মো. আমানুর রহমান
লেখকঃ মো. আমানুর রহমান – ভাইস প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড
জীবনে কখনো কি হিজল বন দেখেছেন? জীবনানন্দের সিন্ধু সারস পড়েছেন, দেখেছেন নিশ্চয়ই ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো; একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো।
কখনো কি আপনার মনে হয়েছে ঢাকার আশপাশে কোথাও কি হিজল বন আছে? মনে না হলেও কোনো সমস্যা নেই, প্রশ্নটা আমিই করলাম। রাহাত কোথা থেকে খবর পেয়েছে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হিজল গাছ আছে। কানের কাছে খালি ঘ্যানর ঘ্যানর কাহাতক সহ্য করা যায়! পলাশ আর আমি কথা দিলাম ঠিক আছে নিয়ে যাব। সে মোতাবেক ১৭ জুন আমরা কালিয়াকৈর যাব বলে ঠিক করি, কিন্তু রাতে পলাশ জানায় তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসবে তাই যেতে পারবে না। হতাশ না হয়ে আমি আর রাহাত বেরিয়ে পড়ি সকালবেলা মিরপুর ১০-এ; এক হয়ে আমরা রওনা দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গেটে নাস্তা সেরে চন্দ্রায় আবার চা বিরতি দিয়ে ওখান থেকে কালিয়াকৈরের পথ ধরি।
গুগল বাবাজির সহায়তা নিয়ে এগোতে থাকি আর শীত বর্ষার যে সমস্যা গুগলে থাকে তার শিকার হই, যে পথের মুখে আমাদের নিয়ে যায় সেখানে এই বর্ষায় সাইকেল বা গাড়ি তো দূরে থাক হেঁটেও এগোনো অসম্ভব, পেছনে ফিরে আসা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাই গুরুত্বপূর্ণ এক তিন মাথায় আমরা ফেরত আসি, জায়গাটির নামও চমৎকার, কুতুবদিয়া। তবে বলে রাখি- এই ভুলপথে কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি, দুপাশের গাজিপুরীয় সৌন্দর্য দর্শনে আমাদের কোনো ক্লান্তি ছিল না। সবুজ বনানী আর বর্ষায় সব নিচু জায়গাগুলো পানিতে ভরাট হতে শুরু করছে, বিলের আকার নিচ্ছে। গতিদানব পলাশ না থাকায় আমরা হেলেদুলে চালিয়েছি পুরোটা রাইড। আমাদের কোনো ধরনের তাড়া ছিল না। যাইহোক, কুতুবদিয়া পৌঁছানোর কিলো ২ বা ৩ আগে শুরু হলো বৃষ্টি। আমরাও রেনকোট আর পঞ্চ পরে রাইডে মনযোগী হই।
চা খেতে খেতে আলাপটা সেরে নিলাম কোনদিকে কী। মজার ব্যাপার ম্যাপ আমাদের নিয়ে গিয়েছিল মির্জাপুরের ভেতর, ওর তো দোষ নেই, তার অ্যালগরিদম তাকে সেভাবেই বলতে নির্দেশ করে। হিজলতলা বা তলী বলে কালিয়াকৈরে আর একটা জায়গা আছে কিন্তু পুরো বিপরীতে কিন্তু সেখানে হিজল বৃক্ষ অনুপস্থিত আর হিজল বৃক্ষ যেখানে আছে তার নামে হিজল নেই কিন্তু কাজে আছে। যাইহোক, তাদের জটিল পরামর্শে আমরা বৃষ্টিতেই পা চালালাম। এই বর্ণনা ছবিতে বা ভাষায় দেওয়া অসম্ভব। তবে ভর বৃষ্টিতে যাদের ঠান্ডার সমস্যা নেই, সবাইকে এমন নির্জনতায় কোনো বিল বা বনের মাঝে চালানোর অভিজ্ঞতা নিতে বলবো।
আমরা সাইকেল চালাতে চালাতে মকস বিল পৌঁছাই আর বিলের পাশে এক রেস্তোরাঁয় চা খেতে খেতে দেখি দূরে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, ওদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানি ওতে যাবার পথও আছে আর এটার নাম ওরা দিয়েছে মনপুরা।
আগেই বলেছি- আমাদের তাড়া ছিল না, তাই কাদামাটি পেরিয়ে আমরা মনপুরা যাই আর নির্জনতার সর্বোচ্চ চূড়ায় হারিয়ে যাই। ভাবুন, চারদিকে পানি, প্রচুর বাতাস, ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে কিন্তু কোনো কলরব ছাড়া নিঃশব্দে ক্যাম্প করার জন্য আদর্শ এক জায়গা। ওদের সাথে আলাপ করে জানলাম- ৩০ জনের জন্য একরাত তাবু গাড়তে ওরা অনুমতি দেবে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে।
আবার মূল সড়কে ফেরত আসি আর আমাদের মূল গন্তব্য হিজল বৃক্ষ দর্শনে এগোতে থাকি। পথে অধিকাংশ মানুষই আপনাকে হিজল বৃক্ষের অনুসন্ধানে সঠিক তথ্য দিতে পারবে না, আর যেটা মনে হলো এটা মৈনটের মতো এখনো ততটা জনপ্রিয় হয় নাই। রাহাতকে বললাম আমরা আর হিজল বৃক্ষের খোঁজ না নিয়ে বরং গলাচিপা ইউনিয়ন যাবার পথটা খুঁজে নিই, সেভাবেই আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাই। এলাকার লোকজন বলেছিল- পাগলামি করতে আসছেন যান দেখেন দুই তিনটা হিজল গাছ থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আমরা অবাক হলাম, মুগ্ধ হলাম, আসলেই হিজল বন আছে, টাঙ্গুয়ার মতো বিশাল পরিসরে নয় তবে ২৫/৩০টা গাছ হবে। এখনো কর্দম পথ কিন্তু আগস্টে নৌকা নিয়ে জলমগ্ন হিজল বৃক্ষ দেখতে পারবেন। আমরা অবাক হলাম গাজীপুরের আরও দুই রাইডার ইতোমধ্যে সেখানে হ্যামক টানিয়ে বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত। আপনি অবাক হবেন তাদের একজন এসেছেন একটি সাধারণ বাংলা সাইকেল নিয়ে। জি¦, সাধারণ বাংলা সাইকেল এবং তাই নিয়েই তিনি ঘুরে বেড়ান, ইচ্ছেটাই মুখ্য, ব্রান্ড আসলে গৌণ। আপনি ট্রেক ঘোস্টের মালিক আর ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন, প্লিজ, কাউকে দান করে দিন, আপনার সাইকেলটা দুনিয়া দেখুক।
হ্যাপি সাইক্লিং, সাইকেল ছাড়াও দুনিয়া দেখা যায়, দেখুন মহান আল্লাহ দুনিয়া কত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন! আচ্ছা নিশ্চয়ই প্রতি শীতে আপনার একটা প্ল্যান থাকে, থাকে না? এই যেমন এবার বান্দরবান যাব বা রাঙামাটি বা সেন্টমার্টিন কিংবা অন্যভাবে চিন্তা করলে এই তো গতবার সমুদ্র দেখেছি তাহলে এবার না হয় পাহাড় দেখি- এরকম নানান প্ল্যান। এবার ঢাকার আশপাশে একটা প্ল্যান দিই দূরে যেতে হবে না। বর্ষায় ঘুরে আসতে পারেন এই রুটে কোনো ধরনের পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই, আর তাতে দেখতে পারেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, স্মৃতিসৌধ, মকস বিল, গলাচিপার হিজল তলা, গাজীপুরের নিবিড় নির্জন বন।
যেভাবে যাবেন
রুট: মিরপুর-গাবতলী-স্মৃতিসৌধ-চন্দ্রা-কালিয়াকৈর-গলাচিপা-শালনা-গাজীপুর-বনমালা-দিয়াবাড়ি-মিরপুর।