রাজধানীতে প্রতœতত্ত্ব নিদর্শনের তালিকায় পুরান ঢাকার ‘তারা মসজিদ’ অন্যতম। দর্শনার্থীদের কাছে এটি বেশ পরিচিত একটি স্থান। পুরান ঢাকার মহল্লা আলে আবু সাঈদ (বর্তমান নাম আরমানিটোলা) এলাকার আবুল খয়রাত সড়কে এই মসজিদটির অবস্থান। এর আরও কিছু প্রচলিত নাম আছে। যেমন- মীর্জা গোলাম পীরের মসজিদ বা সিতারা মসজিদ।
তারা মসজিদের বয়স নিয়ে মতপার্থক্য আছে। প্রাচীন মসজিদগুলোতে সাধারণত যেমন শিলালিপি থাকে, এই মসজিদে নির্মাণকাল উল্লেখ করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশেষজ্ঞ মুনতাসীর মামুন তার ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইয়ে মসজিদটির নির্মাণকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ বলে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, নির্মাণকাল উনিশ শতকের প্রারম্ভে। এর নির্মাতা ছিলেন ধনাঢ্য জমিদার মীর্জা গোলাম পীর বা মীর্জা আহমেদ জান। তার পূর্বপুরুষ মীর আবু সাইদ তুরস্ক থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। অষ্টাদশ শতকে তার পরিবারের সঙ্গে ঢাকার সম্ভ্রান্ত জমিদার মীর আশরাফ আলীর পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে মীর্জাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামাজিক প্রভাবপ্রতিপত্তি বেশ বেড়েছিল। তিনি যে এলাকায় থাকতেন, সেই এলাকার নামকরণও হয়েছিল তার নামানুসারে ‘আলে আবু সাঈদ’। পরে এই মহল্লাই আরমানিটোলা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
মীর্জা আবু সাঈদের নাতি মীর্জা গোলাম পীর আরমানিটোলায় এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি এটি ওয়াক্ফ করে গিয়েছিলেন। তখন লোকমুখে এর নাম ছিল ‘মীর্জা সাহেবের মসজিদ।’ মীর্জা গোলাম পীর ইন্তেকাল করেন ১৮৬০ সালে। তারা মসজিদের আগের রূপটি এখন আর নেই। প্রথম দিকে এমন অলংকৃতও ছিল না। মোগল স্থাপত্যরীতির তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ ছিল বেশ সাদামাটা ধরনের।
তিন গম্বুজ তারা মসজিদটি ছোট আকারের ছিল। দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও প্রস্থ ১২ ফুট। সম্প্রসারিত করে ছাদে তিন গম্বুজের সঙ্গে আরও দুটি গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। এখন পরিবর্ধিত মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ৭০ ফুট ও প্রস্থে ২৬ ফুট।
১৯২৬ সালে মসজিদটি প্রথমবারের মতো সংস্কার করেন আরমানিটোলার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আলী জান ব্যাপারী। তিনি বিপুল অর্থ খরচ করে জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত মানের টাইলস, মার্বেলসহ মূল্যবান নির্মাণসামগ্রী এনে মীর্জা সাহেবের মসজিদটির সংস্কার করেন। এ সময় গম্বুজ ও ভেতর–বাইরের দেয়াল ফুল, লতাপাতা ও নান্দনিক নকশায় অলংকৃত করা হয়। মূল ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয় বারান্দা। গম্বুজগুলোতে সাদা ও নীল রঙের মার্বেল ও টাইলসে অসংখ্য তারা ফুটিয়ে তোলা হয়। সেই থেকে মসজিদটির নাম পাল্টে যায়। লোকে বলতে থাকেন ‘তারা মসজিদ’।
সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এই স্থাপনা মুগ্ধকর। মসজিদের সামনে এলে দর্শনার্থীদের প্রথমেই চোখে পড়ে বিশাল আকৃতির ফোয়ারাবেষ্টিত একটি তারা।
মসজিদের জুল্লায় প্রবেশের জন্য পাঁচটি খিলানবিশিষ্ট পথ সৃষ্টি করা হয়েছে। এগুলো বহু খাঁজবিশিষ্ট এবং চারটি অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভ থেকে উত্থিত। মসজিদের অভ্যন্তর ও বাইরের পুরোটাই মোজাইক নকশা করা। এর গায়ে চিনামাটির বাসন, পেয়ালা ইত্যাদির ছোট ভগ্নাংশ ও কাচের টুকরো ব্যবহৃত হয়েছে। এ পদ্ধতিকে ‘চিনি টিকরি’ বা চিনি দানার কাজ বলা হয়। মসজিদের গাত্রনকশায় রয়েছে ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, এক বৃন্তে একটি ফুল, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র ও আরবি ক্যালিগ্রাফিক লিপি।
এখানে মুসল্লিরা তো নামাজ আদায় করতে আসেনই; বহু বিদেশি পর্যটক, রাষ্ট্রদূত, গণ্যমান্য অতিথিরাও ঢাকার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ দেখতে আসেন দর্শনীয় স্থান হিসেবে।
তারা মসজিদের ভেতরে চারটি কাতার এবং বারান্দায় আছে তিনটি কাতার। এতে প্রায় ২৮৫ জন মুসল্লি এখানে জামাতে দাঁড়াতে পারেন। দ্বিতীয় বার সংস্কারের সময় পুরোনো বারান্দার সামনেও অনেকটা জায়গা মার্বেল পাথরের ফলক পেতে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই অংশের ওপর এখন ত্রিপলের ছাউনি টাঙানো হয়েছে। এ অংশ ও সামনের মাঠ মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। তা ছাড়া দুই ঈদের জামাতও হয় এখানে।
প্রায় ৩০ বছর থেকে স্থানীয় বাসিন্দা মাওলানা তোফাজ্জাল হোসেন মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করছেন তারা মসজিদে। এখন ইমামের দায়িত্বে আছেন মাওলানা শফিকুল ইসলাম।
১৯৮৭ সাল থেকেই তারা মসজিদ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। আগে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মসজিদ পরিচালনা কমিটির প্রধান ছিলেন। গত বছর থেকে এ দায়িত্ব ওয়াক্ফ প্রশাসকের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। ওয়াক্ফ প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় মসজিদটি পরিচালিত হচ্ছে। এখানে একটি হেফজখানা ও মক্তব এবং লিল্লাহ বোর্ডিং রয়েছে। সরকারি অনুদান ও এলাকাবাসীর দানে এগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রমজান মাসে প্রতিদিন প্রায় ১০০ মানুষের জন্য করা হয় ইফতারের আয়াজন।
যেভাবে যাবেন
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার আবুল খয়রাত সড়কের ৮ নম্বর হোল্ডিং ভবনটিই হলো বিখ্যাত ‘তারা মসজিদ’। ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে খুব সহজেই তারা মসজিতে আসা যায়। চানখারপুল, গুলিস্তান কিংবা বাবুবাজার সেতুতে রিকশাচালককে আরমানিটোলা স্কুল বা তারা মসজিদ বললেই চলবে।
গুলিস্তান থেকে রওনা দিলে সিদ্দিক বাজার সড়ক হয়ে বংশাল দিয়ে সোজা পশ্চিমে এগিয়ে গেলে পড়বে মাহুতটুলী চৌরাস্তার মোড়। হাতের বাঁ অর্থাৎ দক্ষিণে মোড় নিয়ে কিছু দূর গেলেই ডানে আবুল খয়রাত রোড। সামনে আরমানিটোলা উচ্চবিদ্যালয়, তারপরই হলো তারা মসজিদ।