লেখকঃ মহিউদ্দিন হেলাল (সম্পাদক,পর্যটন বিচিত্রা)
পর্যটন বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান ও বহুমাত্রিক অন্যতম কেন্দ্রীয় খাত। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১১ ধরনের চাকরির মধ্যে একটি চাকরি পর্যটন শিল্প প্রদান করে থাকে। অর্থাৎ মোট চাকরির ১০ শতাংশ অবস্থান এই পর্যটন শিল্পে। কোভিট পূর্ববর্তী ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতিতে পর্যটন অবদান রাখে ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা বিশ্ব জিডিপিতে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ অবদান। এই শিল্পের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বে ৩৩০ মিলিয়ন মানুষ কর্মরত রয়েছে। সমগ্র বিশ্বে ১৫০ কোটি পর্যটক রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে ১ জন পর্যটক।
এসব বিবেচনায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশের জন্যই পর্যটন শিল্প সমানভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রযোজ্য। ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের জন্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিভিন্ন এজেন্ডা গ্রহণ করা হয়েছে; যা বিভিন্ন দেশ নিজ নিজ অবস্থার প্রেক্ষিতে বাস্তবায়ন শুরু করেছে। মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজি’র ওপর ভিত্তি করে এসডিজি অর্জনে ১৭টি লক্ষ্য ও ১৬৯টি সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে কার্যক্রম সেট তৈরি করা হয়েছে; যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যটন শিল্প প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট থাকলেও বিশেষ করে লক্ষ্যমাত্রা ৮, ১২ ও ১৪ অর্জনে অর্থাৎ অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেকসই ভোগ ও উৎপাদন (SCP) এবং মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যটন শিল্প সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে। তবে এই এজেন্ডা অর্জনের জন্য একটি সুস্পষ্ট বাস্তবায়ন কাঠামো, প্রযুক্তি, অবকাঠামো এবং মানব সম্পদে পর্যাপ্ত অর্থায়ন এবং বিনিয়োগ প্রয়োজন রয়েছে।
এসডিজি লক্ষ্য-৮, যেখানে উপযুক্ত কাজ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পর্যটন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি এবং বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১১টির মধ্যে একটি চাকরি প্রদান করে পর্যটন। পর্যটন খাতে শালীন কাজের (Decent work) সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে যুবক এবং নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পেশাগত উন্নয়নে ব্যাপক সম্ভাবনার ক্ষেত্র পর্যটন। পর্যটনকে টেকসই উন্নীত করার জন্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ স্থানীয় সংস্কৃতি ও পণ্য বিকশিত করবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই সেক্টরের অবদান এসডিজি লক্ষ্য-৮.৯ বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে।
এসডিজি লক্ষ্য-৪; যেখানে মানবসম্পদ উন্নয়ন একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়নে সুপ্রশিক্ষিত এবং দক্ষ জনশক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাতটি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে যুবক, নারী, প্রবীণ নাগরিক, আদিবাসী এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে; যেখানে পর্যটনের অন্তর্ভুক্তি, সহনশীলতা, শান্তি ও অহিংসার সংস্কৃতির মূল্যবোধ এবং বিশ্বব্যাপী পর্যটনে দক্ষ জনশক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা রয়েছে।
এসডিজি লক্ষ্য-১২; যেখানে দায়িত্বশীল খরচ এবং উৎপাদন বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পর্যটন শিল্পে স্থানীয় পণ্যের ব্যবহার এবং উৎপাদনের (SCP) মাধ্যমে টেকসই পর্যটনের জন্য টেকসই উন্নয়ন প্রভাবগুলি নিরীক্ষণ করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলি নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে যা স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং পণ্যের প্রচারণা করবে। টেকসই খরচ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত ‘ফ্রেমওয়ার্ক অব প্রোগ্রামে’ টেকসই পর্যটন প্রোগ্রামের (STP) লক্ষ্য হলো- পণ্যের টেকসই ব্যবহার এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা; যার ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত উন্নয়ন সম্ভব হবে।
এসডিজি লক্ষ্য-১৪, যেখানে পানির নিচে জীবন বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক পর্যটন পর্যটনের সবচেয়ে বড় অংশ, বিশেষ করে ছোট দ্বীপ, উন্নয়নশীল রাজ্যগুলির (SIDS) সামুদ্রিক পর্যটনের ওপর নির্ভর করে। লক্ষ্য-১৪.৭ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সামুদ্রিক আকর্ষণ সংরক্ষণে পর্যটনকে অবশ্যই সমন্বিত উপকূলীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনার একটি অংশ হতে হবে এবং পর্যটন ব্লু-ইকোনমিকে উন্নীত করার একটি বাহন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবে। ২০৩০ সালের মধ্যে SIDS এবং LDCs-এর অর্থনৈতিক সুবিধা বৃদ্ধি করা। মৎস্য, জলজ চাষ এবং পর্যটনের টেকসই ব্যবস্থাপনাসহ সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া, পর্যটন গন্তব্যস্থলে স্থানীয় পণ্যের উৎপাদন, ব্যবহার ও বিক্রয়কে উৎসাহিত করার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনশীলতাকে বৃদ্ধি করতে পারে। উপরন্তু কৃষি-পর্যটন, একটি ক্রমবর্ধমান পর্যটন বিভাগ, ঐতিহ্যগত কৃষি কার্যক্রমের পরিপূরক হতে পারে। এই কৃষি-পর্যটনের মাধ্যমে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কৃষি কাজে উৎসাহ ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করে কৃষি কার্যক্রমের টেকসই উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
লিঙ্গের সমতার বিষয়ে পর্যটন শিল্পের ব্যপক ভূমিকা রয়েছে। এই শিল্প নারীকে একাধিক উপায়ে ক্ষমতায়ন করতে পারে, বিশেষ করে চাকরির ব্যবস্থার মাধ্যমে এবং ছোট ও বৃহত্তর পর্যটন ও আতিথেয়তা সম্পর্কিত উদ্যোগে আয়-উৎপাদনের সুযোগের মাধ্যমে। নারীদের কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তাদের সর্বোচ্চ অংশীদারিত্বের একটি খাত হিসেবে, পর্যটন নারীদের জন্য তাদের সম্ভাবনা উন্মোচন করার একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচ্য হয়েছে।
জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান সংরক্ষণে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। পর্যটকদের গন্তব্যে নির্বাচনের বিষয়ে ঐতিহাসিক ল্যান্ডস্কেপ, বন-জঙ্গল, সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলি অনেকক্ষেত্রে বিবেচ্য হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও টেকসই পর্যটন কার্যক্রমের মাধ্যমে শুধুমাত্র জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে নয় বরং ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির প্রতি দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে, স্থানীয় উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং এর সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমে পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য, স্থানীয় সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, আতিথেয়তা ইত্যাদি পর্যটকদের কাছে অনন্য আকর্ষণ। তবে এসব আকর্ষণকে পর্যটন পণ্যে পরিণত করে স্থানীয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পর্যটন শিল্পের সাথে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে পর্যটন।
বিশ্বব্যপী পর্যটকদের চাহিদার জায়গায় গ্রামীণ পর্যটন, কমিউনিটি ট্যুরিজম, অভিজ্ঞতামূলক পর্যটন, স্লো ট্রাভেল, ইত্যাদি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের রয়েছে এই শিল্পের অপার সম্ভাবনা। আমাদের রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন পাহাড়পুর ও ষাট গম্বুজ মসজিদ। রয়েছে বিস্তীর্ণ রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওড়, বিস্তীর্ণ চা বাগান, বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সৈকত কুয়াকাট, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার দ্বীপাঞ্চল-নিঝুম দ্বীপ, সোনাদিয়া, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অব্জল।
এছাড়া রয়েছে গ্রামীণ ঐতিহ্য, স্থানীয় সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পার্বত্য অঞ্চল, বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা ও সর্বোপরি এই দেশের অতিথিপরায়ন মানুষ। এসবই পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম অনুষঙ্গ, পর্যটন শিল্পের সমৃদ্ধ উপাদান। যার সাথে দেশময় বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, আবেগ, সংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকা সম্পর্কিত। পর্যটন শিল্পের এসব উপাদান পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে পর্যটন পণ্যে উন্নীত করে পর্যটকদের কাছে বিপণন করতে হবে। তবেই সংশ্লিষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এভাবেই বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
