লেখক: আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল
দেশটি আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব আফ্রিকার সবচেয়ে ছোট দেশ। নাম তার রুয়ান্ডা। প্রতিবেশী বুরুন্ডির থেকেও ছোট এবং তানজানিয়া, উগান্ডা ও কঙ্গোর তুলনায় বামন রাষ্ট্র। দেশটি ১০ হাজার ১৬৯ বর্গমাইল, লোকসংখা ১ কোটি সাড়ে ৩৬ লাখ হওয়া সত্ত্বেও আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তালিকায় বিশ্বের নবম নিরাপদ দেশ এটি। গেল জুনে দেশটিতে সাইকেল চালানোর সুযোগ ঘটেছিল। আমরা চারজন গিয়েছিলাম বাংলাদেশ থেকে। রুয়ান্ডাতে ২০ দিন ছিলাম। এর মধ্যে একটানা ১৩ দিন সাইকেল চালিয়েছি।
রুয়ান্ডাতে আমাদের পোর্ট অব এন্ট্রি ভিসা। কোনো ফি দিতে হয়নি, তবে ইমিগ্রেশনের পর করোনার টেস্ট করাতে হয়েছে সবাইকে। পূর্ব নির্ধারিত হোটেলে গিয়ে উঠলাম। এটি একটি চার্চের হোটেল। হোটেলের ম্যানেজার মার্টিন বয়সে তরুণ এবং চমৎকার ইংরেজি বলেন। কিনিয়ারোয়ান্ডা হলো রুয়ান্ডার সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ভাষা। ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় অনেকে কথা বলেন এবং মাইগ্রেশেনের কারণে সোয়াহিলি ভাষার প্রচলনও রয়েছে। St. Etienne Guest House-টি পাহাড়ের চূড়ায়। তাদের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট রয়েছে। রাতের খাবারের জন্য ডিম ভাজি, মুরগি ও পালংশাকের মতন যাকে তারা বলে ডডু (dodo) এবং পরবর্তীতে প্রায় প্রতিদিনই ডডু খাওয়া হতো।
ঢাকায় ব্র্যাকে কর্মরত শরীফুল হাসানের সহযোগিতায় রুয়ান্ডায় ব্র্যাকে কর্মরত বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা হয়। এদের মধ্যে বেলায়েত ভাই, মুজাম ভাই, রাজীব দে অন্যতম। কেনিয়াতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের হাইকমিশনার তারেক মুহাম্মদ, সায়েম আহামদ ও প্রটোকল অফিসার নাসির ভাইয়ের সহযোগিতা অতুলনীয়। ঢাকাতে রুয়ান্ডার অনারারি কনসাল ইকবাল ভাই, নতুন দিল্লিতে রুয়ান্ডার হাইকমিশন, কিগালিতে জউই (Rwanda Development Board), সাইক্লিস্ট ক্যালিসহ সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
রুয়ান্ডাকে বলা হয় হাজার পাহাড়ের দেশ। দেশটিতে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। এটি একটি স্থলবেষ্টিত (Landlock) দেশ। প্রতিদিনই কফি খাওয়া হতো। এখানকার কফি বিখ্যাত। রুয়ান্ডার কফি ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, নিকারাগুয়া এবং কোস্টারিকার পাশাপাশি রয়েছে। কোনো দেশের নেতা বা শাসক যদি সৎ বা ভালো হন, তবে সে দেশের জন্য সুবাতাস বয়ে আনে। রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে তেমনি একজন সফল সমরনায়ক ও প্রেসিডেন্ট। তিনি রুয়ান্ডার চতুর্থ প্রেসিডেন্ট, ২০০০ সাল থেকে বহাল তবিয়তে আছেন।
দেশটি এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার পেছনে রয়েছে রুয়ান্ডাবাসীর কমিউনিটি কার্যক্রম; যা উমাগান্ডা (Umuganda) নামে পরিচিত। এই ধরনের সেবা কার্যক্রম প্রতি মাসের শেষ শনিবার পালন করা হয়। যেখানে তারা কমিউনিটি সেক্টরের মধ্যে রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ, বাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে বৃক্ষ রোপন এবং কৃষিকাজ পর্যন্ত বিভিন্ন পাবলিক ওয়ার্ক প্রকল্পে কাজ করে থাকেন। এই বিষয়টি আমরা রুয়ান্ডার সর্বত্র দেখেছি। একদিন জমিতে একদল লোককে দেখলাম সবাই কমলা রঙের কাপড় পরে কাজ করছেন। পরে জানলাম এরা সবাই কয়েদি ছিলেন।
যদিও রাস্তাঘাটে সর্বত্র নারীদেরই কর্মক্ষেত্রে প্রাধান্য দেখেছি। এমনকি দেশটির পার্লামেটে ৬০ ভাগের বেশি সদস্য নারী; যা বিশ্বের আর কোনো দেশের পার্লামেন্টে নেই।
সাইক্লিস্ট ক্যালি তার বাবা-মাকে রুয়ান্ডায় গণহত্যার সময় হারিয়েছেন। গণহত্যার বিষয়ে তারা কথা বলতে আগ্রহী নন। সবকিছু ভুলে তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি- রুয়ান্ডার জনসংখ্যার বেশিরভাগই হুতু ও তুতসি। এই দুটি জাতিগত গোষ্ঠী প্রায়ই ঐতিহাসিকভাবে সংঘাতের মধ্যে রয়েছে। এই সংঘাতের চূড়ান্ত পরিণতি হয়েছিল ১৯৯৪ সালে, যখন মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে প্রায় এক মিলিয়ন তুতসি এবং মধ্যপন্থী হুতুকে হত্যা করেছিল হুতুরা। এটি ইতিহাসের সবচয়ে দ্রুততম এবং সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার মধ্যে একটি।
আজ রুয়ান্ডা একটি খুব ভালো অবকাঠামোসহ একটি আধুনিক দেশ হিসেবে পরিচিত। রুয়ান্ডাকে হাজার পাহাড়ের দেশ বলা হয়, কখনো কখনো আফ্রিকার ‘সুইজারল্যান্ড’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রুয়ান্ডায় ছুটির দিনে যে সব জায়গায় ঘুরে আসতে পারেন সেগুলো হলো- পর্বত গরিলা, চা বাগান, লেক কিভু, আফ্রিকার প্রাচীনতম রেইনফরেস্টের মধ্য দিয়ে হাইকিং করা। রাস্তা খুব ভালো হওয়ায় খুব অল্প সময়েই রুয়ান্ডার সর্বত্রই যাওয়া যায়। কিগালি, নিয়ং ওয়ে ন্যাশনাল পার্ক, লেক কিভু এবং বিখ্যাত আগ্নেয়গিরি জাতীয় উদ্যান ঘোরা ছাড়া রুয়ান্ডা ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না। আর আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি সাইকেলে করে, আমাদের আনন্দ ছিল অন্য সবার চেয়ে আলাদা। রুয়ান্ডা এক ভালোবাসা ও ভালো লাগার নাম।
দ্বিতীয় দিন ব্র্যাকের রাজিব, ইমরানের ভারতীয় দুজন সাইক্লিস্ট বন্ধু ও আরডিবি থেকে সাইক্লিস্ট ক্যালি আসলেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। পরবর্তীতে রাজীব, ক্যালিসহ পদব্রজে কিগালির লোকাল মোবাইল সিমকার্ড ও ডলার ভাঙানোর জন্য কিগালি সিটি মলে যাই। পথে চোখে পড়ে কার ফ্রি জোন এবং বসার জন্য সুনির্দিষ্ট স্থান। যেখানে বসে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহার করছেন অনেকে। কেউ ছবি তোলায় ব্যস্ত, সিনেমা/নাটকের শুটিংও দেখলাম। কিগালি সাইন রয়েছে এমনভাবে, যেখানে পর্যটকরা এসে সবাই ছবি তুলতে পারেন। রাস্তার পাশে প্রচুর সুভ্যেনির ব্যবসার দোকান, একটি পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টও দেখলাম।
এই সিটি মলের পাশেই হাঁটার দূরত্বেই রয়েছে হোটেল দেস মিল (Hotel des Mille Collines)। এটি সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্টে অবস্থিত। হোটেলটি রুয়ান্ডার গণহত্যার সময় ১ হাজার ২৬৮ জন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। তারা সংখ্যাহীন কক্ষে ১০ জনের দলে লুকিয়ে থাকতেন এবং পানীয় জলের জন্য সুইমিং পুলের পানির ওপর নির্ভর করতের। ২০০৪ সালের কাল্পনিক চলচ্চিত্র হোটেল রুয়ান্ডা (Hotel Rwanda) থেকে পর্যটকরা ইতোমধ্যেই কিছুটা পরিচিত। এটি এখনো কার্যকর বিলাসবহুল হোটেল। এটি এখন কিগালিতে থাকার সেরা জায়গাগুলোর অন্যতম। এটি একটি চার তারকা হোটেল, এখানে ১১২টি রুম রয়েছে। হোটেলের রিসেপশন থেকে শুরু করে সর্বত্র রুয়ান্ডার আর্ট কালচারের ছোঁয়া রয়েছে। কিগালির অপূর্ব দৃশ্য দেখতে হলে হোটেলটির চতুর্থ তলায় (Le Panorama) রেস্টুরেন্টে যেতে হবে।
১৯৬২ সাল থেকেই কিগালি রুয়ান্ডার রাজধানী ছিল, যখন রুয়ান্ডা বেলজিয়াম থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বিভিন্ন দেশে যখন যাই, তখন সে দেশের কিছু সুভ্যেনির সংগ্রহ করি। কিগালির সুভ্যেনিরের জন্য ক্যাপলাকি মার্কেট খুব বিখ্যাত। তবে দাম অন্য জায়গার চেয়ে বেশি। কার ফ্রি জোনে সুভ্যেনিরের দাম অনেক কম এবং সবচেয়ে ভালো পেয়েছিলাম আমাদের গেস্ট হাউজের অপরদিকে একটি ছোট সুভ্যেনির শপে।
প্র্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন