট ভুলে গেলাম। অনেক মানষুকে দেখলাম সীমান্তের ওপার থেকে ভেসে আসা পাথর ও কয়লা সংগ্রহ করতে। যাদকুাটা নদীতে নেমে গোসল করলাম। পাহাড় বেয়ে আসা শীতল পানি সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে নিয়ে গেল। তাহিরপুরের শিমলু বাগানে যেতে যেতে দুপুুর হয়ে গেল। গাছগুলোতে তখনও কিছু ফুল অবশিষ্ট ছিল।
বিকালে সুনামগঞ্জ বাসস্টান্ডের দিকে যাত্রা করলাম যেখানে আমাদের বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। এদিন চালানো হয়েছে প্রায় ৬০ কি.মির মতো; তিনদিন মিলে মোট ২৪০ কি.মি। তিনদিন হিসাবে দূরত্ব বেশি নয়, কিন্তু যে অপার্থিব সৌন্দর্য আর সহসাইক্লিস্টদের সাথে যে আনন্দ উপভোগ করেছি তা তুলনাহীন।
মো. আনিসুর রহমান
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।