লেখকঃ শিমুল খালেদ – ব্যাংক কর্মকর্তা
সিলেট শহর ছেড়ে আমাদের বাহন মালনীছড়া চা বাগানে প্রবেশ করার সময় চোখে পড়ে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ধূসর মেঘের দঙ্গল ক্রমশ দখল নিচ্ছে ঈশান কোণের। অনুভূতিতে তখন মিশ্র অনুভবের সংঘাত! ঝরনার প্রবল প্রবাহ দেখার জন্য তো বৃষ্টিময় দিনই চেয়েছিলাম। আবার ঝড় তুফান হলে না জানি কী হয়! যাচ্ছি পান্থুমাই ঝরনার মাধুর্যের টানে। সকালবেলা টিলাগড়ে বাসা হতে বের হতে না হতেই ভ্রমণ আয়োজক রাফির ফোন। আম্বরখানায় পৌঁছে দলের সাথে মিলিত হওয়ার পরই যাত্রা শুরু হয়। চা বাগানের মসৃণ সবুজ রাজ্যপাট ছেড়ে আমরা তখন সালুটিকরে। সিলেটের উত্তর সীমান্ত লাগোয়া পাহাড়ি নদীর উত্তোলিত পাথরগুলোর বড় অংশ এখানে পৌঁছায়।
আমাদের বাহন মোড় নিয়ে এবার ছোট রাস্তায় প্রবেশ করে। সেই পথে যেতে যেতে এক সময় বৃষ্টি নামে। তবে ততটা বেগ নেই বৃষ্টিতে। ঈশান কোণের মেঘও ক্রমে সরে গিয়ে আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। চলন্ত বাহনের জানালার কাচ সরিয়ে পথের দুইপাশটা দেখতে থাকি। প্রায় এক দশক পর এইপথে দ্বিতীয় বার আসা। সে বার পথের দুই ধারে প্রচুর ঘাসবন আর নলখাগড়ার ঝোপ দেখেছিলাম। এবার অবশ্য বর্ষাকাল হওয়াতে তার বড় অংশই পানির নিচে থাকায় দৃষ্টিগোচর হয়নি। আমাদের আপাত গন্তব্য গোয়াইনঘাটের হাদারপার বাজার। গন্তব্যস্থলে পৌঁছার সময় ঘড়ির কাঁটা দুপুরের ঘণ্টায় কড়া নাড়ছে। হাদারপার বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পিয়াইন নদী। নদীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো এক রেস্তোরাঁয় নাস্তার পর্ব সেরে সদলবলে হাজির হয়ে যাই খেয়াঘাটে। এবার আমরা যাত্রী হবো নৌপথে। নদীর ঘাটে নানা রংয়ের নৌকা ভেড়ানো। কিছুক্ষণ পর পর যাত্রী নিয়ে মাঝিরা ছুটছেন বিভিন্ন গন্তব্যে।
দলের সবাই ঠিকঠাক নড়েচড়ে বসার পর মাঝি নোঙর তুললেন। স্রোতসিনী নদী পিয়াইন। দূরে সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয়ের পাহাড় কোলে তার জন্ম। পাহাড়ের সন্তান হলেও চলতে চলতে যেন আরও আপন করে নিয়েছে এই ভাটির দেশ। তাই তো তার বুকজুড়ে এতো কর্মযজ্ঞ! রোদে পোড়া তামাটে চেহারা নিয়ে তার বুকে শ্রমজীবীদের অল্পে তুষ্ট হওয়ার হাসি দেখে সেও নিশ্চয় অস্ফুটে হাসে। নদীতে বেশ স্রোত তখন। উজান থেকে নেমে আসা প্রবল পাহাড়ি ঢলে বর্ষাকালে পিয়াইন থাকে এমন খরস্রোতা। যেতে যেতে চোখে পড়ে নদীজুড়ে নানা ব্যস্ততা। যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছুটেছে নদীর মূল স্রোত ধরে। নদীর পাড় ধরে মাছ ধরছে কিছু জেলে নৌকা। একটা দুইটা পাথরবাহী নৌকাও আমাদের পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। এই নৌকার নাম ‘বারকি নাও’। সিলেটের খরস্রোতা পাহাড়ি নদীগুলোতে ঐতিহ্যবাহী এই বারকি নাওয়ের একচ্ছত্র দাপট। বিশেষত বালু পাথর উত্তোলন আর পরিবহণের কাজে লাগে বারকি। লম্বাটে চিকন গঠন হওয়াতে সহজেই প্রবল স্রোতেও চলতে পারে।
সম্প্রতি সিলেটের একজন খ্যাতনামা সাংবাদিকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বারকি নামটি এসেছে একজন ব্রিটিশ নাগরিকের নাম থেকে। মি. জন বারকি নামক জনৈক ব্রিটিশ নাগরিকের নকশায় তৈরি হয়েছিল বিশেষায়িত এই নৌকা। উদ্ভাবনের সময়টা ছিল ১৭৫৭ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়। চলতে চলতে পিয়াইন এবার বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। তবে আমাদের গন্তব্য অন্য পথে হওয়াতে এবার পিয়াইনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটাতে হলো। নৌকার গতিপথ বাঁক নিয়েছে এবার ছোট একটা খাল ধরে। মাঝির কাছ থেকে জানলাম, এটা পিয়াইনের একটা শাখা নদী। স্থানীয়ভাবে পিয়াইন খাল নামে পরিচিত। খালটি ততটা গভীর নয়। আর তাই নৌকা চলছিল ধীরে, দেখেশুনে। তারপরও হঠাৎ হঠাৎ নৌকার তলা নদীর ডুবো তলে আটকে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে দলের চঞ্চল দুই সদস্য কৃষ্ণ আর নাইম ছিল বেশ তৎপর। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেলে নৌকার চলাচল স্বাভাবিক রাখছে।
খালের অগভীর পানি একদম স্ফটিক স্বচ্ছ। টলটলে এই পানির উৎস উজানে পান্থুমাই ঝরনা। তলদেশের বালু, খনিজ পাথরে সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে। খালের একপাশ ধরে অনতি দূরে চলে গেছে মেঘালয় পাহাড়শ্রেণি। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে! অন্য পাশের ভূমিরূপ টিলাময়। সুপারি, আনারস, লেবু ইত্যাদি ফল-ফসলের প্রাচুর্য চোখে পড়ে। পাড়ের সবুজ মসৃণ ঘেসো জমিতে চরতে ভেড়ার পাল। বাঁশের ঝুড়িতে করে এক শ্রমজীবীকে কিছু একটা ধোতে দেখে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওটাতে কয়লার টুকরো। স্রোতের তলদেশ থেকে উত্তোলিত এসব কয়লা ভেসে এসেছে ঝরনার পানিতে। দূর থেকেই ঝরনার পতনের শব্দ কানে আসছিল। তারপর বাঁক পেরোতেই দূর হতে চোখে ধরা দেয় পান্থুমাইয়ের মোহনীয় রূপ। মাঝি খালের একপাশে নৌকা নোঙর করলেন। সুনসান পড়ন্ত দুপুর। মুগ্ধ করা সবুজের দৃশ্যপটে চারপাশজুড়ে অবাক নীরবতা। সেই নীরবতা ভেঙে দূর হতে কর্ণকুহরে মোলায়েম পরশে ঝংকার তুলেছে ঝরনার ঝরঝর শব্দমালা।
মেঘালয় পাহাড়জুড়ে ঘন কালচে সবুজ অরণ্য। অরণ্যের ঠাস বুনোটের ভেতর দিয়ে শৈলশেণির বুক বেয়ে নেমে এসেছে পান্থুমাই ঝরনার ধবধবে সাদা প্রবাহ। রাত আর সকালে বৃষ্টি হওয়াতে প্রবল গর্জনে পান্থুমাই ফুঁসছে যেন। পান্থুমাই নামের ছবির মতো সুন্দর এক সীমান্ত গ্রাম, মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে যার অবস্থান। পর্যটকদের কারো কারো চোখে যেটি দেশের সুন্দরতম গ্রামগুলোর একটি। আর সেই গ্রামের নামেই পান্থুমাই ঝরনার নামকরণ। সীমান্তের ওপাশে যার নাম বড়হিল ফলস। মেঘালয়ের ইস্ট খাসি হিলস জেলায় পড়েছে ঝরনাটির উৎপত্তিস্থল।
কাপড় বদল করে এবার নেমে পড়ি পাহাড়ি নদীর স্রোতে। শরীরে পানির ছোঁয়া লাগতেই হিম শীতল স্পর্শে পুলকিত হলাম। শৈলশেণি, নুড়িপাথর আর অরণ্যের গহীন তল ছুঁয়ে আসা জলধারা তো এমন শীতল হবেই! পাহাড়ি নদীর ভরা স্রোত যেন কৈশোরে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। দল বেধে সাঁতার কাটলাম। ডুব দিই পানির একদম তলদেশে। শ্বাস আটকে প্রাণ ভরে দেখি নদীর তলদেশের প্রাণবৈচিত্র্য। কাদা আর সাদা বালুর ওপর জন্মেছে শ্যাওলা আর জলজ উদ্ভিদ। ছোট ছোট মাছেরা সাঁতরে লুকোচ্ছে পানিতলের সেই বনে। আমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সাঁতরাচ্ছে রাজহাঁসের দল। কণ্ঠে তাদের বিচিত্র শব্দ। নদীর পাড়ে লতাগুল্ম অর্কিডের আটোসাটো বুনোটে বাধা পড়া বয়সি বৃক্ষ। সহচর হয়ে পাশে আদিকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘালয় পাহাড়।
মনে পড়ে যায় জীবনানন্দ দাশের কালজয়ী কবিতার কয়েকটি পংক্তি- ‘পৃথিবী আরও প্রবীণ হয়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে/ পৃথিবীর রাঁজহাস নয়, নিবিড় নক্ষত্র থেকে যেন সমাগত সন্ধ্যার নদীর জলে এক ঝাক রাজহাঁস অই।’
নিজেকে জিজ্ঞেস করি, জীবনানন্দ ও কি দাঁড়িয়েছিলেন প্রাচীন পৃথিবীর যোগসূত্রের এমন কোনো দৃশ্যপটে? নৌকার ভেতর থেকে হাকডাকে খেয়াল হয় এতোক্ষণে পেট চোঁ চোঁ করছে। ফেরার পথে দিনের আলো আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে এলো। বিকেলের নীরবতা ভেঙে ইঞ্জিনচালিত নৌকার ঢেউ চাঞ্চল্য তুলেছে স্রোতে। সেই শব্দে হতচকিত হয়ে ঘাসবন থেকে উড়ে পালায় এক ঝাঁক মুনিয়া। মেঘালয় পাহাড় ঝাপসা কালচে চেহারায় ক্রমশ হারাচ্ছে দূরে। আর আমরাও যেন জীবনানন্দের মিরুজিন নদী ধরে ছুটে চলি ঘরে ফেরার অভিপ্রায়ে। পেছনে পড়ে রয় পান্থুমাইয়ের মাতাল করা ঝরঝর সুর মূর্ছনা।