পর্যটন বিচিত্রা ডেস্ক
মনে হয়, বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি পর্যটকদের কাছে প্রথম পছন্দের নাম দার্জিলিং। ৮,৫৯৮ মিটার (২৯,২০৯ ফুট) উচ্চতার পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়ের বহু বর্ণিল আলোকচ্ছটার অপার্থিব রূপ দেখতে তাই মানুষের এত আকর্ষন। এই জেলা ইকো ট্যুরিজমের অন্যতম পীঠস্থান। শিলিগুড়ি, কালিম্পং, কার্শিয়াং, জলঢাকা, গৌরবাথান, জোড়বাংলো, মিরিক, নালবাড়ি, প্রধাননগর, দুখিয়াপোখরি এই জেলার বিখ্যাত জায়গা।
দার্জিলিং বেড়াবেন বিভিন্ন পয়েন্টে
গময় ও রুট বিবেচনা করে দার্জিলিং শহর ও এর আশপাশের ভ্রমণ কেন্দ্রগুলো ভাগ করা হয়েছে বিভিন্ন পয়েন্টে। যেমন- টু পয়েন্ট বলতে গঙ্গামায়া পার্ক ও রক গার্ডেন ভ্রমণ। থ্রি পয়েন্ট ভাগ করা আছে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখার জন্য টাইগার হিল, বিখ্যাত ঘুম বৌদ্ধ মন্দির ও বাটাশিয়া লুপ। ফাইভ পয়েন্টের অন্তর্ভুক্ত স্পটগুলো হচ্ছে- জাপানি মন্দির, লালকুঠি (কাউন্সিল ভবন), আভা আর্ট গ্যালারি এবং ধীরধাম মন্দির ইত্যাদি। সেভেন পয়েন্ট বলে পরিচিত স্থানগুলো হচ্ছে- পদ্মজা নাইডু জ্যুওলজিক্যাল পার্ক, বিখ্যাত হিমালয়ান মাউন্টেরিয়ান ইনস্টিটিউট, রোপওয়ে, পর্বতারোহণ স্বাদ পেতে, বিশাল এক পাথরে উঠানামা জন্য তেনজিং রক, চা বাগান, তিবক্ষতী রিফুজি ক্যাম্প এবং হস্তশিল্প প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র, চারদিকে সুউচ্চ উপতক্যার মাঝে সমতল মাঠ, দার্জিলিং গুর্খা স্টেডিয়াম ইত্যাদি।
ম্যাল এলাকা
দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে জমজমাট ও নানা পর্যটকদের মিলনমেলা বসে ম্যাল এলাকায়। চারদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝে একটুখানি সমতল এলাকা। আয়োজনও চমৎকার। সমগ্র ম্যাল এলাকা রেলিং দিয়ে বেষ্টন করা আছে। ছোট ছোট বেঞ্চি রয়েছে বিশ্রাম ও আড্ডা দেয়ার জন্য। ম্যাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হোটেল, ট্যুরিস্ট লজ, বিভিন্ন দ্রব্যের দোকান, রেস্তোরাঁ, ব্যাংক আরও কত কী। স্টুডিও তো আছেই, সেই সঙ্গে পাবেন ক্যামেরা নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ানো পেশাদার ফটোগ্রাফার। ইচ্ছে করলে আপনার পছন্দের আলোকচিত্রটি পেশাদার আলোকচিত্রীকে দিয়ে তুলে নিতে পারেন।
নাইটিঙ্গেল পার্ক
ম্যাল চত্বর ছাড়িয়ে আরও কিছু দূর উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন নাইটিঙ্গেল পার্কে। দার্জিলিং ভ্রমণ বিনোদনে খুব বেশি হয়নি এই পার্কটি সংযোজনের। হাজারো পাখির কলকাকলি, উঁচু স্থান থেকে সশব্দে গড়িয়ে পড়া ঝরনার পানির বর্ণিল আলোকচ্ছটা এবং পুরো পার্কটিকে এমন সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। পাখির কলকাকলি শুন ভাবছেন পাখি কোথায়? একটু লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন পাখির এ কলতান সৃষ্টি করা হয়েছে কৃত্রিমভাবে। নাইটিঙ্গেল পার্কের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে স্থানীয় গুর্খা জাতিসত্তার নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে নাচ ও গানের অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব হচ্ছে উপস্থিত অতিথিদের অংশগ্রহণে নাচ ও গান। সবমিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য এক সন্ধ্যা কাটিয়ে আসতে পারেন নাইটিঙ্গেল পার্কে। পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জ্যুওলজিক্যাল পার্ক ম্যাল চৌরাস্তা থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে জহর পর্বতের গায়ে এই পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে। হিমালয় অঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্যের বেশকিছু নমুনা রয়েছে এই জ্যুলজিক্যাল পার্কে। এর মধ্যে জানা-অজানা বিচিত্র ও দুর্লভ গাছ-গাছালি ছাড়াও আপনি দেখতে পাবেন মিসুলয়ের অতিকায় কালো ভল্লুক, সাইবেরিয়ান বাঘ, সাম্বার ও চিত্রা হরিণ, ইলামা হায়না, লাল পা-া এবং নানা রঙ ও আকৃতির বহু প্রজাতির পাখি।
হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট
পদ্মজা নাইডু জ্যুওলজিক্যাল পার্ক ও হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট একই গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। পর্বতারোণের প্রশিক্ষণের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটির বেশ খ্যাতি রয়েছে। এখানকার মিউজিয়ামে আপনি পৃথিবীর প্রথম দুই পর্বতারোহী তেনজিং ও হেলারি থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ঘটনাবহুল ও বিখ্যাত সব পর্বতারোহী ও আরোহণের তথ্যবহুল প্রদর্শনী যেমন দেখবেন, তেমনি আপনি দেখতে পাবেন পর্বতারোণের জন্য প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের প্রদর্শনী।হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেন
উঁচু পাহাড়ের অপরূপ উপত্যকায় গড়ে তোলা হয়েছে চা বাগান। এই বাগানে এসে গাছ থেকে চা পাতা তোলা থেকে শুরু করে চা তৈরির যাবতীয় কলাকৌশল দেখে নিতে পারেন।
টাইগার হিল
শেষরাত থেকে অসংখ্য জিপের সারি ও মানুষের কোলাহলে পূর্ণ হয়ে ওঠে টাইগার হিল। দার্জিলিং শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত টাইগার হিল কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখার ভিউপয়েন্ট হিসেবে খ্যাত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫৫৫ মিটার উঁচুতে টাইগার হিলের ভিউপয়েন্ট থেকে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র বরফের রাজ্যে সূর্যের প্রতিফলনে বহু বর্ণিল আলোর ঝলকানি দেখার জন্য টাইগার হিলে আপনাকে আসতেই হবে। পরিষ্কার আকাশ থাকলে টাইগার হিল থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টও দেখা যায়। দার্জিলিংয়ে বেড়াতে যাবেন কিন্তু ট্রয় ট্রেনে চড়বেন না তা কী হয়? বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত ন্যারো গেজ লাইন দিয়ে যখন ট্রেনটি চলতে থাকে এর মতো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আর কী হতে পারে? ট্রয় ট্রেন জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত যাতায়াত করলেও দীর্ঘ পথের সময় বাঁচাতে আপনি দার্জিলিং থেকে ‘ঘুম’ স্টেশন পর্যন্ত ভ্রমণ করে বিশ^ ঐতিহ্য এই ট্রয় ট্রেনের কিছুটা রোমাঞ্চের স্বাদ পেতে পারেন।রক গার্ডেন
দার্জিলিং থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রক গার্ডেনে কলকল ধ্বনিতে প্রবাহিত হচ্ছে প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। পাহাড়ের গা ঘেঁষে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে কৃত্রিমভাবে তৈরি সিঁড়ি। বেশ সাজানো-গোছানো আয়োজন দেখতে পাবেন রক গার্ডেনে এসে। পিকনিক স্পট হিসেবে এটি বিখ্যাত।গঙ্গামায়া পার্ক
রক গার্ডেন থেকে আরও ৩ কিলোমিটার দূরে বিশাল এক জলপ্রপাতকে কেন্দ্র করে বেশ বড় এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে গঙ্গামায়া পার্ক। পার্কের ভেতর লেকে নৌকা ভ্রমণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে আদিবাসীদের পরিবেশিত নাচ ও গানের ব্যবস্থা। স্থানীয়দের তৈরি হস্তশিল্প দোকান, খাবার ব্যবস্থা সবই আছে এখানে।দার্জিলিং যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে দার্জিলিং যাওয়া এখন অনেক সহজ হয়েছে। বাসে লালমনিরহাট জেলার বুড়িমারী সীমান্ত দিয়ে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে জিপে দার্জিলিং। দার্জিলিয়ং থেকে প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে জিপ ব্যবহার করতে হবে। দার্জিলিংয়ে বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হোটেল হচ্ছে- তারকামানের হোটেল দি নিউ এলগিন হোটেল, মে ফেয়ার হিল রিসোর্ট, হোটেল মোহিত, হোটেল সিনকেয়ার্স ইত্যাদি। এছাড়া হোটেল উমা, হোটেল স্বাতী, হোটেল ব্রডওয়ে ইত্যাদি বিভিন্ন মানের হোটেল গোটা শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
পূর্ণিমার রূপ যেমন অপার্থিব আনন্দ দেয়, তেমনি আঁধারেরও তো রূপ আছে! পরিষ্কার মেঘহীন আকাশে দার্জিলিং যেমন তার রূপের ঐশ^র্য মেলে ধরে তেমনি বর্ষায় সবুজ পাহাড় ও বিশাল ঝরনাধারার অন্য রূপ দেখতে পাবেন। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে শীতের তীব্রতার পাশাপাশি হয় তো তুষারপাতেরও দেখা পেতে পারেন। সমতলের মানুষের জন্য তুষারপাত দেখা দারুন আনন্দের ব্যাপার বৈকি! দার্জিলিং ভ্রমণের সবচেয়ে আদর্শ সময় হচ্ছে মার্চ থেকে মে মাস এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস।